পতেঙ্গা সৈকত নিয়ে সিডিএ’র সাথে বিরোধ তুঙ্গে!

61

নিজস্ব প্রতিবেদক

পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের একটি অংশ বেসরকারি খাতে দিতে চায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। সাড়ে ৬ কিলোমিটার সৈকত এলাকার মধ্যে দেড় কিলোমিটার যাবে বেসরকারি খাতে। সেখান থেকে যে আয় হবে, সে টাকায় পুরো সৈকতের ব্যয় নির্বাহ করবে সিডিএ। ইতিমধ্যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে দরপত্রও জমা নেয়া হয়েছে। কিন্তু সৈকতের অংশ বেসরকারি খাতে দেয়া নিয়ে আপত্তি তুলেছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও সুশীল সমাজ। সৈকতের অংশ ইজারা দেয়া নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে যুক্তিও তুলে ধরছেন অনেকে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেছেন, সর্বজনের উন্মুক্ত স্থান পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের একাংশ উন্নয়নের নামে ইজারাদান ও টিকেট ধার্য করলে সর্বজনের স্বীকৃত প্রবেশাধিকার হরণ হবে, প্রাকৃতিক সৈকতের বিকৃতি ঘটবে, একই সৈকতে দুই ধরনের বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা সৃষ্টি হবে।
সিডিএ বলছে, সৈকত ইজারা দেয়ার কথা ঠিক নয়। সাড়ে ৬ কিলোমিটার সৈকতের মধ্যে দেড় কিলোমিটারের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে বেসরকারি খাতে। যথাযথ প্রক্রিয়া সম্পন্ন কওে ওই অংশটুকু প্রাইভেট জোন হিসেবে ইজারা দেয়া হবে। বাকি সৈকত সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে। প্রাইভেট জোনের আয় থেকে পুরো সৈকতের ব্যবস্থাপনা ব্যয় বহন করা হবে। প্রাইভেট জোনের দায়িত্বপ্রাপ্ত অপারেটর নির্ধারিত অংশে নিজেদের মতো করে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা তৈরি করবে। পর্যটকদের জন্য ওয়াশরুম থেকে শুরু করে ফুড কর্নারসহ পর্যটন বান্ধব পরিবেশ তারা নিশ্চিত করবেন। শুধু তাই নয়, ওই অংশের আয় থেকে পুরো সৈকত এলাকার রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব তারা নিবেন। ইতিমধ্যে পতেঙ্গা সৈকতের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দিতে টেন্ডার আহŸান করা হয়েছে। আগামী সপ্তাহে টেন্ডার মূল্যায়ন ও যাচাই-বাছাইয়ের কাজ শুরু হবে। এরপর কোন একটি প্রতিষ্ঠানকে সৈকতের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়া হতে পারে।
পতেঙ্গায় অনেক পর্যটক আসছে। আন্তর্জাতিক পর্যটন কেন্দ্রের সুবিধা দিতে সিডিএ কিছু অংশ বেসরকারি খাতে দিতে চায়। যেখানে বেসরকারি কোম্পানি শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। তাদের টাকায় সৈকতের ব্যবস্থাপনা হবে, লাভের একটি অংশও সিডিএ পাবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, আমরা পুরো পতেঙ্গা সৈকতের উন্নয়ন করেছি। সৈকতের পরিধি বাড়ানো হয়েছে। সৈকতের ভূমির মালিক ভূমি মন্ত্রণালয়, আমরা আবেদন করেছি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাথেও কথা হয়েছে। সৈকতের পরিবেশ আরও উন্নত করতে হবে। লাইটিং, টয়লেট, নিরাপত্তাসহ সৈকতের ব্যবস্থাপনার দরকার। সাড়ে ৬ কিলোমিটার সৈকতের মধ্যে আমরা দেড় কিলোমিটার এলাকা বেসরকারি খাতের পরিচালনায় দিচ্ছি। এটি ইজারা নয়, ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়া। সৈকতের পরিবেশ ঠিক রাখতে ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করবে তারা।
