পদ্মা সেতুতে যান চলাচল শুরু ছবি তোলার হিড়িক

25

ঢাকা প্রতিনিধি

স্বপ্নের পদ্মা সেতু যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। গতকাল রোববার সকাল ৬টা থেকে সেতুতে টোল দিয়ে যানবাহন পারাপার শুরু হয়। প্রথমবার সেতু দিয়ে পার হতে পেরে উচ্ছ¡সিত চালক ও যাত্রীরা। দুপুর পর্যন্ত বহু মানুষকে সেতুর উপর গাড়ি থামিয়ে ছবি তুলতে এবং ভিডিও করতে দেখা যায়। বহু মানুষ সেতুর উপর দাঁড়িয়ে ছবি তোলার জন্য মোটরসাইকেল ও ব্যক্তিগত যানবাহন থামিয়ে নেমে পড়ছিল। পুলিশের টহল ভ্যান এসে তাদের সরিয়ে দিলেও আবার কিছুক্ষণ পরেই একই অবস্থা তৈরি হচ্ছিল।
তবে আজ থেকে পদ্মা সেতুতে নেমে ছবি তুললে জরিমানা করা হবে। একই সঙ্গে যানবাহন থেকে অযথ নামলে কিংবা নিয়ম না মানলে নেওয়া হবে কঠোর ব্যবস্থা। গতকাল দুপুরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এই তথ্য জানান শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) উম্মে হাবিবা ফারজানা।
এদিকে ভোর ৬টা থেকে যানবাহন চলাচল শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এর আগে থেকেই বিভিন্ন যানবাহনকে সেতু পার হবার জন্য অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। পরে ভোর ৬টায় টোল প্লাজা দিয়ে সেতুতে গাড়ি চলাচল শুরু হয়। সেতু দিয়ে চলাচল উন্মুক্ত করে দেওয়ার পর কয়েক মিনিটের মধ্যে সব যানবাহনের চাপ কমে যায়।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এক গণবিজ্ঞপ্তিতে জানায়, পদ্মা সেতুতে ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে গাড়ি চালানো যাবে না। এ সেতুর ওপর যে কোনো ধরনের যানবাহন দাঁড়ানো ও যানবাহন থেকে নেমে সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে ছবি তোলা বা হাঁটতে নিষেধ করা হয়েছে।
শনিবার সেতুর মাওয়া প্রান্তে টোল পরিশোধ শেষে উদ্বোধনী ফলক ও ম্যুরাল-১ উন্মোচনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেন। উদ্বোধন শেষে জাজিরা প্রান্তে পৌঁছে সেতু ও ম্যুরাল-২ এর উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করেন।
গতকাল সকাল ৬টায় সেতুর দুই প্রান্তের ১৪টি টোল গেইট খুলে দিলে বিপুল সংখ্যক মোটরসাইকেল, ব্যক্তিগত গাড়ি, বাস, ট্রাকসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন টোল দিয়ে সেতু পার হতে শুরু করে।
ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর সরাসরি সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। এই ২১টি জেলার মাওয়া রুট ব্যবহারকারী বাসসহ যানবাহনগুলো এতদিন ফেরিতে পারাপার হত। এখন পদ্মা সেতু পার হয়ে বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে যানবাহন আসছে কেরানীগঞ্জ থেকে বুড়িগঙ্গা সেতু আর বাবুবাজার ব্রিজ হয়ে ঢুকছে ঢাকায়। একই পথে ঢাকা থেকে শয়ে শয়ে যানবাহন ছুটছে পদ্মা সেতুর দিকে।
ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক আতিক গণমাধ্যমকে বলেন, ভোরবেলা থেকে এই অবস্থা। অনেক অনেক গাড়ি ঢুকতেছে ঢাকায়, আর ফুলবাড়িয়া দিয়ে গাড়ি ভরে মানুষ বের হচ্ছে। গাড়ি সামাল দিতে হাত নেড়ে কুল পাচ্ছি না।
কেরানীগঞ্জের কদমতলী ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক পীযূষ কুমার মালো বলেন, চুনকুটিয়ায় হাইওয়ে সড়ক দিয়ে এক্সপ্রেসওয়েতে নামা ও ওঠার যে লেইন আছে, সকাল থেকে প্রচুর গাড়ি ওই লেন ধরে যাওয়া আসা করেছে। প্রথম ধাক্কা সামলানোর পর সকাল ১০টার দিকে গাড়ির চাপ একটু কমেছে। তবে যানজট হয়নি কোথাও।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ মুনিবুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, শনিবার গাড়ি চলাচল বন্ধ ছিল। রোববার অফিস খোলাসহ একটা চাপ থাকে। তাছাড়া পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে আসা কিছু গাড়ি ঢাকায় ঢুকছে, কিছু ফ্লাইওভার ব্যবহার করে নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রাম রোডের দিকে চলে যাচ্ছে। তার ভাষায়, সকালে অফিস আদালত খোলার সময়টায় সেতু হয়ে আসা গাড়ি বাড়ায় চাপ বেশি মনে হয়েছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তা অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে।
