পবিত্র ঈদুল আযহা ও সময়ের কথা

77

এমরান চৌধুরী

আগামী ১ আগস্ট পবিত্র ঈদুল আযহা। মুসলিম সমাজের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব। এ বছর পরপর দুটো উৎসব এমন এক সময়ে পড়েছে যখন প্রত্যেক মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা নানাভাবে বিপর্যস্ত। কারও চোখে মুখে এক চিলতে হাসি নেই, জোয়ান বুড়ো, অশীতিপর সবার প্রতিপদে অনিশ্চয়তা। এই যেন চোখ বন্ধ করে হাঁটা, যেকোন সময় কারও সঙ্গে ধাক্কা লেগে ছিটকে পড়ার কিংবা কোনো খানাখন্দকে পড়ার সমুখ সম্ভাবনা। তবু জীবন থেমে থাকে না। কারণ জীবনের আরেক নাম নদী। নদীর স্রোত কোথাও কোথাও গিয়ে বাধাপ্রাপ্ত হয় বটে কিন্তু থমকে পড়ে না। সোজা চলতে না পারলে এঁকেবেঁকে চলে। ছোটবেলায় পড়া সেই নদীটির মতন- আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে।
জীবনও তাই। কখনো সরলরেখায়, কখনো বক্ররেখায় চলে। তাই শিক্ষিত মানুষমাত্রই বলেন, জীবন পুষ্পশয্যা নয়। কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় জীবন তথা জগৎ সংসারকে সমরাঙ্গনের সাথে তুলনা করেছেন। তিনি তাঁর জীবন সঙ্গীত কবিতায় লিখেছেন, ‘ সংসার সমরাঙ্গনে / যুদ্ধ করো দৃঢ় পণে/ ভয়ে ভীত হইও না মানব। তাই করোনাকালেও নানা ঝুঁকির মধ্যেও মানুষকে তার প্রাত্যহিক কাজকর্ম চালিয়ে যেতে হয়, চালিয়ে যেতে হবে। স্মরণাতীতকালের মধ্যে গত ঈদুল ফিতর ছিল এমন এক ব্যতিক্রমী ঈদ যাতে ঈদের কোনো আবহ ছিল না। হাজার বছর ধরে চলা আসা ঈদগাহের বা ঈদের দিনের কোনো চিরায়ত দৃশ্য চোখে পড়েনি। ‘সবার দুয়ার খোলা আজি / কোথাও নেই মানা / খাঞ্জা ভরে বিলাব আজ / নানা রকম রকম খানা। কিংবা রাজা-উজির, ছোট বড় ভেদাভেদ ভুলে কোলাকুলি, মোলাকাতের মতো মনোরম কোনো ছবি কারও চোখে পড়েনি। দেখা যায়নি ছোটদের হৈ হুল্লোড় কিংবা বাহারি পোশাক পরে টুপ করে কদমবুচি করে ঈদীর আবদার। ছিল না কবরস্থান বা গোরস্থানকে ঘিরে স্বজনদের আনাগোনা। কাতর স্বরে পরলোকগত প্রিয়জনদের জন্য দোয়া কামনা। কারণ জীবন যেখন সংকটে সেখানে আনন্দ দূরে থাক প্রতিটি পদক্ষেপই ফেলতে হয় অতি সন্তর্পণে। আগে জীবন বাঁচাও, তারপর আনন্দ-ফূর্তি, এই হলো সময়ের সারকথা।
এই অবস্থায় আগামী শনিবার পালিত হবে ঈদুল আযহা বা কোরবানির ঈদ। আমরা জানি, কোরবানি শব্দের অর্থ ত্যাগ, উৎসর্গ বা নৈকট্য। এই তিনটি শব্দের মধ্যেই কোরবানির মূল অর্থ আর বিস্তৃত ব্যাখা সবকিছু নিহিত রযেছে। আমরা যদি চোখ কান আর নিজের বিবেককে খোলা রেখে বুঝার চেষ্টা করি তাহলে পরিস্কার হয়ে যায় ব্যাপারটা। কার জন্যে আমরা ত্যাগ করব? কী উৎসর্গ করব? কার নৈকট্য লাভের জন্য করব? এক কথায়, পরম করুণাময় আল্লাহতাআলার নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে নিজেকে উৎসর্গ বা মুসলমানদের ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত করাই কোরবানির উদ্দেশ্য। আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআন শরীফ এর সূরা হজ এর ৩৭ সংখ্যক আয়াতে বলেছেন, ‘আল্লাহর নিকট সেগুলোর (কোরবানি পশুর) গোশত এবং রক্ত কিছুই পৌঁছায় না, পৌঁছায় শুধু তোমাদের তাকওয়া।’ মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্বের পাশাপাশি পশুত্বও বিদ্যমান। কোরবানির মাধ্যমে পশুত্বকে পরিহার করে মনুষ্যত্বকে জাগিয়ে তোলা হয়। মানুষের মধ্যে লোভ-লালসা, হিংসা বিদ্বেষ, অহংকার ইত্যাদি পাশবিক চরিত্র বিসর্জন দিয়ে মানবীয় গুণাবলি উজ্জীবিত করা মধ্যেই রয়েছে কোরবানির সার্থকতা। এই কোরবানির পেছনে রয়েছে আল্লাহর নবি হযরত ইবরাহীম (আ) ও হযরত ইসমাইল (আ)-এর অতুলনীয় ধৈর্য্য, নিষ্ঠা ও অপূর্ব ত্যাগের পুণ্যময় স্মৃতি। কোরবানি দ্বারা মুসলিম মিল্লাত ঘোষণা করে, একমাত্র আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টির জন্য তাঁরা তাঁদের জানমাল সবকিছু উৎসর্গে যে কোনো সময় প্রস্তুত।
তবে যে লক্ষ্য কিংবা উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আমরা কোরবানি করি বাস্তব জীবনে তার কতটা প্রতিফলিত হয় তা ভাবনার বিষয়। গরু কেনা থেকে জবাই পর্যন্ত চলে এমন এক প্রতিযোগিতা যা পবিত্র ঈদুল আযহার মাহাত্ম্যকে ¤øান করে দেয়। গরু, মহিষ, ছাগল, দুম্বা, উট , এই সব গৃহপালিত হালাল পশু কোরবানি করা যায়। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে কোরবানির জন্য কেনা গরু বা ছাগল যা-ই কেনা হোক না কেন পশুটি যেন হয় নিখুঁত, সুন্দর ও সুস্থ। কোনো অসুস্থ, দেখতে সুন্দর লাগে না এ রকম পশু কোরবানির জন্যে অনুপযুক্ত। এখানে পশুর আকার কোনো বিবেচনার বিষয় নয়। কিন্তু আমাদের সমাজে তাই হয়ে থাকে। কে কত বড় গরু কিনতে পারল তা নিয়ে শুরু হয় গ্রামে গ্রামে, শহরে নগরে গঞ্জে বিত্তবানদের মধ্যে প্রতিযোগিতা। এই গরু কিনে যখন শহরের রাস্তা বা গ্রামের পথ ধরে নিয়ে যাওয়া হয় তখন আশপাশের কৌতূহলী মানুষ জানতে চায় গরুর দাম। অর্থাৎ গরুটি কত দামে কেনা হয়েছে? যে লোক বা লোকেরা গরুটিকে নিয়ে যায় তাদের জবাব দিতে দিতে কাহিল হতে হয়। আবার কোনো কোনো বিত্তবান একাধিক গরু কোরবানি দিয়ে থাকেন। তাঁদের এই কোরবানি যতটা আল্লাহকে খুশি করার জন্যে, তারচেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়ে থাকে লৌকিকতা। এই সুবাদে কিছু গরিব আর অভাবী মানুষ দুএকদিন ভালো খেলো বটে, তবে কোরবানিদাতার অন্তরে থাকে অন্য বিষয়, যা তাৎক্ষণিকভাবে বোঝা যায় না। যখন ভোটের হাওয়া বইতে শুরু করে তখন দেখা যায় আসল রূপ। অবশ্য সমাজে ব্যতিক্রমী মানুষ যে নেই তা কিন্তু নয়। যাঁরা নিজেদের বিলায় অলক্ষ্যে, অগোচরে, কোনো ঢাকঢোল না পিটিয়ে।