তিনি বলেন, পতেঙ্গাকে আমরা একটি পর্যটন জোন হিসাবে ঘোষণা করতে চাই। মাস্টারপ্ল্যানে সেটি অন্তর্ভুক্ত করা হবে। সৈকত এলাকার আশপাশের সবকিছু পর্যটন কেন্দ্রিক হতে হবে। পর্যটন কেন্দ্রিক ছাড়া সেখানে অন্য কোন কিছুর অনুমোদন দেয়া হবে না।
এদিকে সৈকতের একটি অংশ সেসরকারি খাতে দেয়া হলে সাধারণ মানুষের প্রবেশাধিকারের অধিকার খর্ব হবে বলে মনে করছেন অনেকে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তি সৈকতের অংশ ইজারা দেয়ার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। স্থানীয়রা প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকেও প্রতিবাদ জানানো হয়েছে।
তাদের মতে, পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত চট্টগ্রামের সর্বশেষ উন্মুক্ত বিনোদন কেন্দ্র। শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমÐিত যতস্থান ছিল, উন্নয়নের নামে প্রায় সবগুলো একে একে ধ্বংস করা হয়েছে। সর্বশেষ স্থান হিসাবে পতেঙ্গা সৈকতকে বেসরকারি খাতে দেয়া থেকে রক্ষা করতে হবে।
পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহসভাপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ প্রকৌশলী সুভাষ বড়–য়া বলেন, পতেঙ্গা সৈকত ইজারা দেয়ার ক্ষেত্রে চট্টগ্রামের নাগরিকদের কোন অংশের মতামত নেওয়া হলো না, যা সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক। সুশাসন, জবাবদিহিতার অভাব থাকলে এটা হয়। জনগণের স্বার্থে উন্নয়ন করতে হলে, তা সর্বজনীন হতে হবে। পরিচ্ছন্নতা, চেঞ্জিং রুম ইত্যাদির খোঁড়া অজুহাতে পতেঙ্গা সৈকতকে ইজারা দেয়া বন্ধ করতে হবে। আমাদের চাই উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান, পার্ক, খেলার মাঠ, সমুদ্র সৈকত। অথচ এসবের উপর চলছে নির্বিচারে হামলা।
অবশ্য বেসরকারি খাতে দেয়ার মাধ্যমে সৈকতের বিনোদন সুবিধা ও নিরাপত্তা বাড়বে বলে মনে করেন নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি আশিক ইমরান। তিনি বলেন, পতেঙ্গা হচ্ছে নগরীর মধ্যে উন্মুক্ত বিনোদনের একমাত্র জায়গা। কিন্তু সেখানে পর্যাপ্ত নাগরিক সুবিধা অর্থাৎ- টয়লেট, চেঞ্জিং রুম এবং পার্কিংয়ের জায়গা নেই। এছাড়া চারদিকে প্রচুর ময়লা-আবর্জনায় ভর্তি। এই পতেঙ্গা সৈকতকে রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য সিডিএর কোন ফান্ড নেই। এমন কি সেখানে যে সড়কবাতি আছে, সেগুলোর বিদুুৎ বিল দেয়ার জন্যও সিডিএর কোন ফান্ড নেই। শহরের এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা অযত্নে-অবহেলায় পড়ে আছে। মানুষ এটা যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারছে না।
ভিন্নমত পোষণ করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আকতার কবির চৌধুরী বলেন, সরকারি জায়গা সিডিএ চাইলেই বেসরকারি অপারেটরের হাতে তুলে দিতে পারে না। পুরো পতেঙ্গা এলাকা সিডিএ’র সম্পত্তি না। পতেঙ্গা হচ্ছে নগরবাসীর একমাত্র উন্মুক্ত বিনোদনের জায়গা। নগরবাসী স্বস্তির আশায় দূর-দূরান্ত থেকে পতেঙ্গায় ছুটে আসে।