পদ্মাসেতু : দিনবদলের সনদের প্রতিটি বাক্যের শক্তির প্রমাণ

19

অঞ্জন রায়

একটি সেতু তখনই একটি দেশের গর্বের প্রতীক হয়ে ওঠে যখন দেশের মানুষের কাছে সেই সেতুটি নিজস্ব মমত্বের চিহ্নে পরিণত হয়। হ্যাঁ। সেটাই হয়ে উঠেছে আমাদের পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রে। নির্মাণকাজ শুরু হওয়ার আগেই পদ্মা সেতু নিয়ে শুরু হয়েছিল ষড়যন্ত্র, দেশি পন্ডিত থেকে বিদেশি লবিস্ট, সাচ্চা আলবদর-রাজাকার থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া দু-একজন, সবাই একজোট হলেন যেকোনোভাবে বাংলাদেশে যাতে পদ্মা সেতু না হয়, সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ছক নিয়ে। গরম হয়ে উঠলো খবরের কাগজের পাতাগুলো, তাপ ছড়ালো টেলিভিশন টকশোগুলোতে, তখনও ফেসবুক এতটা গণ হয়ে ওঠেনি, ইউটিউবের বাজারও জমে ওঠেনি, তবু সেখানেও ব্যাপক পান্ডিত্যের তুফান। কেউ কেউ যেমন সেতুর অর্থ বরাদ্দের আগেই খুঁজে পেলেন বিশাল দুর্নীতি, আবার কেউ চ্যালেঞ্জ করে বসলেন এই সেতু কখনও নির্মাণ করতে পারবে না সেই সময়ের সরকার। কিন্তু সবকিছুকে উড়িয়ে দিয়ে সেতুটি নির্মাণ হয়ে গেলো। বিশ্বব্যাংকের টাকায় নয়, আমাদের নিজেদের অর্থায়নে। আর যে সরকার সেতুটির স্বপ্ন নিয়ে মানুষের কাছে এসেছিল, সেই সরকারের ধারাবাহিকতার মাঝেই পদ্মা সেতুর প্রথম থেকে শেষ পিলারটা পর্যন্ত তৈরি হলো– এখন আমাদের চোখের সামনে পূর্ণ নির্মিত পদ্মা সেতু। বঙ্গবন্ধুর সন্তান দেখিয়ে দিলেন প্রতিশ্রুতি না, তিনি সেই মানুষ যিনি প্রতিশ্রুতির প্রতিটি অংশ বাস্তবায়ন করতে জানেন। আমাদের রাজনীতির সবচেয়ে বাজে দিক হলো প্রতিপক্ষকে সফলতা না দিতে দেশের মানুষের সরাসরি ক্ষতি করা। সেই ক্ষেত্রেও পদ্মা সেতু এক অনন্য দৃষ্টান্ত। যারা সেতু নির্মাণের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিলেন, এখনও করছেন- তারা কিন্তু খুব ভালো করেই জানতেন এই সেতুর নির্মাণ দেশের বিশাল একটি জনপদের মানুষের কাছে কতটা জরুরি। তারা জানতেন এই সেতুটি নির্মাণের ফলে আমাদের অর্থনীতিতে অনেক বড় পজেটিভ প্রভাব পড়বে। প্রান্তিক মানুষ থেকে বড় ব্যবসায়ী প্রত্যেকেই প্রত্যক্ষভাবে পদ্মা সেতুর সুফল পাবেন। কিন্তু তবু সর্বোচ্চ চেষ্টা চলেছে পদ্মা সেতু যাতে আওয়ামী লীগ সরকার নির্মাণ না করতে পারে সেই জন্য। মিথ্যাচারের ইমেইল চালাচালি, বিস্তর অসত্য তথ্যের উৎসব চালানোর সময়ে তাদের একবারও মনে হয়নি, পদ্মা সেতু নির্মিত হলে সরাসরি উপকৃত হবেন দেশের মানুষ। অবশ্য বিরোধিতা আর ষড়যন্ত্র যখন প্রধান বিষয়, তখন সাধারণ মানুষ গৌণ হয়ে যায়। যায় বলেই আমরা নিকট অতীতে দেখেছি আন্দোলন আর অবরোধের নামে মানুষ পোড়ানোর অজস্র ঘটনা। দেখেছি সরাসরি জঙ্গিদের হাতে হাত রেখে দেশকে অন্ধকারে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা, দেখেছি যুদ্ধাপরাধীদের রাজবন্দি হিসেবে উল্লেখ করে তাদের মুক্তি চাওয়া, দেখেছি যুদ্ধাপরাধীদের দন্ড কার্যকরের বিরুদ্ধে হরতাল ডাকার ঘটনা। এসব দৃষ্টান্তের কারণেই পদ্মা সেতু নিয়ে অগণিত মিথ্যাচার বা ষড়যন্ত্র আমার কাছে নতুন কিছু মনে হয়নি। মনে হয়েছে রাষ্ট্রক্ষমতায় যেতে কতটা নীচতার আশ্রয় নেওয়া যায়, তারই কিছু দৃষ্টান্ত ইতিহাসের সংগ্রহে তুলে দেওয়ার জন্য কিছু রাজনৈতিক দল, সাংবাদিক, দাদন ব্যবসায়ীরা নিজেদের স্বরূপ রেখে দিলেন সময়ের কাছে। যা আজ যেমন এই আমাকে বা আমাদের বিস্মিত করেছে, আজ থেকে ৫০ বছর পরেও আগামী প্রজন্মের মানুষদের তেমন বিস্মিত করবে। ইতিহাসের কাঠগড়া খুব নির্মম–- সেখানে কোনও ষড়যন্ত্রকারীই কখনও নিজের চেহারা লুকাতে পারেননি।
আমার মনে পড়ে, সেই ছোট্টবেলায় পাবনা থেকে ঢাকাতে আসতে দুটো ফেরি পাড়ি দিতে হতো। আজ সময়ের পথযন্ত্রণা আজকের প্রজন্ম ভাবতেও পারবে না। কারণ, এখন বঙ্গবন্ধু সেতুর কারণে সেই পথের কষ্ট হারিয়ে গেছে অনেক বছর। ঠিক তেমনি লাখো মানুষের পদ্মা পাড়ি দেওয়ার কষ্ট, অ্যাম্বুলেন্সে আটকে থাকা অসুস্থ মানুষের কষ্ট- স্বজনদের চিন্তা এসব কিছুর মুক্তি ঘটতে চলেছে পদ্মা সেতুর মধ্য দিয়েই। দেশের অর্থনীতির বড় একটা বাঁক বদলের দৃষ্টান্তও হবে আমাদের পদ্মা সেতু। আর সেই সেতুটির নির্মাণে মধ্যে দিয়ে ইতিহাসের আরেক অনন্য উচ্চতার পৌঁছালেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমরা গর্ব করে বলতে পারি- আমাদের প্রধানমন্ত্রী এমন একজন মানুষ, যিনি শুধু স্বপ্ন দেখান না। শত ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্নভিন্ন করে নিজের স্বকীয়তা ও সক্ষমতায় স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে দেখিয়ে দেন দিনবদলের সনদের প্রতিটি অক্ষর, শব্দ, বাক্যের শক্তি।
জানি, আর মাত্র কয়েক দিন পরই লাখো মানুষ চলাচল করবেন পদ্মা সেতু দিয়ে। যারা ষড়যন্ত্র করেছিলেন, এখনও করছেন, আগামীতে করবেন। তারাও চলাচল করবেন। হয়তো সেতুতে চলার সময়ে চালককে বলবেন গাড়ির গতি কমাতে। কাঁচ নামিয়ে মুক্ত বাতাস নেবেন বুকভরে। কিন্তু সেই সময়ে কি তাদের নিজের মধ্যে একটুও অপরাধ বোধ বা আক্ষেপ কাজ করবে না? মনে মনে হলেও তারা কি অনুতপ্ত হবেন না নিজেদের কুৎসিত কৃতকর্মের কথা ভেবে? জানি না তারা কি ভাববেন, তবে তাদের চেহারাগুলো কিন্তু সাধারণ মানুষও চিনে গেছে। এটুকু অন্তত তারা বুঝলে সেটিও আগামীর জন্য কল্যাণকর।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক