পবিত্র রমজানের প্রস্তুতির মাস ‘মাহে রজব’

32

সৈয়দ মো. জালাল উদ্দিন আল আয্হারী

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন, ‘আসমান-জমিনের সৃষ্টি ও সূচনা লগ্ন হতেই আল্লাহর বিধান মতে মাসের নিশ্চিত সংখ্যা বারোটি। তার মাঝে চারটি সম্মানিত। এটি এক অমোঘ ও শাশ্বত বিধান; সুতরাং এর মাঝে তোমরা (অত্যাচার-পাপাচারে লিপ্ত হয়ে) নিজেদের ক্ষতি সাধন করো না।’ (তওবা-৩৬)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, বারো মাসে বছর। তার মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। তিনটি ধারাবাহিক: যিলক্বদ, যিলহজ্ব, মহররম আর চতুর্থটি হল রজব মুদার, যা জুমাদাল উখরা ও শাবান মাসের মধ্যবর্তী মাস।’ (বুখারী ২/৬৭২, হা-৩১৯৭, মুসলিম-১৬৭৯।)আল্লাহ তাআলা আরও এরশাদ করেন, ‘আপনার পালনকর্তা যা ইচ্ছে সৃষ্টি করেন এবং পছন্দ করেন। (সূরা কাসাস : ৬৮) অর্থাৎ স্বীয় সৃষ্ট বস্তু হতে কিছু মনোনীত করেন, শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদার ঘোষণা দেন। যেমন তিনি মনোনীত করেছেন কয়েকটি দিন, কয়েকটি মাস; সম্মান, শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা প্রদান করেছেন অন্য সব দিন ও মাসের উপর। এই চারটি সম্মানিত মাসের একটি হল রজব।
‘রজব’ মাসের নামকরণ: ‘কামূস’ নামক প্রসিদ্ধ অভিধানে রাজাব’ অর্থ লিখেছেন, ‘ভীতিপ্রদর্শন করা’, ‘সম্মান করা’। এ থেকে ‘রজব’ শব্দের উৎপত্তি। আরববাসীগণ এ মাসের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে আসতো। আল্লামা জাযারী তাঁর ‘নিহায়াহ’য় লিখেছেন- ‘তারজীব’ মানে ‘তা’যীম করা’। এ কারণে আরববাসীগণ রজব মাসকে সম্মান করতো। এ মাসকে ‘রজব-ই মুদ্বার’ (মুদ্বার গোত্রের রজব মাস)ও বলা হতো।
উলামায়ে কেরাম বলেছেন, আশহুরে হুরুমের এই বৈশিষ্ট্য রয়েছে যে, এ সব মাসে ইবাদতের প্রতি যতœবান হলে বাকি মাসগুলোতে ইবাদতের তাওফীক হয়। আর আশহুরে হুরুমে কষ্ট করে গুনাহ থেকে বিরত থাকতে পারলে অন্যান্য মাসেও গুনাহ পরিহার করা সহজ হয়। (আহকামুল কুরআন, জাসসাস ৩/১১১; )
এ মাসগুলোকে হুরুম বলা হয় এ কারণে যে, অন্যান্য মাসের নিষিদ্ধ কর্মের তুলনায় এ মাসের নিষিদ্ধ কর্ম অধিক দূষণীয়। আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘হে মুমিনগণ, আল্লাহর নিদর্শনসমূহ (নিষিদ্ধ বস্তু) হালাল মনে করো না এবং সম্মানিত মাসসমূহকে।’ (মায়েদা-২) অর্থাৎ আল্লাহ ত’আলার সংরক্ষিত, নিষিদ্ধ বস্তুসমূহ-যেগুলোকে তিনি সম্মান প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছেন এবং অনাধিকার চর্চা হতে বারণ করেছেন, সেগুলোকে তোমরা হালাল মনে করো না। যার ভেতর ভ্রান্ত বিশ্বাস, নিষিদ্ধ কাজ উভয়ই অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘এতে তোমরা নিজেদের উপর অত্যাচার (ক্ষতিসাধন) করো না।’ (সূরা তাওবা : ৩৬) অর্থাৎ সম্মানিত মাসগুলোতে। যেহেতু আল্লাহ তা‘আলা এ মাসগুলোকে বিশেষ সম্মানে ভূষিত করেছেন, তাই এর সম্মান যথাযথ রক্ষা করা এবং এর মর্যাদা ও পবিত্রতা লক্ষ্য করত: এতে কোন গুনাহে লিপ্ত না হওয়া বাঞ্চনীয়। তদুপরি জমানার পবিত্রতার কারণে অপরাধ হয় জঘন্য ও মারাত্মক। এ জন্যই আল্লাহ তা‘আলা উল্লিখিত আয়াতের মাধ্যমে নিজেদের উপর জুলুম না করার নির্দেশ দিয়েছেন। অন্যথায় স্বীয় নফসের উপর জুলুম করা বা অন্য কোন গুনাহে জড়িত হওয়া সব মাসেই হারাম ও নিষিদ্ধ।
