পবিত্র আশুরা ও শাহাদাতে কারবালা

102

আশুরা মানে দশম। হিজরি বর্ষের প্রথম মাস পবিত্র মর্হরমের দশ তারিখ আশুরা হিসেবে পরিচিত। এ দিবসের গুরুত্ব ও ফযিলত ইসলামপূর্ব যুগ হতে বিধিত। বিশেষত হযরত মূসা আ.-এর যুগ হতে এটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য সুপ্রতিষ্ঠিত। কারণ, এ দিবসে তিনি ও তাঁর অনুসারীরা অত্যাচারী, নরহত্যাকারী ও খোদা দাবিদার ফেরাউনের নিপীড়ন থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। ফেরাউন ও তার বাহিনী হযরত মূসা আ. ও তাঁর সহচরদেরকে ধাওয়া করলে আল্লাহর হুকুমে মূসা আ. নীল নদে তাঁর লাঠি দিয়ে আঘাত করে। এতে অলৌকিকভাবে নদীর ওপর রাস্তা সৃষ্টি হয়। ফলে তিনি ও তাঁর অনুসারীরা ঐ পথ পাড়ি দিয়ে ওপারে চলে যেতে সক্ষম হন। পক্ষান্তরে ফেরাউন ও তার বাহিনী উক্ত পথ পাড়ি দেয়ার সময় রাস্তাটি দুভাগ হয়ে যায় আর ফেরাউন ও তার বাহিনী নদীতে ডুবে মারা পড়ে। ফলে একত্ববাদ ও রিসালত ভিত্তিক সমাজচিন্তার দ্বার উন্মুক্ত হয়। অবসান ঘটে মানুষের ওপর মানুষের প্রভুত্ব, স্বৈরাচারী শাসন এবং অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর। কৃতজ্ঞতা স্বরূপ হযরত মূসা আ. রোযা পালনের মাধ্যমে এ দিবস পালন করেন। সে ধারাবাহিকতায় ইহুদিরা আশুরার রোযা পালন করত। হিজরতের পর মদিনার ইহুদিদেরকে রোযা পালন করতে দেখে আল্লাহর নবি (দ.) তাদেরকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করেন। তাদের উত্তর ছিল, আল্লাহ তায়ালা এ দিবসে ফেরাউনের দুঃশাসন থেকে আমাদের নবি ও জাতিকে মুক্তি দিয়েছিলেন। তাই আমরা রোযা পালনের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করি। তখন আল্লাহর নবি (দ.) মুসলমানদেরকেও সে দিবসে রোযা পালনের নির্দেশ দেন। তিনি বলেছিলেন, আমরা তোমাদের চেয়ে মূসার অধিক ঘনিষ্ঠ (বুখারি, হাদিস নং- ১৮৬৫)। সেই আলোকে আশুরা দিবসে রোযা পালন করা সুন্নাত। রমজানের রোযার পর সবচেয়ে উত্তম রোযা হলো আশুরার রোযা (মুসলিম, হাদিস নং- ১৯৮২)। এর ফযিলত সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে আল্লাহর নবি (দ) বলেন, “এর মাধ্যমে আল্লাহর নিকট তুমি পূর্বের বছরের পাপ মোচনের আশা করতে পার” (প্রাগুক্ত, হাদিস নং-১১৬২)। অন্য হাদিসে বলা হয়েছে, “যদি আমি আগামী বছর বেঁচে থাকি তাহলে আশুরার নবম তারিখও রোযা পালন করব।” আশুরার পরের দিনের রোযা পালন করার কথাও হাদিসে এসেছে। অর্থাৎ আশুরার আগের দিন অথবা পরের দিনসহ রোযা পালনের কথা বলা হয়েছে। সুতরাং সক্ষম ব্যক্তির জন্য দুদিন রোযা পালন করা উত্তম। অপরগতায় আশুরার দিন পালন করলেও সুন্নাত আদায় হবে। এ ছাড়া নিজের পরিবার-পরিজনের জন্য সেই দিন ভাল খাবারের ব্যবস্থা করার ফযিলতের কথা পবিত্র হাদিসে এসেছে। দরিদ্রকে সাহায্য করা, আপ্যায়নের ব্যবস্থা করা, বেশি বেশি নফল ইবাদত করা আশুরা দিবসের নেক আমলের অন্তর্ভুক্ত।
যদিও হযরত মূসা আ.-এর মুক্তি বা বিজয় দিবস হিসেবে আশুরা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, কিন্তু হযরত আদম আ. থেকে শুরু করে হযরত ইসা আ. পর্যন্ত প্রায় নবি-রাসুল আ.-এর যুগে বড় বড় অলৌকিক ও আশ্চার্যজনক ঘটনা ঘটেছে আশুরা দিবসে। তাই ঐশীবাণী নির্ভর সর্বজাতির নিকট আশুরা গুরুত্বপূর্ণ দিবস। হাদিস শরিফের ভাষ্য মতে, আসমান-যমিন, আরশ-কুরসির সৃষ্টি হয়েছিল এ দিবসে। পৃথিবীতে প্রথম বৃষ্টি নামে আশুরা দিবসে। কিয়ামতও সংঘটিত হবে আশুরা দিবসে। হযরত আদম আ.-এর জান্নাত লাভ, পৃথিবীতে আগমন এবং তাওবা কবুল হওয়ার ঘটনাও উক্ত দিবসে। এভাবে মহাপ্লাবনের পর হযরত নূহ আ.-এর নৌযানের কূল পাওয়া, নমরুদের অগ্নিকুÐ থেকে ইব্রাহিম আ.-এর মুক্তি এবং আশিঊর্ধ্ব বয়সে তাঁর সন্তান লাভ, হযরত ইয়াকুব আ. ও হযরত আইউব আ.-এর আরোগ্য লাভ, হযরত সুলাইমান আ.-এর রাজত্ব ফিরে পাওয়া, হযরত ইদ্রিস আ.-এর উচ্চ মর্যাদা অর্জন, হযরত ইসা আ.-এর জন্ম ও তাঁকে আসমানে উঠিয়ে নেয়া ইত্যাদি অলৌকিক ঘটনা ও নিয়ামত প্রাপ্তির দিবস পবিত্র আশুরা। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবি হযরত মুহাম্মদ (দ.)-এর সুপ্রিয় দৈহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন র.-এর ৬০ হিজরি সনে (৬৮০ খ্রি.) কারবালা প্রান্তরে সপরিবারে শাহাদাত বরণ আশুরা দিবসকে আরো তাৎপর্যপূর্ণ করেছে। কারবালার উক্ত ঘটনা বিশ্ব মুসলমানের জন্য বিষাদময় ও হৃদয় বিদারক স্মৃতিতে পরিণত হয়েছে। নবিপরিবারের প্রতি ভালবাসার দাবি পূরণ করতে গিয়ে যুগে যুগে রচিত হয়েছে বহু গ্রন্থ, পুঁথি, মর্সিয়া ইত্যাদি। তাঁদের স্মরণে পালিত হয়ে আসছে শাহাদাতে কারবালা মাহফিল। আল্লাহ তায়ালার বড় বড় কুদরত এবং প্রত্যেক নবি-রাসুলের শ্রেষ্ঠ মু‘জিযা প্রকাশের দিবসে ইমাম হুসাইন র.-এর শাহাদাত বরণ প্রমাণ করে যে, সত্যের জন্য তাঁর ত্যাগ ও সংগ্রাম আল্লাহর তায়ালার একান্ত ইচ্ছায় হয়েছে এবং এটি মকবুল হয়েছে। পূর্ববতী তাগুতী শক্তির বিরুদ্ধে নবিগণের যে সংগ্রাম ছিল ইমাম হুসাইন র.-এর সংগ্রাম সেই ধারাবাহিকতায় হয়েছে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, আশুরা ছিল নবি-রাসুলগণের মুক্তি, আরোগ্য লাভ ও নিয়ামত প্রাপ্তির দিবস। কিন্তু নবিপরিবারের জন্য ছিল শাহাদাত বরণ দিবস, যা বাহ্যিক দৃষ্টিতে বিপরীত ও ব্যতিক্রম মনে হতে পারে। আসলে তা নয়, বরং আল্লাহ তায়ালার পথে শাহাদাত বরণ প্রকৃত মুমিনের একান্ত কাম্য। উপরন্তু তাঁদের ত্যাগের বিনিময়ে মুসলিম জাতির মুক্তি ঘটেছে, অত্যাচারী ইয়াজিদ ও তার প্রেতাত্মাদের মরণ হয়েছে, সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য সূচিত হয়েছে, গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার পথ উন্মুক্ত হয়েছে, সর্বোপরি কুরআন-সুন্নাহর আলোকে সুপ্রতিষ্ঠিত কল্যাণকর খেলাফত ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারের পথ পরিষ্কার হয়েছে। তাই কারবালা প্রান্তরে ইমাম হুসাইনের পরাজয় হয়নি, পরাজয় হয়েছে ইয়াজিদসহ তার নিষ্ঠুর