পবিত্র আশুরা : তাৎপর্য ও শিক্ষা

16

সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী

আরবী বছরের প্রথম মাস মুহররম। আরবী বারটি মাসের মধ্যে যে চারটি মাসকে ‘ধাশহুরুল হুরুম’ তথা পরম সম্মানিত মাস বলে কোরআন শরীফ ও হাদীছ শরীফ-এ ঘোষণা করা হয়েছে, মুহররম মাস এ চতুষ্টয়ের অন্যতম। আল্লাহতা’আলা এরশাদ করেন : “ নিশ্চয় আল্লাহর বিধান ও গণনায় মাস বারটি, আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। তন্মধ্যে চারটি সম্মানিত। এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান; সুতরাং এর মধ্যে তোমরা নিজেদের প্রতি অত্যাচার করোনা। (সূরা আল-তাওবাহ : ৩৬)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, বারো মাসে বছর, তার মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। তিনটি ধারাবাহিক: যিলক্বদ, যিলহজ্ব, মুহররম আর চতুর্থটি হল রজব; যাজুমাদাল উখরা ও শাবান মাসের মধ্যবর্তী মাস। (বুখারি : ২৯৫৮, মুসলিম : ১৬৭৯)
আসমান-যমীন সৃষ্টিকাল হতেই এ মাসটি বিশেষ ভাবে সম্মানিত হয়ে আসছে। এ মাসের ফযিলত বর্ণনা করতে গিয়ে হযরত আলীর দ্বিয়াল্লাহুতায়ালা আনহু বলেন: “ মুহররম মাস হচ্ছে সমস্ত মাসের সরদার।” (ফাতহুল বারী: ৪/৭৭০, কাশফুল খিফা : ১/৪৫৯)
এ মাসেরই দশ তারিখ অর্থাৎ ১০ই মুহররম ‘আশুরা’র দিন, মুহররম মাসের শ্রেষ্ঠতম দিন। দিনটি বিশ্বব্যাপী এক আলোচিত দিন।
আশুরার নামকরণ : আশুরা’র নাম করণের বিষয়ে উলামায়ে কেরাম বিভিন্নমত পোষণ করেন। তবে অধিকাংশ উলামায়ে কেরাম বলেন, এ দিনটি মুহররম মাসের ১০ তারিখ বলেই এাঁর নাম ‘আশুরা’ হয়েছে।
আ’শুরা ও তাসূয়া’ দুটিপ্রসিদ্ধ নাম, আ’শুরা হলো মুর্হরমের দশম তারিখ আর তাসূয়া’ হলো- নবম তারিখ।” (কাশ্শা ফুল ক্বান্না ২/১৮)
কোন কোন আলেম বলেন, আল্লাহপাক উম্মতকে যে দশটি বুযূর্গ ও সম্মানিত দিন উপহার দিয়েছেন, তন্মধ্যে আশুরার দিনটি ১০ম স্থানীয়। এ কারণেই এটির নাম ‘আশুরা’ রাখা হয়েছে। আবার কারো মতে, এই দিনটিতে যেহেতু আল্লাহপাক স্বীয় দশজন নবীকে ১০টি ভিন্ন ভিন্ন রহমত ও নেয়ামত দান কওে ছিলেনতাই এটির নাম আশুরা।
আশুরার দিনের বরকতময় ঘটনা সমূহ :
সৃষ্টির সূচনা হয় এই দিনে এবং সৃষ্টির সমাপ্তিও ঘটবে এ দিনেই। বিশেষ বিশেষ সৃষ্টি এ দিনেই করা হয়েছে এবং বিশেষ বিশেষ ঘটনা এ দিনেই সংঘটিত হয়েছে।
হযরত আদম আলাইহি সসালাম থেকে শুরু করে আখিরীর সূলহুযূর পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত প্রায় সকল নবী-রসূল আলাইহি মুসসালামের উল্লেখযোগ্য কোনো না কোনো ঘটনা এ দিনে সংঘটিত হয়েছে। সঙ্গত কারণেই এ দিনটি সবার জন্য এক মহান আনুষ্ঠানিকতার দিন, সাথে সাথে রহমত, বরকত ও মাগফিরাত হাছিল করার দিনও। এ আশুরার দিনে অসংখ্য ঘটনা সংঘটিত হয়েছে- যা সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করা হলো:
* মহান আল্লাহ পাক এই মুহররমের ১০ তারিখে পৃথিবীর সূচনা করেন।
* এ দিনে আমাদের প্রিয় নবীর নূও মুবারক অস্তিত্বে আসে।
