পটিয়া থেকে জামালখান খুন খারাবি থেমে নেই রমজানেও

100

তুষার দেব

সিয়াম সাধনার মাস পবিত্র রমজানেও থেমে নেই খুন-খারাবির মত গুরুতর ও ভয়ঙ্কর অপরাধ। আধিপত্য বিস্তার কিংবা স্বার্থের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে এক পক্ষ হামলা চালাচ্ছে অন্য পক্ষের উপর। মারামারি ছাপিয়ে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে কেড়ে নিচ্ছে তাজা প্রাণ। তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে পরস্পরকে হত্যা করতেও দ্বিধা করছে না অনেকে। সংবাদ মাধ্যমে এ সংক্রান্ত প্রকাশিত খবরগুলো যেমন জনমনে নাড়া দিচ্ছে, তেমনি ইন্টারনেটভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুলছে। রমজানেও এ ধরনের খুনখারারিতে লিপ্ত হওয়ার ঘটনা সামাজিক নিরাপত্তার জন্য ভয়ঙ্কর এলার্মিং বলে মনে করছেন অপরাধ ও সমাজ-বিশ্লেষকরা।
পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যগুলো পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, পবিত্র রমজান মাস শুরু হওয়ার পর গত ২৩ দিনে নগরী ও জেলার বিভিন্ন স্থানে অন্যান্য অপরাধ ছাড়াও বেশ কয়েকটি খুনোখুনির ঘটনা ঘটেছে। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে কেউ কেউ প্রাণে বেঁচে গেলেও হাসপাতালে দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। প্রতিটি হত্যাকাÐের পেছনে রাজনৈতিক সংশ্রবের পাশাপাশি পরস্পরের মধ্যে এলাকাভিত্তিক আধিপত্য বিস্তার ও স্বার্থের সংঘাত রয়েছে। এসব ঘটনার মধ্যে বিভিন্ন মহলে সবচেয়ে বেশি আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুলেছে সর্বশেষ গত ২২ এপ্রিল নগরীর সংস্কৃতি ও মিডিয়া পাড়া হিসেবে পরিচিত চেরাগী মোড় এলাকায় কলেজ শিক্ষার্থী আসকার ইবনে তারেক ইভান (১৮) এবং একই রাতে পটিয়ার কাশিয়াইশ ইউনিয়নের বুধপুরা বাজার এলাকায় স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কাসেমের ছোটভাই মোহাম্মদ সোহেল (৩০) কে ছুরিকাঘাতে হত্যার ঘটনা। এর আগে গত ১৭ এপ্রিল দিবাগত রাত সাড়ে এগারটার দিকে নগরীর নাসিরাবাদের সানমার ওশান সিটির পাশে কেএফসির আউটলেটের সামনে প্রতিপক্ষের ছুরিকাহত হন রাজু আহমেদ। তিনি এখনও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। একইভাবে গত ১৯ এপ্রিল রাতে পটিয়ার জঙ্গলখাইনের আমজুর হাট এলাকায় আধিপত্য বিস্তার ও পূর্ব বিরোধের জের ধরে প্রতিপক্ষের দুর্বৃত্তরা উপজেলা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডিএম জমির উদ্দিন, সাইফুল ইসলাম সাইফু ও সাবেক ছাত্রনেতা ইকবাল হোসনকে লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করে। এতে তাদের শরীরে রক্তাক্ত জখম হলেও প্রাণে বেঁচে যান। দেখা গেছে, প্রতিটি ঘটনার পেছনেই রাজনৈতিক সংশ্রব এবং এলাকাভিত্তিক বিবদমান দুটি পক্ষের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার ও স্বার্থগত বিরোধ রয়েছে। ঘটনাগুলো সাধারণ মানুষের মধ্যেও ভীতির সঞ্চার করেছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি এডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী পুর্বদেশকে বলেন, আমাদের দেশে কিংবা সমাজে স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকেই আসলে খুনের রাজনীতি ধীরে ধীরে ওপেন সিক্রেট রূপ নিয়েছে। এমনকি রাষ্ট্রীয় মদদে কলঙ্কজনক হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে। এখন খুন-খারাবি তো একেবারেই মামুলি ব্যাপার। সুস্থ রাজনীতির চর্চা যদি অনুপস্থিত থাকে, তাহলে রাজনীতির নামে এ ধরনের জঘন্য অপরাধ সংঘটিত হতেই