সহচরদের। পরাজয় হয়েছে স্বৈরাচার ও অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর। পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে কপট শ্রেণির। দিশাহারা ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় মুসলিম জাতি পেয়েছে সঠিক দিকনির্দেশনা। তাই বলা হয়েছে, “হুসাইনের শাহাদাত মূলত ইয়াজিদের মরণ। আর কারবালার এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তির মধ্য দিয়েই ইসলাম জীবিত থাকবে।” বাস্তবে হয়েছেও তাই। কারণ, সাময়িক ক্ষমতার মালিক ইয়াজিদ আজকে আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত, সবার নিকট ঘৃণিত, অভিশম্পাদিত ব্যক্তির নাম। পক্ষান্তরে ইয়াজিদের চার হাজার সৈন্যের মোকাবেলায় ইমাম হুসাইনের নিরস্ত্র ও নিরীহ সত্তর জনের বাহিনীর শাহাদাত বরণ ইমাম হুসাইন ও তাঁর সহচরদেরকে ইতিহাসে অমরত্ব দান করেছে। যুগ যুগ ধরে মানুষ তাঁদেরকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। তাঁদের উদ্দেশ্যে স্মরণ সভা, মাহফিল, ফাতিহাখানি চলতে থাকবে। যে কোন গণতান্ত্রিক, কল্যাণকর ও মুক্তির সংগ্রামে তাঁদের আদর্শ মানুষকে অনুপ্রেরণা যুগাবে। মিথ্যার সামনে মাথা নত না করে রক্তের শেষ বিন্দু দিয়ে হলেও সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের মডেল হয়ে থাকবেন ইমাম হুসাইন র. ও তাঁর সাথীরা। সর্বঅপশক্তির অবসান ঘটিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের অগ্রপথিক হয়ে থাকবেন ইমাম হুসাইন র.। তাই শুধু কান্নাকাটির মধ্যে সময় না কাটিয়ে বা “হায় হায় হুসাইন”- শ্লোগান না দিয়ে দীপ্ত শপথ নিয়ে সত্য-ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান নেয়া কারবালার প্রধান শিক্ষা। সাময়িক জীবনের মায়া ছেড়ে চিরন্তন জীবনের সুখের আশায় সর্বোচ্চ ত্যাগ শিকার করার শপথ গ্রহণ করা কারবালার দর্শন। যে কোন কঠিন পরিস্থিতিতে আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা রেখে সুস্থির থাকা কারবালার আদর্শ। পার্থিব সাময়িক ক্ষমতা, অর্থকড়ি, পদপদবীর মোকাবেলায় পরকালের পুরস্কারের জন্য ন্যায় পথে অবিচল থাকা ইমাম হুসাইনের র. সংগ্রামের মূল দাবি। অযৌক্তিক, অনর্থক ও একান্ত আবেগনির্ভর কোন কর্মসূচি ইমাম হুসাইন র.এর প্রতি ভালবাসার পরিচায়ক নয়। হুসাইনি দাবি করা সহজ, তবে হুসাইনি প্রমাণ করা অনেক কঠিন। তাই প্রয়োজন লোভ-লালসা, হিংসা-বিদ্বেষ, দুঃশাসান, দূর্নীতি, অত্যাচার-অনাচার ও অশ্লীলতা মুক্ত সমাজ গড়ার সুদৃঢ় শপথ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। জাতীয় কবির ভাষায়, ফিরে এলো আজ সেই মোর্হরম মাহিনা/ত্যাগ চাই, মর্সিয়া-ক্রন্দন চাহিনা! আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেককে আশুরার গুরুত্ব অনুধাবন পূর্বক সত্য-ন্যায়ের পথে জীবন গড়ার তৌফিক দান করুন।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ,
চবি ও খতিব, চট্টগ্রাম বন্দর আ/এ জামে মসজিদ