মাহে রজবের ফযীলত: ‘জামে’উল কবীর’ গ্রন্থে মাহে রজব ও এ মাসের আমলসমূহের বহু ফযিলত উল্লেখ করা হয়েছে। তন্মধ্যে কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
এক. রাসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘রজব আল্লাহর মাস। শা’বান আমার মাস। আর রমযান হচ্ছে আমার উম্মতের মাস। রজব ওই মহান মাস, যাতে নেক কাজগুলোর সাওয়াব বহুগুণ বেশি দেওয়া হয়। যে ব্যক্তি এ মাসে একদিন রোযা রাখবে, তাকে গোটা বছরের রোযার মতো সাওয়াব দেওয়া হবে।’
দুই. ইমাম রাফে’ঈ সা’ঈদের বর্ণনা লিখেছেন, রজব নিঃসন্দেহে আল্লাহর মাস। সেটাকে বধির (আসাম্ম) এ জন্য বলা হয় যে, জাহেলী যুগেও লোকেরা এ মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ রাখতো এবং নিজেদের হাতিয়ার তুলে রাখতো। লোকেরা এ মাসে নিরাপদে-শান্তিতে থাকতো। সমস্ত রাস্তা নিরাপদ হতো। কেউ কারো ভয়ে ভীত থাকতো না। এ গোটা মাসেই নিরাপত্তা ও শান্তি পরিলক্ষিত হতো। ‘নিহায়াহ’য় উল্লেখ করা হয়েছে যে, আর যেহেতু এটা সম্মানিত মাস, সেহেতু মানুষের গুনাহকে সামনে রেখে এ মাসও ‘বধির’ বলে আখ্যায়িত হতে থাকে। [মা-সাবাতা বিস্সুন্নাহ ফী আইয়্যামিস সানাহ]
তিন. ইমাম বায়হাক্বী তাঁর ‘শু’আবুল ঈমান’-এ হযরত আয়েশা সিদ্দিক্বা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহার বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেছেন, ‘রজব ওই মহান মাস; যাতে আল্লাহ তা’আলা নেক কাজগুলোর সাওয়াব বহুগুণ বৃদ্ধি করে দান করেন। কুরআনের মর্যাদা সকল যিকির-আযকারের উপর যেমন রজব মাসের মর্যাদা অন্যান্য মাসের উপরও তেমন।’
মাহে রজবের দোয়া: রজব মাস আসলেই নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিম্নের দোয়াটি অধিকহারে পাঠ করতেন, ‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফী রাজাবিওঁ ওয়া শাবানা ওয়া বাল্লিগনা রামাযান।’ অর্থৎ- ‘হে আল্লাহ তুমি রজব ও শাবানে আমাদেরকে বরকত দাও। আর আমাদেরকে রামাযান পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দাও।’ (মুসনাদ আহমাদ ১/২৫৯)
রজব মাস রমযানের প্রস্তুতির মাস: রজব মাস থেকেই রমজানের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নেয়া হয়। আমাদের প্রিয় নবী রজব মাস থেকেই রমজানের জন্য মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন। এ মাসটি যেন অন্য সাধারণ মাসের ন্যায় মনে না কনি। আল্লাহ তা‘আলার কাছে পবিত্র জীবন কামনার সাথে সাথে আসন্ন রমযানে সুস্থ দেহ, মন ও সুন্দর জীবনের জন্য দোয়া করি। এ মাসে ইবাদত-বন্দেগীতে সততায়, ব্যবসা-বাণিজ্যে হালাল পথ অনুসরণ করার পাশাপাশি মসজিদগুলো আবাদ করতে হবে জামাতে নামাজের মাধ্যমে। তাহলেই কেবল পুণ্যময় মাসগুলোর (রজব, শাবান ও রমজানের) আগমন আমাদের জীবনে সফলতা বয়ে আনবে।
