পটিয়ায় শামসুর সাম্রাজ্যে নিকটাত্মীয়দের আধিপত্য

623

ওয়ান ইলেভেনের পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুফল তুলে ২০০৮ সালে জাতীয় নির্বাচনে পটিয়া থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন শামসুল হক চৌধুরী। সেই থেকে শুরু। আর পিছনে তাকাতে হয়নি। ২০১৪ ও ২০১৯ এর দুই জাতীয় নির্বাচনেও জয়ী হয়ে এখন জাতীয় সংসদের হুইপ। আওয়ামী লীগ যখন টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় তখন ‘হ্যাটট্রিক’ এমপি শামসু। আওয়ামী লীগে নিজের অবস্থান পাকাপোক্ত হয়েছে। পটিয়ায় এখন হুইপ শামসু ও তার নিকটাত্মীয়দের একচ্ছত্র আধিপত্য।
পটিয়ার ভ‚মিদখল, থানা-কোর্ট, ভূমি অফিস, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, শিল্পজোনের নিয়ন্ত্রণ সবখানেই শামসুর নিকটাত্মীয়দের বিচরণের অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে হুইপ শামসুল হক চৌধুরীকে গতকাল সন্ধ্যা ৭টায় ফোন দেওয়া হলে এক ব্যক্তি ফোন ধরে বলেন, ‘এমপি সাহেব শেখ কামাল ফুটবল টুর্নামেন্টের সভায় আছেন। দুই ঘণ্টা পর ফোন করেন।’ পরে ফোন দিলেও তিনি আর রিসিভ করেননি।অনুসন্ধানে জানা যায়, শামসুল হক চৌধুরীর এপিএস পরিচয়দানকারী এজাজ চৌধুরীর বাবার গোডাউনে কয়েকবছর আগে সে সময়ে ইয়াবার বড় চালানটি ধরা পড়েছিল। যা গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রকাশ পেয়েছিল। এমপির ক্ষমতার দাপটে এজাজ গড়ে তুলেছেন কিশোর গ্যাং। ছাত্রলীগের নিয়ন্ত্রণ নিয়েও এলাকায় দাপট দেখান এজাজ।
এমপির ভাই নবাবের কথার বাইরে শিল্পজোনে কেউ কিছু ঢুকাতেও পারে না কিংবা বের করতেও পারে না। স্ক্র্যাপ ব্যবসা ও সাপ্লাই সব তার নিয়ন্ত্রণে। বিরোধীয় জায়গা নিয়ে অনেকেই থানায় অভিযোগ করলেও একপক্ষে অবস্থান নিয়ে থানাকে ব্যবহার করে বিরোধীয় জমি নিজের আয়ত্বে নিয়ে নেন।
ভাগিনা লোকমান বিগত সময়ে উপজেলার আরএফপির সব কাজের নিয়ন্ত্রণ করেছেন। কমিটি করে টেন্ডার ছাড়াই কোটি কোটি টাকার কাজ করেছেন লোকমান।
বোন রেখা চৌধুরী থানার বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে বাদি-বিবাদি উভয় পক্ষের কাজ থেকে টাকা নিয়ে সমাধান করেন। ঠিকাদারদের কাজ থেকে কমিশন আদায় ও পোশাক কারখানায় গাড়ি সরবরাহ করেন রেখা।
ভাই ফজলুল হক চৌধুরী মজনু শোভনদন্ডী, খরনা, ভাটিখাইন ও কচুয়াই এলাকায় আধিপত্য দেখান। সব বিতর্কিত কাজেই তাদের অবস্থান থাকে। বাকি যেসব অনুচর এলাকায় দাপিয়ে বেড়ান তারা এই নিকটাত্মীয়ের মাধ্যমেই সব কাজ করেন।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, পটিয়ার আশিয়া, জঙ্গলখাইন, কাশিয়াইশ, হাইদগাও, কেলিশহর, কচুয়াই, খরনাসহ বিভিন্ন এলাকার ফসলি জমির টপ সয়েল বিক্রি করে কোটি টাকা অবৈধ আয় করেছেন হুইপের ভাই মুজিবুল হক চৌধুরী প্রকাশ নবাব। যা নিয়ে পটিয়া থানার সম্প্রতি বদলি হওয়া ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সাথে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন নবাব। বিষয়টি নিয়ে পুলিশ প্রশাসনে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
