পবিত্র রমজানেও কি বাজারদরে আগুন লেগেই থাকবে?

11

পারভীন আকতার


পবিত্র রমজান মাস সিয়াম সাধনার মাস। এই মাসটি মুসলমানদের প্রাণে স্পন্দিত ইবাদতের মূল আকর্ষণ জাগায়।এ সময় নানাবিধ পবিত্র আয়োজনে শুরু হয়ে শেষ হয় ঈদ আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে। সারাদিন রোজা রেখে ইফতার ও ভোররাতের সেহেরির খাবার-দাবার সবকিছু খুবই যতœসহকারে ঠিকঠাক রাখতে চান মুসলমানগণ। এজন্য দরকার ক্রয় সীমার মধ্যে নিত্যপণ্যের দরদাম। এখন চাল থেকে শুরু করে আলু, ডাল পর্যন্ত এতো দাম হাঁকিয়ে বসে আছে আরতদার, মধ্যসত্ত¡ভোগী ও খুচরা বিক্রেতারা। সেখানে জনগণ যেন পাঠার বলি হচ্ছে সর্বদা। যতটা না আয় রোজগার বেড়েছে তার নয় গুণ বেড়েছে জীবনযাত্রা চলাচলের ব্যয়।এ দায় কে বা কারা নেবে?সবাই যেন নির্বিকার। দেখেও দেখে না আর শুনেও যেন শুনে না। কোন ভিতরকার সমস্যা সনাক্ত না করে উচ্চ মহলে শোনা যায় পৃথিবীতে যুদ্ধের দামামায়, মহামারীর কারণে এই নাখাল অবস্থা। কিন্তু তার আগেও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির রেসের ঘোড়ার দৌঁড় কোন অংশে কম ছিল না।সরকারী তদারকি, দায়িত্বশীলতার অভাবে প্রতিনিয়ত তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
উপরন্তু‘ অন্যান্য সেক্টরেও একটা মধ্য আয়ের দেশে নেই কোন গাড়ি ভাড়ার নির্দিষ্ট কানুন থাকলেও তা মানা হয় না নিরানব্বই ভাগ। ডিজেলে, অকটেন, পেট্রোল ও এলপি গ্যাস সবকিছুর দাম এখন আকাশ ছোঁয়া। ডলারের দাম বাড়ছে যেন পুরো পৃথিবীটা ডলারই নিয়ন্ত্রণ করছে। একপেশে রাজনীতির মতো অর্থনৈতিক বিষয়াদিগুলোও যেন এক কাতারে চলতে শুরু করেছে। আইন কানুন হয় কিন্তু তা মানার বালাই নেই। এক টাকা দিলে ‘হ্যা’ বলে আর দশ টাকা দিলে সাথে সাথে ‘হ্যাঁ’কে ‘না’ বলে দিতে কোন দ্বিধা সংকোচবোধ কাজ করে না এদেশের এক শ্রেণির নিম্ন রুচির মানুষ।
এদিকে আবার শহর ও গ্রামের মানুষের জীবনযাত্রার মানের বৈষয়িক বিষয়াবলি ভিন্নতর। গ্রামের মানুষের হয়তো বাসা ভাড়া লাগে না, নিজ ঘরে প্রায়ই মানুষ মাথা গুঁজার ঠাঁই পায়। কিন্তু শহরের মানুষ বিভিন্ন জায়গা থেকে আসা অস্থায়ী বাসায় প্রতিমাসে ভাড়া গুনতে হয় আকাশ ছোঁয়া। গ্রামে লেখাপড়ার খরচ, খাবার দাবার, চিকিৎসা ও অন্যান্য খরচা এখন তাও হাতের নাগালের বাইরে। কেবল নিজ বাড়ীতে বিনা খরচে থাকার নিশ্চয়তাটুকু আছে। শহরে বসবাসকারীদের ভাড়া বাসা থেকে নিত্যদিনের খাদ্যদ্রব্যাদি জোগাড় করে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার খরচা জোগাড় করতে নিদারুণ হিমশিম খেতে হচ্ছে। আট সদস্য বিশিষ্ট পরিবারে মাসিক ৫০ হাজার টাকা বেতনেও যেন সংসার চলে না। বেতনতো বাড়ে না কিন্তু খরচা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।
