পথে পথে হামলা-হয়রানির অভিযোগ বিএনপির

25

নিজস্ব প্রতিবেদক

নগরীর পলোগ্রাউন্ড ময়দানে বিএনপির সমাবেশে যাওয়ার পথে নগরীতে প্রবেশ করার পয়েন্টগুলোতে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। দিনভর এমন অভিযোগ করেছে বিএনপি নেতাকর্মীদের তরফে। আইন শৃংখলা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের তরফে পথে পথে বিভিন্নভাবে বাধা প্রদান করা হয়েছে বলে বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতারা। এদিকে একাধিক চেকপোস্ট বসিয়ে দলটির শত শত নেতা-কর্মীকে পুলিশ গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গতকাল বুধবার পটিয়া উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিব মোহাম্মদ খোরশেদ আলম এ অভিযোগ করেন। গতকাল বিকেলে পলোগ্রাউন্ড ময়দানে বিএনপির সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।
স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী ও বিএনপি নেতাকর্মীরা জানান, সকাল সাড়ে ১০টার পর থেকে পটিয়ার গিরিশ চৌধুরী বাজার এলাকার বাইপাস সড়ক, নতুন ব্রিজ ও ইন্দ্রপুল এলাকায় পুলিশ চেকপোস্ট বসিয়ে পটিয়াসহ দক্ষিণের বিভিন্ন উপজেলা থেকে বিভিন্ন যানবাহনে করে সমাবেশে যাওয়ার পথে হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে নামিয়ে দেয় পুলিশ। যাদের যেখানে নামিয়ে দেওয়া হয়, তারা সেখান থেকে হেঁটে আবার সমাবেশের পথে রওনা হন। হাজার হাজার নেতা-কর্মী সমাবেশে যাচ্ছেন।
এদিকে বিএনপি নেতাকর্মীরা অভিযোগ করে বলেছেন, সমাবেশে যাওয়ার জন্য উপজেলা বিএনপির পক্ষ থেকে কয়েক দিন আগে পটিয়া থেকে শতাধিক বাস রিজার্ভ করা হয়। কিন্তু পুলিশ ও সরকারি দলের বিভিন্ন ভয়ভীতির কারণে গত মঙ্গলবার গাড়ির চালকেরা টাকা ফেরত দিয়ে সমাবেশে যেতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে তারা বিকল্প হিসেবে ট্রাক ও মিনিবাস ভাড়া করে সমাবেশে যাচ্ছিলেন। দুই দিন ধরে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও পৌর এলাকায় রাতে তাদের বিভিন্ন নেতা-কর্মীর বাড়িতে পুলিশ গিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়েছে বলেও অভিযোগ করা হয়।
এই বিষয়ে পটিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রেজাউল করিম মজুমদার জানান, নগরীর পলোগ্রাউন্ডে বিএনপির সমাবেশে যাওয়ার পথে বাধা দেওয়া কিংবা কোনো যানবাহন থেকে তাদের নেতা-কর্মীদের নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। বরং বিএনপিকে সহযোগিতা করা হচ্ছে। সরকার সমাবেশের অনুমতি দিয়েছে বলেই এই সহযোগিতা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে বুধবার সকাল ১১টার দিকে সরেজমিনে পটিয়ার বাইপাসের মুখ ইন্দ্রপুল এলাকায় পুলিশের চেকপোস্ট দেখা যায়। চট্টগ্রামমুখী বিভিন্ন যানবাহনের কাগজপত্র দেখছিলেন পুলিশ সদস্যরা। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের কোষাধ্যক্ষ মোহাম্মদ ইয়াছিন বলেন, পাঁচ দিন আগে বিএনপির পক্ষ থেকে বিলাসী ও মিনিবাসসহ ৬০টি বাসভাড়া করেছিলেন বিএনপির নেতারা। সমাবেশে গÐগোল হতে পারে, এ জন্য গাড়ি ভাঙচুরের আশঙ্কায় ভাড়ার টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, পুলিশের গুলিতে ৫ নেতাকর্মী নিহত ও খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে গতকাল বুধবার চট্টগ্রামে বিভাগীয় সমাবেশের ডাক দিয়েছে বিএনপি। বিএনপি নেতাকর্মীদের অভিযোগ, সাদা পোশাকে ডিবি ও থানা পুলিশ তাদের গাড়ি চেক করেছে। গাড়ির কাগজপত্র চেক করার নামে হয়রানি করা হয়েছে। এতে বিএনপির অধিকাংশ নেতাকর্মী সমাবেশ স্থলে উপস্থিত হতে পারেননি। সমাবেশে আসা অনেকগুলো গাড়িকে মাঝপথে উল্টো দিকে ফেরত পাঠানো হয়েছে।