কর্ণফুলী উপজেলার মইজ্যারটেকে জাহাঙ্গীর চেয়ারম্যানের সাথে বিরোধে জড়িয়ে আলোচনায় আসেন নবাব। এছাড়াও শামসুল হকের কথা মতো বিভিন্ন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কমিটি না দেওয়ায় রাশেদ মনোয়ার-নাছির উদ্দিনের নেতৃত্বে উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটি ভেঙে দেন এমপি। পরে নিজের অনুগতদের দিয়ে নতুন কমিটি গঠন করেন। ২০০৯ সালে স্থানীয় পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে মাসব্যাপী মেলায় ঝুন্টু নামে এক ব্যক্তি জুয়া খেলার আয়োজন করেছিল। পরবর্তীতে মেলায় জুয়ার আয়োজন নিয়ে স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীরা প্রতিবেদন প্রকাশ করলে এমপির নির্দেশে চার সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা দেওয়া হয়। প্রায় আট বছর পর মামলাটি খারিজ করে দেয় আদালত।
পটিয়া আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিন পূর্বদেশকে বলেন, ‘সংসদ পটিয়ার রাজনীতিকে কুক্ষিগত করে রেখেছেন। ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের দূরে রেখেছেন। জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের লোকদের বিভিন্ন ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডে সভাপতি-সম্পাদক করে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি। সম্মেলন করে ১৭টি ইউনিয়নে ভোটে কমিটি করেছি। আমার কমিটি এক বছর তিন মাস কাজ করেছে। বাকিসময় এলাকায় কাজ করতে পারি নাই। আমাদের কোনটাসা করে রেখেছিল। কেন্দ্রকে ম্যানেজ করে অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সম্মেলন করে ফেলে। পরে যে কমিটি হয় তা একপেশে কমিটি। যেটি এখনো জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজ ভাই অনুমোদন দেননি।’
ভিন্ন ইস্যুতে বিপাকে শামসু :
প্রধানমন্ত্রী ক্যাসিনো ও জুয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে দলের ভেতর শুদ্ধি অভিযান চালানোর ঘোষণা দিয়েছেন। এরই অংশ হিসেবে ঢাকা ও চট্টগ্রামের ক্লাবগুলোতেও অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এতে সাধারণ মানুষ খুশি হলেও ক্ষেপে যান পটিয়া আসন থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ও হুইপ শামসুল হক চৌধুরী।
গত ২১ সেপ্টেম্বর হালিশহরে অবস্থিত চট্টগ্রাম আবাহনী লিমিটেড ক্লাবে অভিযান চালানোয় মান-ইজ্জতের ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেন হুইপ শামসুল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘ক্লাবে জুয়া খেলা হয় না, তাস খেলা চলে। এ খেলা থেকে আয়ের টাকায় ক্লাবগুলো খেলোয়াড়দের বেতন দেয়। তাস খেলা বন্ধ হলে ক্লাবগুলো কোনধরণের খেলাধুলায় অংশ নিতে পারবে না। প্রয়োজনে আন্দোলনে নামারও হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
হুইপ শামসুর এমন ক্ষুব্ধ মন্তব্যকে প্রধামন্ত্রীর ঘোষিত শুদ্ধি অভিযানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার সামিল আখ্যায়িত করে পাল্টা বক্তব্য দেন চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিন, দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান ও চট্টগ্রাম আবাহনীর প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব দিদারুল আলম চৌধুরী। নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী।