আসন্ন পবিত্র রমজান মাসে মধ্যবিত্ত ও নিন্মবিত্তের আর্থিক ও মানসিক চাপ থাকবে প্রচুর। এরা না পারবে কাউকে কিছু বলতে বা চাইতে। অন্ততঃ চাল, ডাল, ডিম, সবজি, ছোলা ও মুড়ির দাম কমালেও তাদের রোজা পালন করা অসুবিধা হতো না। মাছ, মাংস, ফলফলাদি ও দুধের কথা বাদই দিলাম। গরীবদের এতো পুষ্টির খাবারের গন্ধ নিতে নেই। উচ্চ মহল তথা ধনী শ্রেণীর এতে কোন মাথা ব্যথা নেই কারণ তারা তো এই আর্থিক দূর্দশায় কখনো পড়ে না।ঋণ খেলাপী হলেও তা মওকুফ হয়ে যায় বিভিন্ন চেষ্টা তদবীরে। কালো টাকা সাদাও হয়ে যায়।কিন্তু গরীবের পোড়া কপাল পুড়ে অঙ্গার হয় সারাবছর।
এদেশের কিয়দংশ মানুষের তথ্য সরবরাহের বিভ্রাট প্রচুর। সঠিক তথ্য ও তত্ত¡ যদি মাঠ পর্যায় থেকে সরকারের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে যেতো তাহলে আসল ঘাটতি কোথায় তা সহজে নিরূপণ করা যেতো। কিন্তু নিজের আমিত্বকে শ্রেষ্ঠ করতে এদেশের মানুষ মরিয়া ফলে উন্নয়ন হয় ধীর গতিতে।ভিতরের ছিদ্রগুলো অনাবৃত থেকেই যায়। সরকারি তদারকি ও দায়িত্ব এখন নিন্মবিত্ত, দিনমজুর ও মধ্যবিত্তের জন্য রেশনিং পদ্ধতি চালু করা।এটি হতে হবে জাতীয় নীতিমালার একটি শক্তশালী পদক্ষেপ। এতে কোন আপোষ নয়।সরকার যখন প্রান্তীয় পর্যায় থেকে ধান, চাল, ডাল কিংবা কৃষিজ উৎপাদিত দ্রব্যাদি কৃষকের কাছ থেকে ন্যায্য মূল্যে কিনে নিয়ে স্টক করবে তখন আরতদার কিংবা মধ্যস্বত্ত¡ভোগীরা আর কোন বাড়তি সুযোগ নিতে পারবে না। এতে খুচরা বাজারও নিয়ন্ত্রণে এসে যাবে।
প্রতিটি দোকান, বাজারে নির্দিষ্ট বিক্রয়মূল্য তালিকা ঝুলিয়ে দিতে হবে যা হবে শহর কিংবা গ্রামে এক ও অভিন্ন। বাড়তি মজুদের খরচা সরকারী অর্থ সহায়তা বা ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে সামঞ্জস্য করতে হবে। বন্যা, খরা কিংবা অতি বৃষ্টি, মহামারীর পরিস্থিতি, বিশ্বের নানা জায়গা, দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করলেও সততা সম্বলিত নীতিতে অটল চললে তা একটি দেশের জনগণকে সুখে শান্তিতে রাখতে সহায়তা করে। সমস্যা থাকবে কিন্তু তার সমাধানও আছে। কিন্তু সমস্যাকে আস্কারা দিয়ে জনগণকে চাপে ফেললে তা জাতীয় উন্নয়নকে চরম বাঁধাগ্রস্ত করে।
গণতান্ত্রিক দেশে জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। তারা সুখের দেখা পেলে অরাজকতা, দলাদলি আর বৈষম্য অনেকটা কমে যাবে। নির্ভাবনায় অল্প খেয়ে পরে চলেও এদেশের মানুষ শান্তির পরিবেশে থাকতে পছন্দ করে। তাহলে কি এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের অধিকার নেই যে সামনের রোজার দিনগুলো সাধ্যসীমার মধ্যে অল্প খরচে জীবনযাপন করার? ঈদ এলে কি ইচ্ছে হয় না যে নতুন জামা কাপড় কিনে দিয়ে সন্তান, মা বাবা, ভাই বোনের মুখের প্রশান্তির হাসি দেখার? বিষয়গুলো খুব সাধারণ। এবং তা ক্রয় সীমার মধ্যে থাকলে কেন দেশের মানুষ শান্তি পাবে না? এতটুকু আশা করা কি এদেশের মানুষের অন্যায্য, অন্যায় চাওয়া?
দ্রব্যমূল্যের অচিরেই দাম কমানো হোক। শান্তিতে মানুষ পবিত্র রমজান মাসসহ সারাবছর সুখে থাকুক। বিশ্বের অন্যান্য দেশে রমজান এলেই প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্যছাড় দেয়া হয় মহান আল্লাহর কৃপা ও সওয়াবের উদ্দেশ্যে। এদেশেও যেন এই মহৎ মানবিক সংস্কৃতির চালু হয় এই কামনা করি।
লেখক : শিক্ষক, কবি ও প্রাবন্ধিক