পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) আজ

44

 

আবু তালেব বেলাল

ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়।/ আয় রে সাগর আকাশ বাতাস দেখ্বি যদি আয়।/ ধূলির ধরা বেহেশ্তে আজ, জয় করিল দিল রে লাজ।/ আজকে খুশির ঢল নেমেছে ধূসর সাহারায়।
আজ রবিবার, ১২ রবিউল আওয়াল, পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)। যথাযোগ্য ধর্মীয় মর্যাদা ও উৎসবমুখর পরিবেশে সারাদেশে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্যাপিত হচ্ছে।
মনবতার মুক্তির দূত, দুই জাহানের কান্ডারী, প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর পৃথিবীতে শুভাগমনের এ দিনটি বাংলাদেশসহ বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে উদ্যাপন করে থাকেন।
আজ কোরআনখানি, খতমে বুখারী, খতমে মজমুয়ায়ে সালাওয়াতে রাসুল, মিলাদ মাহফিল, জিকির, ওয়াজ-নছিহত, নবীজির (সা.) জীবন চরিতের উপর আলোচনা, গরীব-মিসকিনদের মাঝ্যে খাবার বিতরণ ও জশনে জুলুসসহ (বর্ণাঢ্য র‌্যালি) বিভিন্ন ইবাদত-বন্দেগির মধ্যদিয়ে দিনটি উদযাপন করা হচ্ছে।
পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। এসব বাণীতে তাঁরা মহানবী (সা.)-এর জীবনাদর্শ অনুসরণ করে ভ্রাতৃত্ববোধ ও মানবকল্যাণে ব্রতী হওয়ার জন্য সবার প্রতি আহবান জানান।
বাংলাদেশ সরকার দিনটিকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করেছে। এদিন বিভিন্ন সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত ও বেসরকারি অফিস, আদালত, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন, আলোকসজ্জা, ইসলামি সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, মিলাদ, আলোচনা সভা ও মাহফিল আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছে বিভিন্ন সংস্থা, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান। এতে দেশ-জাতি ও বিশ্ব মানবতার কল্যাণ কামনা করে দোয়া ও মোনাজাত করা হবে।
পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্যাপন উপলক্ষে আজ দেশের সবচেয়ে বড় জশনে জুলুস হবে বার আউলিয়ার পুণ্যভূমি চট্টগ্রামে। আনজুমানে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনায় জুলুসটি নগরীর ষোলশহর খানকাহ-এ আলিয়া কাদেরিয়া সৈয়্যদিয়া তৈয়্যবিয়া (আলমগীর খানকাহ) থেকে বের হবে। আওলাদে রাসূল, রাহনুমায়ে শরিয়ত ও তরিকত আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তাহের শাহ (মজিআ) এ জুলুসে নেতৃত্ব দিবেন। এছাড়া আওলাদে রাসুল আল্লামা পীর সৈয়দ মুহাম্মদ সাবির শাহ, শাহজাদা আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ কাশিম শাহ জুলুসে প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথি হিসেবে অংশ নেবেন।
আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট এবং মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী সকাল ৯টায় এ জুলুস বের হবে। এটি নগরীর বিবিরহাট, মুরাদপুর, পাঁচলাইশ, চকবাজার, প্যারেড কর্নার, চট্টগ্রাম কলেজ, গণী বেকারি মোড়, জামালখান মোড়, আসকারদীঘির পাড়, কাজীর দেউড়ি, আলমাস, ওয়াসা, জিইসি, ২নং গেট ও মুরাদপুর হয়ে জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া কামিল মাদ্রাসা সংলগ্ন জুলুস ময়দানে গিয়ে শেষ হবে।
এখানে আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তাহের শাহ’র (মজিআ) সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হবে মিলাদুন্নবী (সা.) মাহফিল। মাহফিলে আল্লামা পীর সৈয়দ মুহাম্মদ সাবির শাহ, শাহজাদা আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ কাশিম শাহ, দেশবরণ্য ওলামায়ে কেরামসহ মন্ত্রী, মেয়র, সংসদ সদস্য, প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পেশার শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ উপস্থিত থাকবেন। বাদে জোহর আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে দেশ-জাতি, বিশ্ব মুসলিম ও বিশ্ব মানবতার কল্যাণ কামনা করে জুলুসের সমাপ্তি ঘোষণা করা হবে।
এদিকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ’র ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগের পক্ষ থেকে জুলুস চলাকালীন ডাইভারসন রোড ও জুলুস রোডের মানচিত্র প্রকাশ করে সুষ্ঠুভাবে জুলুস সম্পন্ন করতে গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণে এক নোটিশ জারি করেছে। এতে বলা হয়, জুলুস চলাকালে নগরীর মেডিক্যাল থেকে অলিখাঁ রোডের মুখ, তেলিপট্টি মোড়, চকবাজার থানা রোডের মুখ, সিজিএস স্কুল মোড়, প্যারেড কর্নার, গণি বেকারি মোড়, জামালখান মোড়, নুর আহা¤মদ সড়কের মুখ, স্টেডিয়াম গোল চত্ত¡র, আলমাস সিনেমা মোড়, এসএইচ খান ফিলিং স্টেশন, পল্টন রোডের মুখ ও শিল্পকলা একাডেমি রোডের মুখে রোডব্লক স্থাপনের মাধ্যমে ডাইভারশন প্রদান করা হবে। এভাবে জুলুস অভিমুখে সব ধরনের যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা হবে।