জানা যায়, এক একটি গাড়ির টোল আদায় করতে দু-তিন মিনিটের মত লাগছে। মোট ছটা বুথ থেকে টোল আদায় করা হলেও, যানবাহনের চাপ অত্যধিক হওয়ায় কিছুটা যানজট তৈরি হয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, পদ্মা সেতু প্রথমবারের মত পার হওয়া নিয়ে মানুষের উচ্ছ¡াস এত বেশি যে যানজট নিয়ে খুব বেশি অভিযোগ চোখে পডেনি।
৮ ঘণ্টায় টোল আদায় ৮২ লাখ টাকা
গতকাল ভোর ৬টা থেকে যানবাহনের জন্য পদ্মা সেতু খুলে দেওয়ার পর প্রথম ৮ ঘণ্টায় ৮২ লাখ ১৯ হাজার ৫০ টাকা টোল আদায় করা হয়েছে।
পরবর্তী আট ঘণ্টায় সেতুর জাজিরা প্রান্তে মোট ৩৫ লাখ ২৯ হাজার ৫০০ টাকা। মাওয়া প্রান্তে ৪৬ লাখ ৮৯ হাজার ৫৫০ টাকা টোল আদায় হয়। একই সময়ে দুই প্রান্তে গাড়ি যাতায়াত করে ১৫ হাজার ২০০টি।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবুল হোসেন গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, আট ঘণ্টায় দুই পাড়ে মোট ৮২ লাখ ১৯ হাজার ৫০ টাকা টোল আদায় হয়েছে।
বাংলাদেশের পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে তৈরি ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এই সেতুটির মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের ১৯টি জেলার সঙ্গে দেশের বাকি অংশের সংযোগ তৈরি করেছে।
সেতুতে যানবাহন থেকে অযথা নামলে ব্যবস্থা
পদ্মা সেতুতে মানুষের হাঁটাচলার বিষয়ে কড়াকড়ি আরোপ করেছে সেতু বিভাগ। সেতুতে মানুষের না নামার বিষয়টি নিশ্চিত করতে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে অনুরোধ জানিয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষ। গতকাল পদ্মা সেতুপ্রকল্পের পরিচালক মো. শফিকুল ইসলামের সই করা চিঠি সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং সাপোর্ট অ্যান্ড সেফটি টিমকে (ইএসএসটি) পাঠানো হয়েছে। চিঠির সত্যতা তিনি নিজেই গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন।
চিঠিতে প্রকল্প পরিচালক বলেন, সেতুর ওপরে যানবাহন থেকে নামা নিষিদ্ধ। এরপরও অনেকে সেতুতে নেমে মূল্যবান মালামাল ও যন্ত্রপাতি চুরি করছে। অনেকে দুই দিকের টোল প্লাজার আশপাশে যন্ত্রপাতি ও মালামালের ক্ষতি করছে। এ অবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে ইএসএসটিকে টহল জোরদার করার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
সেতু বিভাগ সূত্র বলছে, সেতুর টোল প্লাজার কাছে চারপাশে বেড়া দেওয়ার কাজ এখনও শেষ হয়নি। সেখানে নানা নির্মাণসামগ্রী রয়েছে। অনেকে বাইরে থেকে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছে। গাড়ি-মোটরসাইকেল থামিয়ে সেলফি তোলা, শুয়ে ছবি তোলা, রেলিংয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। এতে একদিকে যানবাহন চলাচলে ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে। এছাড়া মালামাল চুরির ঘটনাও ঘটছে।
পদ্মা সেতুতে মোটর বাইক ওঠা নিষিদ্ধ হল
খোলারপ্রথম দিনে শত শত মোটরসাইকেলের ভিড়ে দুর্ঘটনার শঙ্কায় পদ্মা সেতুতে এই দ্বিচক্রযান চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। গতকাল সকালে বহুপ্রতীক্ষিত এই সেতু চালুর পর রাতেই মোটরসাইকেলের ওঠা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত জানায় সেতু বিভাগ।
এক তথ্য বিবরণীতে বলা হয়, আগামীকাল ২৭ জুন (আজ সোমবার) ভোর ৬টা থেকে পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত পদ্মা সেতুতে মোটর সাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার।
এ বিষয়ে সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, পদ্মা সেতুতে মোটরসাইকেল চলাচল অনেক বেড়ে গেছে, তারা ঝুঁকিপূর্ণ চলাচল করছে। দুর্ঘটনার আশঙ্কা করছি। তাই আগামীকাল (আজ) থেকে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ থাকবে।
কত দিন এই নিষেধাজ্ঞা চলবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, পর্যালোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
৬ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতুতে বাইসাইকেল, অটোরিকশা চলাচল নিষিদ্ধ থাকলেও মোটরসাইকেল চলাচলে বাধা ছিল না। বাইকের জন্য ১০০ টাকা টোলও নির্ধারিত হয়েছিল।