থাকবে। তার ওপর খুন কিংবা যে কোনও অপরাধ সংঘটিত করেও পার পেয়ে যাওয়া বা পাইয়ে দেয়ার সংস্কৃতিই যদি প্রতিষ্ঠা করা হয়, তাহলে দেশের মানুষ অরাজকতায় নিপতিত হবে। এই সর্বগ্রাসী অপ-রাজনীতি কাউকেই বাঁচতে দেবে না। অসুস্থ বা অপ-রাজনীতির সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হল হত্যাকান্ড। এটা সভ্য ও গণতান্ত্রিক সমাজে কাম্য হতে পারে না। যারা খুনের মত ভয়ঙ্কর অপরাধ সংঘটিত করে তাদের পরিচয় খুনি। তাদের কোনও রাজনৈতিক পরিচয় থাকতে পারে না। ওরা সম্পূর্ণ ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠী স্বার্থেই এসব হত্যাকান্ড সংঘটিত করেছে, প্রকৃত ও সুস্থ রাজনীতির স্বার্থে নয়। তাই প্রতিটি হত্যাকান্ডের সঠিক তদন্ত এবং জড়িতদের শাস্তি নিশ্চিত করা জরুরি।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রযুক্তিনির্ভর বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে সমাজের বিত্তশালী ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের উঠতি বয়সী কিশোর-তরুণরা নিজেদের গ্রুপ গঠন করছে। এরপর তুচ্ছ বিষয়েও এক গ্রুপ অন্য গ্রুপের সাথে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে হত্যাসহ নানা অপরাধ সংঘটিত করছে। পশ্চিমা বিশ্বে ‘গ্যাং কালচার’ নামে পরিচিত এই বিজাতীয় সংস্কৃতির ভয়ঙ্কর আগ্রাসনে নিজেদেরকে ক্রমেই অভ্যস্ত করে তুলছে চট্টগ্রামসহ দেশের উঠতি বয়সীরা। পরিবারিক ও সামাজিক পর্যায়ে এই বিষয়ে সচেতন না হলে গ্যাং কালচারের এই প্রবণতা জঙ্গি বা উগ্রবাদী কর্মকান্ডে জড়ানোর মত ভয়ঙ্কর রূপ লাভ করতে পারে। প্রযুক্তির প্রসারতার যুগে এসে কিশোর-তরুণদের অনেকেই ফেসবুকসহ নানা যোগাযোগ মাধ্যমে নিজেদের গ্রুপ গঠন করে অস্তিত্ব ও কর্মকান্ডের জানান দিচ্ছে। কেউ তাদেরকে প্রশ্রয় বা মদদ দিয়ে বিপথগামী করে তুলছে, আবার স্বার্থগত দ্বন্দ্বের জেরে তাদের কোনও কোনও গ্রুপ সহিংস-সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে। কেউ কারও দিকে না তাকিয়ে আত্মকেন্দ্রিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ার তিক্ত ও ভয়ঙ্কর ফলই এখন সমাজ ও রাষ্ট্র পেতে শুরু করেছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও সমাজবিজ্ঞানী ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী বলেন, নগরায়নের নানা অনুষঙ্গ পরিবর্তনের সাথে সাথে বিভিন্ন দেশে গ্যাং কালচার তৈরি হতে আমরা দেখেছি। অনেক সময় বঞ্চনা থেকেও কিশোরদের মধ্যে এমন দল গড়ে ওঠে। আবার কোথাও কোথাও বীরত্ব বা হিরোইজমের বশবর্তী হয়ে উঠতি বয়সী ছেলেদের কেউ কেউ মাস্তানিতে যুক্ত হয়। এটা সমাজে সবসময়ই অল্প-বিস্তর ছিল। তবে বর্তমানে সেটার ভয়ঙ্কর সহিংস রূপ দেখতে পাচ্ছি। খেলার মাঠে কিংবা তুচ্ছ ঘটনায় কিশোরদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সেটা যাতে সহিংসতা বা খুনোখুনির মত ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে না যায়, সে ব্যাপারে এলাকার মুরব্বি ও অভিভাবকদের দায়িত্ব নিতে হবে। কিশোর-তরুণদের গঠনমূলক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে।
নগর পুলিশের দক্ষিণ অঞ্চলের উপ কমিশনার (ডিসি) জসিম উদ্দিন বলেন, খুন-খারাবিসহ যে কোনও ধরনের অপরাধ দমনে পুলিশ সবসময় মাঠে রয়েছে। কিন্তু আমাদের অভিভাবক থেকে শুরু করে সমাজের সকলকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখতে হবে। আর যাই হোক না কেন, অপরাধীরা সংখ্যায় বেশি নয়। তাই সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তাদের মূলোৎপাটন করা অসম্ভব কিছু নয়।