* আশুরার দিন শুক্রবার ক্বিয়ামত সংঘটি তহবে।
* এদিনে হযরত আদম আলাইহিস্সালামের দোয়া কবুল করা হয়।
* এদিনে হযরত ইদ্রিস আলাইহিস্সালামকে সম্মানিত স্থানে তথা আকাশে তুলে নেয়া হয়।
* এদিনে হযরত নূহ আলাইহিস্সালাম এবং তাঁর সঙ্গী-সাথীদের আল্লাহ পাক মহা প্লাবন থেকে মুক্তি দেন।
* আল্লাহ পাক এদিনে হযরত মূসা আলাইহিস্সালামের সাথে কথা বলেন এবং তাঁর উপরতা ও রাত শরীফ নাযিল করেন।
* এদিনে হযরত মুসা আলাইহিস্সালাম ও তাঁর অনুসারীদের জন্য আল্লাহ পাক সাগরের উপর দিয়ে রাস্তা করে দেন।
* এদিনে হযরত ইউনূস আলাইহিস্সালামকে মাছের পেট থেকে মুক্তি দেন।
* হযরত আইয়ুব আলাইহিস্সালামকে দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর সুস্থতা দান করেন।
* এদিনে দীর্ঘ দিন বিচ্ছেদের পর হযরত ইউসূফ আলাইহিস্সালামকে তাঁর পিতা হযরত ইয়াকুব আলাইহিস্সালামের কাছে ফিরিয়ে দেন।
* এদিনে হযরত সোলায়মান আলাইহিস্সালামকে তাঁর রাজত্ব বা কর্তৃত্ব দেয়ার ঘোষণা দেন।
* এ দিনে হযরত ঈসা আলাইহিস্সালামকে আসমানে তুলে নেন।
* এদিনে হযরত ইব্ররাহীম আলাইহিসসালামের বিলাদত শরীফ, খলীল উপাধি লাভ এবং নমরূদের অগ্নিকুÐ থেকে মুক্তি লাভ করেন।
* এ দিনে হযরত দাঊদ আলাইহিসসালামের দুয়া কবুল এবং তাঁর পুত্র হযরত সোলায়মান আলাইহিসসালামের বিশ্বব্যাপী কর্তৃত্ব প্রদানের ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
* এ দিনে ইমহান আল্লাহপাক সর্ব প্রথম যমীনে বৃষ্টি নাযিল করেন।
এই ১০ই মুহররম আল্লাহপাকের হাবীব, নবীদের নবী, রসূলদের রসূলহুযূও পাক সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রিয়তম দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহুতায়ালা আনহু কারবালার প্রান্তওে মর্মান্তিক ভাবে শাহাদাত বরণ করেন। যা বিশ্ববাসীকে ব্যথিত ও মর্মাহত করে; তবে মুসলিম উম্মাহকে শিক্ষা দেয় ত্যাগেরও সত্যের।
সুতরাং এই পবিত্র মুহররম মাসটি সকলের জন্য ইরহমত, বরকত, সাকীনা ও মাগফিরাত হাছিল করার মাস। সে জন্যই অতীতের সকল ইমাম-মুজতাহিদ ও ওলীআল্লাহ এই পবিত্র মুহররম মাসকে সম্মান করেছেন।
আশুরার আমল :
রোজা : আশুরার একটি অন্যতম আমল হচ্ছে রোজা; তথা ১০ই মুহররম উপলক্ষে দুটি রোজা রাখা। অর্থাৎ ৯, ১০ অথবা ১০, ১১ তারিখ। শুধু ১০ তারিখ রোজা রাখা মাকরূহ। কারণ এদিন ইহুদীরাও রোজারাখে। এ প্রসঙ্গে হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, “তোমরা আশুরা উপলক্ষে রোজা রাখো এবং ইহুদীদের খেলাফ করো। তোমরা আশুরার দিন এবং এর পূর্বে অথবা পওে আরেকটি রোজা রাখো।” অর্থাৎ ৯, ১০অথবা ১০, ১১ তারিখ রোজারাখো।( আহমদ-১/২৪১)
এ প্রসঙ্গে বুখারী ও মুসলিম-এ বর্ণিত হয়েছে :
রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদিনায় তা শরীফ নিয়ে গেলেন তখন লক্ষ্য করলেন ইহুদীরা আশুরা’র দিন রোজা পালন করছে। তখন তিনি তাদের কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বলে : এই দিন আল্লাহ মুসা আলাইহিস্সাল্লাম ও তাঁর অনুসারীদের মুক্তি দিয়ে ছিলেন এবং ফেরাউন ও তার অনুসারীদের ডুবিয়ে মেরে ছিলেন। হযরত মুসা আলাইহিওয়াসাল্লাম এই ঘটনার কৃতজ্ঞতা স্বরূপ রোজা রাখতেন। আর তাই আমরাও রাখি। এরপর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করলেনঃ তোমাদের চেয়ে আমরা মুসা আলাইহি ওয়াসাল্লামের আরো বেশি হক্বদার ও নিকটবর্তী। এ বলে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশুরা’র রোজা রাখতেন এবং অন্যদেরকেও এই রোজা রাখার নির্দেশ দিয়ে ছিলেন। (বুখারী-১৮৬৫) রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন: “রমা দ্বানের পর সবচেয়ে ফযীলত পূর্ণ রোজা হচ্ছে- মুহররম তথা আশুরার রোজা এবং ফরয নামাযের পর সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ নামাজ হলো রাতের নামাজ বা তাহাজ্জুদ নামাজ।” (মুসলিম-১৯৮২)
তিনি আরো এরশাদ করেন, “ধারাফাহ দিনের রোজা বিগত এক বছর ও আগামী এক বছরের গুনাহ মাফ করে দেয়। আর আশুরার রোজা বিগত এক বৎসরের গুনাহ মাফ করে দেয়।”(মুসলিম-১১৬২)
আশুরার দিন পরিবার বর্গেও জন্য উন্নত মানের খানা-পানির ব্যবস্থা কর া: রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি আশুরার দিন তার পরিবারবর্গকে ভালো খাদ্য খাওয়াবে ও ভালো পোশাক পরাবে আল্লাহপাক সারা বছর তাকে সচ্ছলতা দান করবেন।”(তাবারানী, শুয়াবুলঈমান)
পবিত্র আহলে বাইতদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন : মুসলমানদের ইতিহাসে যতগুলো হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটেছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় হৃদয় বিদারক ঘটনা হলো ৬১ হিজরী সনের ১০ই মুহররমে ঘটে যাওয়া ইতিহাসের নৃশংসতম ঘটনা, সাইয়িদুশ্শুহাদা হযরত ইমাম হুসাইন রা দ্বিয়াল্লাহু আনহুর মুবারক শাহাদাত। যাতে রয়েছে মুসলমানদের জন্য শিক্ষা ও উপদেশ। এ ঘটনা আমাদের শিক্ষা দেয়- মুসলমান কোনো বাতিল শক্তির কাছে হার মেনে বশ্যতা শিকার করতে পারেনা। মহিলা ও শিশুসহ মাত্র ৭২ জন সঙ্গী নিয়ে কূফার পথে আক্রান্ত হন এক বিশাল বাহিনীদ্বারা। বীর বিক্রমে জিহাদ করে শাহাদাত বরণ করে শাহাদাতের মাক্বামকে সম্মানিত করেছেন। কিন্তু নাহক্বকে স্বীকার করে নেননি।
তাই পবিত্র আশুরার একটি বিশেষ আমল হলো পবিত্র আহলে বাইতদেও প্রতি ভালবাসারই যহার করা। আল্লাহ পাক এরশাদ করেন: “হে আমার হাবীব! আপনি বলেদিন, আমি তোমাদের নিকট কোনো প্রতিদান চাই না। তবে আমার নিকট জন তথা পবিত্র আহলে বাইতদের প্রতি তোমরা সদা চরণ করবে।” (সূরাশূরা, আয়াত- ২৩)
রসুলপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “হে মহান আল্লাহ! আমি হাসান, হুসাইন এবং তাদের আওলাদগণকে ভালোবাসি। আপনিও তাঁদেরকে ভালো বাসুন এবং যে ব্যক্তি তাঁদেরকে ভালোবাসবে তাদেরকেও আপনি ভালো বাসুন।”(তিরমিযী: হা-৩৭৩১)

লেখক: বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, সাদার্ন
বিশ্ববিদ্যালয়, খতীব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