পরনির্ভরতা মুছে যাক

19

 

বিশ্বের অন্যতম প্রচন্ড খরস্রোতা নদী পদ্মা। এ পদ্মার বুক ছিড়ে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে গড়ে উঠেছে দেশের ১৯ টি জেলা। এক চোখের সীমানায় কুল-কিনারাহীন এ পদ্মা পাড়ি দিতে ওই অঞ্চলের মানুষকে ফেরি, লঞ্চ, স্টিমার, সুপরিসর জাহাজের কোন বিকল্প ছিলনা। সেই প্রমত্তা পদ্মার উপর সড়ক রেল পথের সমন্বয়ে দ্বিতল বিশিষ্ট বহুমুখী সেতু নির্মিত হয়েছে, এবং আজ সকালে সেই সেতুর শুভ উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। সেইসাথে সুভাগ্যের দুয়ার খুলে যাচ্ছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯ জেলার তিনকোটি জনগনের। অভিনন্দন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। দেশের আত্মমর্যাদা রক্ষার প্রশ্নে এবং অর্থনৈতিক সক্ষমতা প্রমাণের জন্য যার একটি মাত্র সাহসী সিদ্ধান্ত পুরো দেশের সম্মান অহংঙ্কার গৌরব আজ আকাশ ছুঁয়েছে। বিশ্ববাসী বিস্ময়ের সাথে দেখছে বাংলাদেশ এবং দেশটির কান্ডারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুঃসাহসী যাত্রা এবং একটি স্বপ্নের একটি অসম্ভবের সম্ভবপর করে তোলা ও পূর্ণ সফলতায় নিয়ে যাওয়ার উপাখ্যান। গত বুধবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পদ্মসেতু নির্মাণে রাষ্ট্রের উদ্যোগ ও দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে সফলতার যে ইতিহাস রচিত হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী পদ্মাসেতু নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলেছেন, সাহস নিয়ে নিজেদের টাকায় পদ্মাসেতু করার ফলে বাংলাদেশের সম্মান ফিরে এসেছে। তিনি বলেন, আমাদের দেশের মানুষের একটা ধারণা ছিল, অন্যের অর্থায়ন ছাড়া আমরা কিছু করতে পারব না। এটা হলো পরনির্ভরশীলতা, পরমুখাপেক্ষিতা। এই মানসিকতা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পেরেছি। নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসাবে। প্রধানমন্ত্রীর এসব কথার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ নেই। পদ্মাসেতুর অর্থায়ন থেকে বিশ্বব্যাংক যখন সরে গেল, তখন আমরা ভেবেছিলাম, সেতুটি বুঝি আর হলো না। প্রধানমন্ত্রী যখন ঘোষণা দিলেন, নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু হবে, তখনো অনেকের মনে দ্বিধা-দ্ব›দ্ব ছিল যে, এটা হয়তো সম্ভব হবে না। অনেক অর্থনীতিবিদও হতাশাজনক বক্তব্য রেখেছিলেন তখন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেখা গেল, ঠিকই নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মিত হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা, সাহস ও দূরদর্শিতার ফলেই সম্ভব হয়েছে। এ পর্যায়ে আমরা প্রধানমন্ত্রীকে আরেকবার ধন্যবাদ জানাতে চাই। তারই কল্যাণে পদ্মা সেতু এখন আমাদের সক্ষমতার প্রতীক হিসাবে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, পদ্মাসেতু শুধু রড, সিমেন্ট ও পাথরের সেতু নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ১৬ কোটি মানুষের আবেগ। চ্যালেঞ্জকে জয় করার অদম্য স্পৃহা এবং আগামীতে দেশের অর্থনীতিতে অপার সম্ভাবনার হাতছানি। সেইসাথে মুছে যাবে পরনির্ভরতা, মুখাপেক্ষিতা। ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক অর্থায়নের সিদ্ধান্ত বাতিল করার পর সরে যায় আন্তর্জাতিক আরও তিনটি সংস্থা- এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি এবং ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। এতে পদ্মার আকাশে দেখা দেয় কালো মেঘের ঘনঘটা। ওই সময়ে প্রকল্পটির ব্যয় ছিল প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। যা ওই বছরের মোট বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির ৫০ শতাংশ। ফলে নাগালের বাইরে চলে যায় পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের স্বপ্ন। পরের ইতিহাস সবার জানা। ২০১২ সালের সেই উদ্যোগ, নকশা ও নির্মাণ কৌশল সব পরিবর্তন, পরিমার্জন কওে একটি টেকসই এবং পরিবেশ-প্রতিবেশ, অর্থনীতি এবং সামাজিক নিরাপত্তা, আগামীর উন্নয়নসহ সকল বিষয় মাথায় রেখে উন্নত ও সর্বাধুনিক প্রকৌশলগত একটি বিস্ময়কর স্থাপনা এ পদ্মাসেতু। এ সেতু নির্মাণ করতে ব্যয় হয়েছে ৩০ হাজার, ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। সেতুর দীর্ঘ ৬.৫ আর আশেপাশে নদী শাসন করা হয়েছে ১৪ কিলোমিটার। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ সেতু বাস্তবায়ন হলে অর্থনীতিতে সরাসরি এর সুফল আসবে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পদ্মাসেতুর মাধ্যমে অর্থনীতিতে সরাসরি তিন ধরনের সুবিধা রয়েছে। প্রথমত, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে। এতে ওই অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য বিস্তার লাভ করবে। বিনিয়োগ বাড়বে। দ্বিতীয়ত, কৃষক সরাসরি উপকৃত হবেন। তাদের উৎপাদিত পচনশীল পণ্য সরাসরি ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে পাঠাতে পারবেন। এতে পণ্যের ভালো দাম পাওয়া যাবে। তৃতীয়ত, এ সেতুর ফলে সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তার হবে। বিশেষ করে ভারতের বাণিজ্য বাড়াতে মোংলা বন্দর ব্যবহার করা যাবে। এ বিষয়ে সেতু বিভাগের সচিব মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন যুগান্তরকে বলেন, পদ্মা সেতু শুধু একটি সেতু নয়, এটি আমাদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন। এ সেতুর মাধ্যমে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ও অর্থনীতিতে একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম পাবে। ইতিমধ্যে এসব জেলায় নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠছে। সেগুলোতে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। সবমিলিয়ে এটি বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে। পদ্মা সেতুর কারণে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের ভাগ্য খুলে যাচ্ছে। সেতুকে ঘিরেই মানুষের জীবনযাত্রার মানও বদলাচ্ছে। এখানে বিশ্বমানের অলিম্পিক ভিলেজ, বেনারসি তাঁতপল্লী, রাজউকের উদ্যোগে আইকন টাওয়ার, দেশের মধ্যে একমাত্র ন্যাশনাল জুডিশিয়াল একাডেমিসহ বড় বড় প্রকল্প নির্মিত হচ্ছে। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণও বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। পদ্মা সেতুতে যারা জমি দিয়েছেন তাদের অনেকে নিজেদের গৌরবান্বিত মনে করে গণমাধ্যমকে বলেছেন, জমি দিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জমির দামের দেড়গুণ অর্থ প্রদাসহ আবাসন প্রকল্প করে দিয়েছে সরকার। জমি গেলেও পদ্মার উপর সেতু হচ্ছে, এতেই আমরা খুশী। আমরা আশা করি, এ সেতু বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে। এর উপর ভিত্তি করে আগামীতে আরো ব্যাপক যোগাযোগ উন্নয়ন ঘটবে।