আওয়ামী লীগ নেতাদের এমন বক্তব্যের পর হুইপ শামসু তিন নেতার সাথে নিজের দূরত্বের কারণ ফাঁস করেন। আপাতত ভিন্ন এই ইস্যুতেই উত্তপ্ত চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের রাজনীতি। পক্ষে-বিপক্ষে থাকা এ চারজনের বাইরে গিয়ে আরো কয়েকজন নেতা নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করলেও পরোক্ষভাবে দুইপক্ষকে ইন্ধন যুগিয়ে যাচ্ছেন।
তবে নেতাদের দ্ব›দ্বকে ছাপিয়ে আপাতত রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন হুইপ শামসুল হক চৌধুরী। সাথে আছেন হুইপ পুত্র নাজমুল করিম চৌধুরী শারুনও। নগর আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক দিদারুল আলম চৌধুরীর সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ, শ্যুটিং ক্লাবে অস্ত্র ব্যবহার, মদের বোতলসহ ছবি ভাইরাল হলে ব্যাপক সমালোচিত হন শারুন। এমন কর্মকান্ডে যখন সমালোচনা চলছে তখনই চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে পটিয়ার নেতাকর্মীদের নিয়ে ‘অহেতুক’ শোডাউন দেন পিতা-পুত্র। অনেকের মতে, এ শোডাউন করে বিপক্ষে যাওয়া নেতাদের একটি বার্তা দিয়েছেন হুইপ।
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিন পূর্বদেশকে বলেন, ক্রীড়াঙ্গন একটি পবিত্র জায়গা। নিজের অপকর্ম ঢাকতে অনেকেই প্রধানমন্ত্রীর ভালো কাজগুলোকেও সমর্থন করছেন না। নানা অজুহাতে শুদ্ধি অভিযানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন। আমি নিজেও একটি ক্লাবের সাথে সম্পৃক্ত আছি। আমার ক্লাবে তো কোন ধরণের জুয়া চলে না।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান পূর্বদেশকে বলেন, উনি যাই করুক কখনো নেত্রীর বিরুদ্ধে যেতে পারেন না। নেত্রীর ইচ্ছানুযায়ী সারাদেশে ক্যাসিনো ও জুয়ার বিরোধী অভিযান চলছে। অথচ উনি জুয়ার পক্ষেই অবস্থান নিয়েছেন। এটা দলের জন্য ক্ষতিকর। এতকিছুর পরেও বিমানবন্দরে শোডাউন দেয়াটা শোভা পায় না। এটা আমাদের জন্য বিব্রতকর।
চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক দিদারুল আলম দিদার পূর্বদেশকে বলেন, শামসুকে আমিই আবাহনীতে এনেছিলাম। এখনো আমি আবাহনীতে আছি। ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে প্রিমিয়ার ব্যাংকের একাউন্ট যৌথভাবে চালাই। আমি একাউন্টটি বন্ধ করার আবেদন করায় শামসু ও তার ছেলে ক্ষেপেছে। আমি সংবাদপত্রে দেওয়া তার একটি বক্তব্যের সূত্র ধরে তাকে দশ কোটি টাকার মানহানির নোটিশ দিয়েছি। সাত দিনের মধ্যে বক্তব্য প্রত্যাহারের করতে বলেছি।
তিনি বলেন, বিএনপি, জাতীয় পার্টি থেকে এসে শামসু এখন আওয়ামী লীগের এমপি। সুখের দিনে দাপট দেখিয়ে সব লুটে নিচ্ছে। সে টাইপ মেশিন চুরি করে ১৭দিন জেল খেটেছিল। জিয়াউর রহমান তার নাম দিয়েছিল বিচ্ছু। আমি তো বড় গলায় বলেছি। সাহস থাকলে এসব নিয়ে পাল্টা বক্তব্য দিতে বলেন। প্রধানমন্ত্রী সব জেনে গেছেন। আপা বিদেশ থেকে আসলেই সব কথা হবে।