এই বিষয়ে খাগড়াছড়ি পৌর যুবদলের যুগ্ম আহŸায়ক আব্দুল মান্নান বলেন, সমাবেশে যোগ দেয়ার পথে মাটিরাঙা, মানিকছড়ি ও মিরসরাইয়ের বারইয়ারহাটের বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ ও যুবলীগ-ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের গাড়ি আটকায়। তারা কোথায় যাবেন, কেন যাবেন এবং তাদের পরিচয় জানতে চেয়েছেন। এছাড়া মাটিরাঙায় কিছু গাড়ি ভাঙচুরের অভিযোগ করেছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা।
টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের দক্ষিণ শাখার সভাপতি এবং টেকনাফ উপজেলা বিএনপির সদস্য আবু সিদ্দিক বলেন, তারা সকালে রওনা দেওয়ার পর লোহাগড়া উপজেলার আমিরাবাদ এলাকায় পৌঁছালে পুলিশ ও যুবলীগ নেতাকর্মীরা তাদের আটকে দেয় এবং গাড়ির কাগজপত্র ছিনিয়ে নেয়। পরে কয়েকটি গাড়ি ছেড়ে দিলেও বেশকিছু গাড়ি আটকে দেয়। ১০ বছর পর চট্টগ্রামে বিএনপির মহাসমাবেশ অনুষ্ঠিত হল। সর্বশেষ ২০১২ সালের ৯ জানুয়ারি বিএনপির সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছিলো এই পলোগ্রাউন্ডে। ওই সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন দলটির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া।
এদিকে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহŸায়ক নুরুল আমিন জানান, সকালে মহাসমাবেশে যোগ দিতে আসার পথে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ কর্মীদের হামলায় অন্তত ৪০ জন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। সকাল ৯টার দিকে মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ ও বারাইয়ার হাটে এই হামলার ঘটনা ঘটে।
মিরসরাইয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন স্পটে গাড়ি তল্লাশি ও ভাঙচুরের অভিযোগ পাওয়া গেছে। সরকারি দলের হামলায় বিএনপির অন্তত ১০ নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। গতকাল বুধবার ভোর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের নেতাকর্মীরা অবস্থান নিয়ে চট্টগ্রামমুখী গাড়ি তল্লাশি করে এবং কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে। বারইয়ারহাটে হামলায় আহত হয়েছেন বারইয়ারহাট পৌরসভার সাবেক প্যানেল মেয়র ও পৌর বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক জসীম উদ্দিন (৫০), হিঙ্গুলী ইউনিয়ন বিএনপির আহবায়ক কাজী ছালেহ আহম্মদ (৫২), পৌর বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক সেলিম হাজারী (৫০), বিএনপি নেতা জাফর আলম লিটন (৪০) সহ ১০ জন। আহতদের উপজেলার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এদিকে মিরসরাই থানার সামনে চেকপোস্ট বসিয়ে মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মিনহাজুর রহমানের নেতৃত্বে চট্টগ্রামমুখী গাড়ি তল্লাশি করেছে পুলিশ। মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা সকাল থেকে অবস্থান নেন এবং লাঠিসোটা নিয়ে মোটরসাইকেল মহড়া দেন।
উপজেলা বিএনপির আহবায়ক শাহীদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বারইয়ারহাটে আমাদের ৪ নেতাসহ উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হামলায় অন্তত ১০ জন নেতাকর্মী আহত হয়েছে। এছাড়া গত মঙ্গলবার থেকে বিভিন্ন জায়গায় সরকারি দলের লোকজন মহড়া দিচ্ছে। উপজেলার সমস্ত বাস, মাইক্রো, হাইসের মালিক ও চালকদের বিএনপির ভাড়া না ধরতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বুধবার সকাল থেকে বারইয়ারহাট, জোরারগঞ্জ, ঠাকুরদীঘি, মিরসরাই সদর, বড়তাকিয়া, কমলদহ, ডাকঘর, নিজামপুর কলেজ, বড়দারোগাহাটে বিভিন্ন গাড়ি তল্লাশি করে উল্টোপথে পাঠিয়ে দিচ্ছে সরকারি দলের লোকজন। কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে।