এ মাসে আমাদের করণীয়: এ মাসে আমাদের কিছু করণীয় রয়েছে। {১} অন্য সাধারণ সময়ের তুলনায় কুরআন-সুন্নাহ বর্ণিত রুটিন আমলসূহের ব্যাপারে এ মাসে অতিরিক্ত যতœবান হওয়া। {২} হারাম ক্রিয়াকর্ম পরিত্যাগে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া। {৩} যুদ্ধ-বিগ্রহ না করা। (সুত্র : সূরা বাকারা ২১৭) {৪} ঝগড়াঝাটি থেকে এ মাসে বিরত থাকার বিশেষ প্রচেষ্টা রাখা। {৫} মহানবী বলেছেন, রজব মাস হচ্ছে আমার উম্মতের ইস্তিগফার তথা ক্ষমা প্রার্থনার মাস। অতএব, এ মাসে অত্যধিক ক্ষমা প্রার্থনা কর। কেননা মহান আল্লাহ্ ক্ষমাশীল ও অত্যন্ত দয়ালু।
নফল রোযা: হযরত হাফসা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বলেন, ‘চারটি জিনিস রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনোই ছাড়তেন না। তা হলো; আশুরার রোযা, জিলহজ্বের প্রথম দশকের রোযা, প্রতি আরবি মাসে ৩টি রোযা ও ফজরের আগে দু’রাকাত সুন্নত নামায’ (নাসাঈ)। এ মাসের রোযার ফলে কবরের আযাব ও দোযখের আগুন থেকে নিরাপদ থাকা যায়। হাদীসে বর্ণিত আছে, ‘বেহেশ্তের মধ্যে একটি নহর আছে যার নাম রজব। তার পানি খুব সাদা এবং খুব ঠান্ডা ও মিষ্টি। যে ব্যক্তি রজবে রোযা রাখবে আল্লাহ পাক তাকে সেই নহর হতে পানি পান করাবেন।’ অন্য বর্ণনায় রয়েছে, ‘যারা রজবে বেশী বেশী রোযা রাখবে তাদের জন্য জান্নাতে প্রাসাদ রয়েছে।’
ঐতিহাসিক ঘটনার মাস: এ মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনের সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা ‘মি’রাজ’ সংঘটিত হয়েছিল। মি‘রাজ ইসলামের ইতিহাসে এমন কি পুরা নবুওয়াতের ইতিহাসেও এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। কারণ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব ও আল্লাহর প্রিয় রাসূল হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া অন্য কোন নবী এই সৌভাগ্য লাভ করতে পারেননি। আর এ কারণেই হুযুর-ই আকদাস সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শ্রেষ্ঠ নবী। এ মাসের ৬ (ছয়) রজব, ৬৩৩ হিজরী উপমহাদেশের মহান আধ্যাত্মিক স¤্রাট গরীব নাওয়ায হযরত খাজা মুঈনুদ্দীন চিশতী হাসান সানজারী আজমিরী রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ওফাত লাভ করেন। যাঁর বদৌলতে এ অঞ্চলের তথা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় কোটির কাছাকাছি সংখ্যক মানুষ ইসলামের ছায়াতলে এসে জাহান্নামের চিরস্থায়ী শাস্তি থেকে মুক্তি লাভ করেন। এ উপমহাদেশের বাসিন্দাদের কাছে গরীব নওয়ায রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু ‘মুহসিনে আযম’ হিসাবে সমাদৃত ও সর্বজন শ্রদ্ধেয়।
আসুন এই মর্যাদাপূর্ণ মাসটিকে আমরা ইবাদতে মশগুল থেকে আল্লাহ তা’য়ালাকে সন্তুষ্ট করার পাশাপাশি নিজেদেরকেও সওয়াবের অধিকারী করে তুলি। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সেই তাওফিক দান করুন, আমিন
লেখক : প্রাবন্ধিক