কোরবানির গোশতকে সমান তিন ভাগ করে আত্মীয় স্বজন ও গরিব মানুষের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এই বিলিয়ে দেওয়ার কথা বলে কোরবানিদাতার অন্তরে ত্যাগের বীজ বপন করার পাশাপাশি যারা কোরবানি দিতে পারেনি তাদের ঘরে আনন্দের বার্তা পৌঁছানোর প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। কারণ একটি সমাজে সব লোক কোরবানির করার সামর্থ্য রাখেন না। তা সম্ভবও নয়। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে গত বছর পর্যন্ত প্রতি সাতটি পরিবারের মধ্যে একটি পরিবার কোরবানির করার সামর্থ্য রাখত। বর্তমান করোনাকালে এই সামর্থ্য কোথায় গিয়ে ঠেকেছে তা অনুমান করাও কঠিন। একটানা লকডাউন, জীবন ও জীবিকার অনিশ্চয়তা সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশের মানুষেরও বিত্তের পরিবর্তন ঘটেছে। এই কদিন আগেও যাদের অবস্থান তিনবেলা খাওয়ার পর্যায়ে ছিল তাদের কারও এখন সে অবস্থা নেই। এখন নিম্ন মধ্যবিত্তরা দিনে এনে দিনে খাওয়া মানুষে পরিণত হয়েছে। আর যারা দিনে এনে দিনে খেত তাদের অবস্থা যে কী তা বলাই বাহুল্য। তাছাড়া দেশের একটি অংশ পানির নিচে তলিয়ে আছে অনেকদিন ধরে। এ যেন মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। বন্যা কবলিত লক্ষ লক্ষ মানুষ এখন মাথা গোঁজার ঠাঁইহারা, খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানীয়জলের অভাবে সেখানে যে কোনো সময় ছড়িয়ে পড়তে পারে নানা পানিবাহিত রোগ। একদিকে করোনা ভাইরাস অন্যদিকে বন্যা মানুষের জীবনটাকে করে তুলেছে একেবারে দুর্বিষহ। এই অবস্থায় বন্যা কবলিত এলাকার মানুষ কোরবানি দিতে পারার কথা নয়। আর সারা দেশের প্রতি একহাজার পরিবারের মধ্যে একটি পরিবারের বেশি কোরবানি করতে পারবে বলে মনে হয় না।
তাই আসুন এবার আমরা ডিপ ফ্রিজে গোশত রেখে বেশিদিন ধরে খাওয়ার মানসিকতা পরিহার করি। ঈদুল আযহার শিক্ষায় উজ্জীবিত হই। নিজ নিজ অন্তরকে খোলা আকাশের মতো উদার করি। নিজের পাতের দিকে না তাকিয়ে আমাদের আশেপাশের প্রতিবেশির দিকে তাকাই। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে সামাজিক ও মানবিক দায়িত্ব পালনে তৎপর হই। প্রতিবেশি ও আত্মীয় স্বজনের খোঁজ খবর নিই এবং তাঁদের কাছে যাঁর যাঁর সামর্থ্য অনুযায়ী কোরবানির গোশত পৌঁছে দিয়ে তাঁদেরও ঈদুল আযহার আনন্দে শরিক করি। মনে রাখতে হবে, বিপদগ্রস্ত মানুষের সেবায় এক গøাস পানি নিয়ে যিনি এগিয়ে আসেন তাঁকে ঠিকই মানুষ মনে রাখে। দুর্দিনে দুর্বিপাকে তথা মহামারির মতো সময়ে যাঁরা উদার হস্তে মানুষের সেবা করছেন তাঁদের কথা মনে রাখবে না এমন অকৃতজ্ঞ মানুষ একজনও নেই বলে আমাদের বিশ্বাস।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক