পথ হোক নিরাপদ, ফুটপাত হোক পথচারীদের

54

ওয়াসিম আহমেদ

পায়ে হাঁটা যাতায়াতের প্রধানতম মাধ্যম। তারপরও শহরের যোগাযোগ অবকাঠামোগুলো এখনো পথচারীবান্ধব হয়ে ওঠেনি। সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের প্রায় চারভাগের তিনভাগই পথচারী। পায়ে হেঁটে সড়ক ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে ‘পথচারী নিরাপত্তা প্রবিধানমালা-২০২১’ শীর্ষক তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ভবনের পেট থেকে ফুটপাত, দখলদারদের ভাড়ায় চলে হকার বাণিজ্য।
পথচারীরা বাধ্য হয়ে সড়কে হাঁটতে গিয়ে শিকার দুর্ঘটনার, নিভছে জীবন বাতি। ফুটপাত দখলমুক্ত করতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নিয়মিত উচ্ছেদ অভিযান চললেও সামগ্রিক কোনো সফলতা দেখাতে পারেনি সংস্থাটি। এমনকি নগরীতে কি পরিমাণ ফুটপাত রয়েছে, কতটুকু ফুটপাতের প্রয়োজন রয়েছে তারও কোনো স্পষ্ট তথ্য নেই চসিকের।
অন্যদিকে যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য মতে, গত ছয় বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় দেশে মারা গেছেন ৪৩ হাজার ৮৫৬ জন। গত তিন বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় ১ লাখ ৬৫৭ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। এমন তথ্য উঠেছে বুয়েটের আরেক গবেষণায়।
নগরীর ফুটপাত গিলে খাচ্ছে রাস্তার পাশের বহুতল ভবনগুলো। নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিডিএ’র (চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) কোনো কার্যকরী ভূমিকা নেই। আবার সড়ক-ফুটপাত দখল করে হকাররা ব্যবসা করছে আর চাঁদার টাকার ভাগ চলে যাচ্ছে স্থানীয় প্রভাবশালী ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে। সিটি করপোরেশন উচ্ছেদ করলেও শেষ অবধি ফুটপাতকে দখলমুক্ত করা যায়নি। উচ্ছেদে চসিকের প্রশ্নবিদ্ধ সক্ষমতায় জেলা প্রশাসনের সহায়তায় ও নিয়মিত মনিটরিংয়ের ক্ষেত্রে পুলিশের সাথে চসিকের সমন্বয়ের দেখা মেলেনি। তাই নিরাপদ পথযাত্রা নিশ্চিত ও সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে মানসম্মত ফুটপাত ও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর কোনো বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেন নগর পরিকল্পনাবিদ সুভাস বড়–য়া। তিনি পূর্বদেশকে বলেন, আমাদের শহরে যেসব ফুটপাত রয়েছে তা প্রশস্তের দিক দিয়ে মানসম্মত নয়। একটি ফুটপাতের প্রশস্ত হবে মিনিমাম ১ দশমিক ৮৫ মিটার। যাতে অন্তত দুইটি প্রতিবন্ধীর হুইল চেয়ার পাশাপাশি চলাচল করতে পারে। সিটি করপোরেশন ফুটপাত নির্মাণের সময় তা মানছে না। তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রাম শহরে ফুটপাত প্রশস্ত করতে গেলে সিটি করপোরেশনকে বেকায়দায় পড়তে হবে। সিডিএ’র অনুমোদন নিয়ে আইন ভঙ্গ করে যেভাবে রাস্তার পাশে ভবন তোলা হয়েছে সেখানে প্রশস্ত করতে গেলেই জনগণ নিজেই বাধা হয়ে দাঁড়াবে। কয়টি ভবন ভাঙবে? এরজন্য মূলত প্রয়োজন আন্তরিকতা। জনগণ, জনপ্রতিনিধি ও দায়িত্বপ্রাপ্তদের সবাইকে সম্মিলিতভাবে বাস্তবায়নযোগ্য উদ্যোগ নিতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর কোনো উদ্যোগ নেই। চালকদের পেশাগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করে তাদের গাড়ি চালানোতে গতি নিয়ন্ত্রণ ও পেশাদারিত্ব ফিরিয়ে আনতে হবে।
বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের গবেষকরা দেখছেন, সোজা সড়কেই দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে, আর ম‚ল কারণ হচ্ছে অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালানো। মহাসড়কে বিভাজক বসানোয় গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষ কমলেও পেছন থেকে ধাক্কার ঘটনা বেড়ে গেছে বলেও জানিয়েছেন বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান। ‘নিরাপদ সড়ক দিবসে’ গতকাল ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ক এক সংলাপে নিজেদের গবেষণার ফলাফল তুলে ধরেন তিনি। বুয়েটের এক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের ৭১ দশমিক ৭২ শতাংশ পথচারী। এ অবস্থায় পায়ে হেঁটে সড়ক ব্যবহারকারীদের নিরাপত্তায় সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে ‘পথচারী নিরাপত্তা প্রবিধানমালা-২০২১’ শীর্ষক তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ প্রবিধানমালার একটি খসড়াও এরই মধ্যে তৈরি করে ফেলেছে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। খসড়া প্রবিধানমালায় সব বয়সের ও শারীরিক সক্ষমতার পথচারীদের উপযোগী করে ফুটপাত নির্মাণ, সহজে ও নিরাপদে সড়ক পারাপার, সড়ক পারাপারে গাড়ি নয় পথচারীদের অগ্রাধিকার, সড়কের যৌথ ব্যবহার, পথচারী নেটওয়ার্ক পরিকল্পনা, দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ ও আহতদের চিকিৎসা ব্যয়ের ব্যবস্থার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে বলা হয়েছে সড়ক পারাপারের ক্ষেত্রে গাড়ি নয়, পথচারীদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। পাশাপাশি সড়ক ব্যবহারে পথচারী, সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট স্থানীয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব ও কর্তব্যের মতো বিষয়গুলোও ঠিক করে দেয়া হয়েছে।
সমীক্ষা করে দেখা গেছে ৩০ শতাংশ গতিতে চলমান কোনো গাড়ির ধাক্কায় আঘাত পেয়ে আহত হলে বাঁচার সম্ভাবনা ৯৫ শতাংশ। কিন্তু ১০ শতাংশ বেশি অর্থাৎ ৪০ শতাংশ গতির গাড়ির ধাক্কায় আঘাত পেয়ে আহত হলে বাঁচার সম্ভাবনা ৪৫ শতাংশে নেমে আসে। আর ৫০ শতাংশ গতির গাড়ির ধাক্কায় আহত হলে বাঁচার সম্ভাবনা ৫ শতাংশ নেমে আসে। সুতরাং গতি খুবই গুরুত্বপ‚র্ণ একটি মাপকাঠি সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে, বলেন হাদিউজ্জামান।
অধ্যাপক হাদিউজ্জামান আরও বলেন, ২০১৯ সালে সড়ক দুর্ঘটনার কারণে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৩৮ হাজার কোটি টাকা। ২০২০ সালে করোনা ভাইরাসের কারণে কয়েক মাস লকডাউন থাকার পরেও যেসব দুর্ঘটনা ঘটেছে তাতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৩২ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই ক্ষতির অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। তিনি বলেন, দুর্ঘটনা কমাতে হলে আইন, নীতিমালা ও পরিকল্পনার পাশাপাশি বহুমাত্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করতে হবে।
এ দিকে গত ছয় বছরে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৩ হাজার ৮৫৬ জনের প্রাণহানির তথ্য তুলে ধরেছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি। সংগঠনটির মহাসচিব মো. মোজাম্মলে হক চৌধুরী বলছেন, এই ছয় বছরের হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে, সড়ককে নিরাপদ করার কোনো প্রতিশ্রুতিই খুব একটা কাজ করছে না। বিবৃতিতে তিনি বলেন, ধারাবাহিকভাবে তিনবারের ক্ষমতাসীন বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনী নানা প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হলেও ৩য় মেয়াদের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে নিরাপদ সড়কের অঙ্গীকার বাস্তবায়নে গাফেলতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব মতে, সারাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৬৪ জন মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে। ১৫০ জনের বেশি মানুষ আহত হচ্ছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসেবে দেখা গেছে, বিগত ২০১৫ সালে ৬ হাজার ৫৮১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৮ হাজার ৬৪২ জন নিহত, ২১ হাজার ৮৫৫ জন আহত, ২০১৬ সালে ৪ হাজার ৩১২টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৫৫ জন নিহত, ১৫ হাজার ৯১৪ জন আহত, ২০১৭ সালে ৪ হাজার ৯৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৩৯৭ জন নিহত, ১৬ হাজার ১৯৩ জন আহত, ২০১৮ সালে ৫ হাজার ৫১৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ২২১ জন নিহত, ১৫ হাজার ৪৬৬ জন আহত, ২০১৯ সালে ৫ হাজার ৫১৬টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৭ হাজার ৮৫৫ জন নিহত, ১৩ হাজার ৩৩০ জন আহত, ২০২০ সালে করোনা সংক্রমণে বছরব্যাপী লকডাউনে পরিবহন বন্ধ থাকা অবস্থায় ৪ হাজার ৮৯১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬ হাজার ৬৮৬ জন নিহত ও ৮ হাজার ৬০০ জন আহত হয়েছেন। অর্থাৎ গত ছয় বছরে ৩১ হাজার ৭৯৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৩ হাজার ৮৫৬ জন নিহত ও ৯১ হাজার ৩৫৮ জন আহত হয়েছেন। অথচ জাতিসংঘ ২০১১ সাল থেকে ২০২১ সালকে সড়ক নিরাপত্তা দশক ঘোষণা করে সদস্য দেশগুলোর সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার অনুস্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এ অঙ্গীকার রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। বিবৃতিতে সড়কে নিরাপত্তামূলক র্কমসূচির বাজেট বাড়ানো, গবেষণা, সভা-সেমিনার, প্রচারের মাধ্যমে গণসচতেনতা তৈরির পাশাপাশি সড়কে ‘চাঁদাবাজি বন্ধ করারও দাবি জানান তিনি। এছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) এবং ট্রাফিক বিভাগের ‘অনিয়ম-দুর্নীতি’ বন্ধ করাসহ র্দীঘদিন ধরে আটকে থাকা ১২ লাখ ড্রাইভিং লাইসেন্স দ্রুত চালকদের হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করার দাবী তোলে যাত্রী কল্যান সমিতি।