নগরজুড়ে সাজ সাজ রব : আকাশে রবিউল আওয়াল মাসের চাঁদ দেখা যাওয়ার সাথে সাথে সাজ সাজ রব উঠে নগরজুড়ে। লাল, নীল, হলুদ, সবুজ নানা রঙের বাতির ঝলকে নগরীর রাজপথ, উড়াল সড়ক, অলিগলি সবখানে ঝলমল করছে। উড়ছে কলেমা লেখা চাঁদ-তারকা খচিত সবুজ ও বিভিন্ন রঙের পতাকা। মোড়ে মোড়ে নির্মাণ করা হয়েছে সুসজ্জিত-সুদৃশ্য তোরণ। যেখানে লেখা রয়েছে ‘আস্সালাতু আস্সালামু আলাইকা ইয়া রাসূলাল্লাহ’, ‘আহলান সাহলান ইয়া মাহে রবিউল আউয়াল’।
ঐতিহাসিক জশনে জুলুসকে ঘিরে সর্বস্তরের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মাঝে বিরাজ করছে ঈদের আনন্দ। নগরীর প্রতিটি মোড়ে শোভা পাচ্ছে আনজুমান লোগো খচিত চতুর্ভুজ ডিজাইনের ফেস্টুন, নানা রঙের ব্যানার। যেখানে কোরআন-হাদিসের বাণী, জশনে জুলুসের প্রবর্তক গাউস জামান আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ’র (র.) বাণী শোভা পাচ্ছে। জামেয়া সংলগ্ন জুলুস মাঠে নির্মাণ করা হয়েছে বিশাল প্যান্ডেল, মঞ্চ।
জুলুস প্রস্তুতি কমিটির আহব্বায়ক আনজুমানের অ্যাডিশনাল সেক্রেটারি জেনারেল আলহাজ সামশুদ্দিন বলেন, জুলুস উপলক্ষে একটি কেন্দ্রীয় প্রস্তুতি কমিটি এবং এর অধিনে ১৫টি উপ-কমিটি করা হয়েছে। কমিটির প্রত্যেক সদস্য নিরলস পরিশ্রমের মাধ্যমে জুলুসের যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। আন্জুমান, গাউসিয়া কমিটির পাশাপাশি আনজুমানের নিজস্ব সিকিউরিটি ফোর্স (এএসএফ), সিটি কর্পোরেশন, জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, র‌্যাবসহ সরকারের সকল গোয়েন্দা সংস্থা জুলুসের সার্বিক শৃঙ্খলা রক্ষা ও নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
এ বিষয়ে গাউসিয়া কমিটি নগর শাখার সাধারণ সম্পাদক ও আনজুমান সিকিউরিটি ফোর্সের পরিচালক মাওলানা আবদুল্লাহ জানান, এ বছরও এএসএফ-এর সাড় তিনশ ফোর্স এবং গাউসিয়া কমিটির পাঁচ হাজার স্বেচ্ছাসেবক জুলুসের শৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকবেন। নগরীর প্রতিটি মোড়সহ জামেয়ার আশেপাশে জুলুসে আগত মুসল্লিদের যাতে কোন রকম কষ্ট না হয় সেদিকে নজর রাখছেন।
অন্যদিকে গত সপ্তাহে দামপাড়া পুলিশ লাইনের সিএমপির সম্মেলন কক্ষে আনজুমান ট্রাস্ট নেতৃবৃন্দের সাথে বৈঠক করেন সিএমপি কমিশনার কৃঞ্চপদ রায়। বৈঠকে সিএমপি কমিশনার বলেন, পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে রবিবার নগরীতে জশনে জুলুস ঘিরে পুলিশ বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে। এতে কেউ যেন ব্যাগ বা পোটলা নিয়ে অংশ নিতে না পারে, কোন বিশৃঙ্খলা যাতে না হয়- সেই বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হবে। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের অতিরিক্ত সদস্য মোতায়নে নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা জনিত যেকোন জরুরি সেবা পেতে ৯৯৯-এ যোগাযোগ করার আহবান জানান তিনি।
এছাড়া পাঁচলাইশ থানা কর্তৃপক্ষের সাথেও আনজুমানের জুলুস প্রস্তুতি কমিটির বৈঠক হয়। এতে জুলুসের সার্বিক নিরাপত্তাসহ সব বিষয়ে আলোচনা হয়।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবি : পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উদ্যাপনের ইতিহাস দীর্ঘ হলেও জশনে জুলুসের আয়োজন খুব বেশিদিনের নয়। ১৯৭৪ সালে সর্বপ্রথম এ জুলুসের সূচনা হয়।
গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ’র যুগ্ম মহাসচিব এড. মোছাহেব উদ্দিন বখতিয়ার জানান, ১৯৭৪ সালে গাউসে জামান আল্লামা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়ব শাহ’র (র.) লিখিত নির্দেশে নগরীর কোরবানীগঞ্জের বলুয়ারদীঘি খানকায়ে কাদেরিয়া সৈয়দিয়া তৈয়বিয়া থেকে ১২ রবিউল আউয়াল জশনে জুলুস বের করা হয়। প্রতিবছর ধারাবাহিকভাবে এ জুলুস আয়োজন করে আসছে আনজুমান এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট। বছর বছর এ আয়োজন আরো সম্প্রসারণ হচ্ছে, হচ্ছে বর্ণাঢ্য। বাড়ছে লোক সমাগম।
আনজুমান ট্রাস্ট’র দাবি, পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে আয়োজিত জশ্নে জুলুস বিশ্বের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় র‌্যালি। এতে ৪০ থেকে ৫০ লাখ মানুষের সমাগম হয়। তারা এ জুলুসকে রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যাপনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবে সর্ববৃহৎ ধর্মীয় র‌্যালি হিসাবে স্বীকৃতিরও দাবি করে আসছেন। এবার এ দাবি আরো জোরালোভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
আনজুমানের সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির প্রধান উপদেষ্টা পিএইচপি ফ্যামিলির চেয়ারম্যান সুফি মিজানুর রহমান এবার জুলুছে ৬০ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান অংশ নেবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, বিশ্বের আর কোন ধর্মীয় র‌্যালিতে এত ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় না। আশা করি, র‌্যালিটি গিনেসবুকে স্থান পাবে।
আনজুমান ট্রাস্টের সেক্রেটারি জেনারেল আনোয়ার হোসেন বলেন, এবার হুজুর কেবলা দীর্ঘ দুই বছর পর উপস্থিত হয়ে জুলুসে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সঙ্গতকারণে এবার লোকসমাগম অন্য যেকোন জুলুসের চেয়ে বেশি হবে।
ট্রাস্টের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মহসিনকে বলেন, চট্টগ্রামের মত এতবড় জুলুস বিশ্বের কোথাও হয় না। সুতরাং বিশ্বের অদ্বিতীয় এ জুলুস গিনেসবুক অব ওয়ার্ল্ড-এ স্থান করে নেবে- এটি শুধু প্রত্যাশা নয়; এজন্য ইতোমধ্যে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে; যারা সরকার, ইউনেস্কো ও আন্তর্জাতিক লবিস্টের সাথে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এছাড়া এবার জুলসে আন্তর্র্জাতিক পর্যায়ের কিছু মিডিয়াকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তাদের প্রতিবেদনে চট্টগ্রামের নতুন ইতিহাস উঠে আসবে। এজন্য দেশের সরকার, সাংবাদিক ও চট্টগ্রামবাসীর সহযোগিতা কামনা করছি। কারণ এটি চট্টগ্রামের জন্য আরেকটি ইতিহাস গড়ার সুযোগ।
পবিত্রতা ও খুশীমনে জুলুসে শরিক হোন : দরবারে আলিয়া সিরিকোট শরীফের সাজ্জাদানশীন পীর সৈয়দ মুহাম্মদ সাবির শাহ বলেন, ঈদ মানে আনন্দ। যার উসিলায় আমরা ইসলাম ও শরীয়ত পেয়েছি, কোরআন ও হাদিস পেয়েছি, দুই প্রধান ঈদ পেয়েছি, সেই মানবতার নবী (সা.) যেদিন এ দুনিয়াতে এসেছেন, সেই দিনই হচ্ছে সেরা ঈদ।
গত শুক্রবার রাতে জামেয়া ময়দানে অনুষ্ঠিত রহমাতুল্লিল আলামিন কনফারেন্সে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। তিনি বলেন, হুজুর কেবলা তৈয়ব শাহ’র (র.) মাধ্যমে আমরা জুলুস পেয়েছি। আল্লাহর পক্ষ থেকে এটি আমাদের জন্য বড় নিয়ামত।
গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশের চেয়ারম্যান পেয়ার মুহাম্মদ বলেন, পবিত্রতার সাথে খুশী ও আনন্দ সহকারে জুলুসে অংশগ্রহণ করবেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা- এমনটি কামনা করছি। তিনি চট্টগ্রামবাসীসহ সর্বস্তরের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে ঈদে মিলাদুন্নবীর শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন এবং জুলুসকে সফল করার আহবান জানান।