ফেনীর দাগনভূঁইয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি আকবর হোসেন জানান, মিরসরাইয়ের নিজামপুর কলেজের সামনে আমার গাড়িবহরে হামলা চালিয়ে ৭টি গাড়ি ভাঙচুর করেছে ছাত্রলীগ-যুবলীগ। এসময় সরকার দলীয় ক্যাডারদের হামলায় দাগনভূঁইয়া উপজেলা যুবদল আহ্বায়ক কবির আহমেদ ডিপলু, যুগ্ম আহ্বায়ক দিদার, ছাত্রদলের আহ্বায়ক রাজিব, যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ, ফেনী পৌর ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মেহেদী, ছাত্রনেতা রিপন, শুভসহ প্রায় ৩০ নেতাকর্মী হামলার শিকার হয়।
এদিকে মহানগর বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে চট্টগ্রাম মহানগরীর পলোগ্রাউন্ড মাঠে মহাসমাবেশের প্রস্তুতি উপলক্ষে বিএনপির বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী জড়ো হন। প্রস্তুতি দেখতে আসা এসব নেতাকর্মীদের মধ্যে অন্তত পাঁচজন নেতাকর্মীকে পুলিশ পলোগ্রাউন্ডের সামনে থেকে ধরে নিয়ে গেছে। এছাড়া রাত ১টার দিকে নগরীর আকবরশাহ থানা বিএনপির সহসভাপতি রেহান উদ্দিন, যুববিষয়ক সম্পাদক আরিফ চৌধুরী ও স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা পারভেজসহ অন্তত ১০ জন নেতাকর্মীকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে গেছে পুলিশ।
এই বিষয়ে খুলশী থানার ওসি সন্তোষ কুমার চাকমা বলেন, ওয়ারেন্টসহ চলমান মামলা ও তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ধরতে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। অযথা কাউকে হয়রানি করা হচ্ছে না।
অন্যদিকে মহাসমাবেশে যোগ দিতে চট্টগ্রাম বিভাগের খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, বান্দরবান, কক্সবাজার, ফেনী নোয়াখালীসহ ১০টি ইউনিট থেকে আসতে ইচ্ছুক বিএনপি নেতাকর্মীদের গাড়ি দিতে চাইছে না স্থানীয় বাসমালিক সমিতি।
বিএনপি নেতারা অভিযোগ করেছেন, তাদের ভাড়া করা শত শত বাস ও গাড়ি না দিতে মালিক সমিতিকে দিতে নিষেধ করে দিয়েছেন বিভিন্ন সাংগঠনিক ইউনিটের আওয়ামী লীগ নেতারা। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন খাগড়াছড়ি জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া। মঙ্গলবার রাতে এ বিষয়ে তিনি ফেসবুকেও স্ট্যাটাস দেন। তিনি লেখেন, ১২ তারিখে বিএনপির চট্টগ্রাম সমাবেশে যোগদানের জন্যে ভাড়া করা শত শত বাস-গাড়ি খাগড়াছড়ি আওয়ামী লীগ, মালিক সমিতিকে দিতে নিষেধ করে দিয়েছে। ফলে মালিক সমিতি গাড়ি দিতে রাজি হচ্ছে না। আমরা মালিক সমিতিগুলোকে অনুরোধ করছি, কারো ভয়ে ভীত না হয়ে ব্যবসায়িক নিয়ম অনুযায়ী বাস ভাড়া দিতে। কিন্তু তারা ভীত হয়ে পড়েছেন। এছাড়া মিরসরাই, সীতাকুÐ, পটিয়া ও হাটহাজারী উপজেলার বিএনপি নেতাকর্মীদের মহাসমাবেশে না যেতে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা মাইকিং করে হুমকি দিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপি নেতারা।
এই বিষয়ে চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবু বক্কর অভিযোগ করেন, চট্টগ্রামে বিএনপির জনসমাবেশে উত্তাল জনস্রোত ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বাড়ি বাড়ি হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। বাস-গাড়ি ভাড়া না দিয়ে নেতাকর্মীদের ঠেকাতে চেষ্টা করেছেন।
এদিকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (দক্ষিণ বিভাগ) নোবেল চাকমা জানান, রাস্তায় যাতে কোনো বাধা সৃষ্টি না হয় এবং কোনো ধরনের অরাজকতা না হয় সে বিষয়ে পুলিশ কাজ করছে। যদি কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে তাহলে পুলিশ আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে বলেও জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা।