ন্যানো প্রযুক্তি এক অপার সম্ভাবনার নাম

52

অমল বড়ুয়া

বর্তমান যুগের নাম আনুবিক্ষণিক জাদুকরি ন্যানো টেকনোলজির যুগ। র্বুমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণায় ন্যানো প্রযুক্তি আজ এক অপার সম্ভাবনার নাম। ‘ন্যানো’ এই শব্দটি কিন্তু মূলত পরিমাপের একক। এটি অতিশয় ক্ষুদ্র একটি বিষয় যা আমরা খালি চোখে দেখতে পাইনা। এই ন্যানো বিষয়টি, যে কোন বিষয়কে এক অভিনব ভাবে প্রয়োগে সক্ষম করে তুলে। ন্যানো প্রযুক্তি বহুমাত্রিক, এর সীমানা প্রচলিত অর্ধপরিবাহী পদার্থবিজ্ঞান থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক আণবিক স্বয়ং-সংশ্লেষণ প্রযুক্তি পর্যন্ত, কিংবা আণবিক কাঠামোর নিয়ন্ত্রণ থেকে নতুন বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন ন্যানো-পদার্থের উদ্ভাবন পর্যন্ত বিস্তৃত। ন্যানো প্রযুক্তি হলো পারমাণবিক বা আনবিক স্কেলে অতি ক্ষুদ্র ডিভাইস তৈরি করার জন্য ধাতব ও বস্তুকে সুনিপূণভাবে কাজে লাগানোর বিজ্ঞান। ন্যানো প্রযুক্তি দুটি পদ্ধতিতে ব্যবহৃত হয়। একটি হচ্ছে ‘বটম আপ’ আর অপরটি হচ্ছে ‘টপ-ডাউন’ পদ্ধতি। ‘বটম-আপ’ পদ্ধতিতে ন্যানো ডিভাইস ও উপকরণগুলো আণবিক স্বীকৃতির নীতির উপর ভিত্তি করে আণবিক উপাদান দ্বারা তৈরি হয় এবং রাসায়নিকভাবে একিভ‚ত হয়। এই পদ্ধতিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আকারের ছোট জিনিস দিয়ে বড় কোনো জিনিস তৈরি করা হয়। ‘টপ-ডাউন’ পদ্ধতিতে একটি উপকরণ পরমাণু স্তরের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই বৃহৎ সত্ত¡া হতে গঠিত হয়। এই পদ্ধতিতে কোনো জিনিসকে কেটে ছোট করে তাকে নির্দিষ্ট আকার দেওয়া হয়। ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহারে চিকিৎসাবিজ্ঞান, ইলেক্ট্রনিক্স, শক্তি উৎপাদনসহ বহুক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরির্বুন সাধিত হয়েছে। কম্পিউটারের মেমোরি তথা হার্ডডিস্কের মেমোরির পরিসর বাড়ানো এবং হার্ডডিস্কের আকার ছোট করার কাজে ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার দৃষ্ট হয়। ন্যানো হচ্ছে গ্রিক শব্দ। যার আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে সু² বা ছোট বা ক্ষুদ্র। ন্যানো প্রযুক্তির মাধ্যমে অতি ক্ষুদ্র পদার্থকে বিশ্লেষণ করা যায়। ন্যানো প্রযুক্তির জনক হচ্ছেন আমেরিকান পদার্থবিদ রিচার্ড ফাইনম্যান। ১৯৫৯ সাল ২৯ ডিসেম্বর তিনি এক আলোচনায় সর্বপ্রথম এই ন্যানো প্রযুক্তি সম্পর্কে ধারণা দেন। ১ মিটারের ১০০ কোটি ভাগের এক ভাগ হচ্ছে ১ ন্যানোমিটার। আর এই এক ন্যানো মিটারের সাথে যে সকল টেকনোলজি সংযুক্ত রয়েছে সেগুলোকে ন্যানো প্রযুক্তি বলে। এই ন্যানো প্রযুক্তি পরিচালনা করে থাকে বিজ্ঞান এবং প্রকৌশল বিভাগ। ন্যানো প্রযুক্তি হলো পদার্থকে আণবিক পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ এবং পরির্বুন করার বিদ্যা। অনেকে আবার এই ন্যানো প্রযুক্তিকে ন্যানোটেক বলে থাকে। ১৯৯৯ সালে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উইলসন হো এবং তার ছাত্র জোজুন লি অণুকে জোড়া লাগানোর প্রক্রিয়া প্রদর্শন করেন। এতদিন পর্যন্ত অণু-পরমাণুর সংযোগ শুধু মাত্র রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমেই সংগঠিত হত। কিন্তু ন্যানো প্রযুক্তির মাধ্যমে অণু-পরমাণুকে ভেঙে কিংবা জোড়া লাগিয়ে অনেক কিছুই করার সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিল। ন্যানো প্রযুক্তি মূলত একটি আণবিক স্কেল দ্বারা পরিচালিত হয়। ন্যানো স্কেলে ১ থেকে ১০০ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। আর এর সাহায্যে বিজ্ঞান, যন্ত্রবিদ্যা এবং প্রযুক্তি সম্পর্কে জানা যায়। ন্যানো প্রযুক্তি পদার্থকে পারমাণবিক আণবিক পর্যায়ে পরির্বুন ও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ব্যবহার করা হয়। সাধারণত চিকিৎসা ক্ষেত্রে এবং শক্তি উৎপাদন ক্ষেত্রগুলোতে ন্যানো প্রযুক্তি পরির্বুন আনতে পারে। ন্যানো প্রযুক্তি অণু ও পরমাণুর প্রকৌশল পদার্থবিজ্ঞান জীববিজ্ঞান জৈবপ্রযুক্তি এবং রসায়ন সম্পর্কিত বিষয়গুলোকে একত্র করে থাকে। কারণ দিনদিন প্রযুক্তি অগ্রসর হচ্ছে। ইঞ্জিনের ন্যানো প্রযুক্তিগুলোর সাহায্যে এমন ঘর্ষণ হয় যার ফলে মেশিনের জীবন দীর্ঘমেয়াদি হয় এবং জ্বালানি খরচ কম হতে থাকে। ন্যানো প্রযুক্তির অনেক সুবিধা রয়েছে। আমাদের জন্য এই প্রযুক্তি খুবই উপযোগী। ন্যানো প্রযুক্তির দ্বারা তৈরিকৃত ব্যাটারি, ফুয়েল সেল, সোলার সেল ইত্যাদির মাধ্যমে সৌরশক্তিকে অধিকতর কাজে লাগানো যায়। ন্যানো প্রযুক্তি সব সময় স্থায়ী, মজবুত ও টেকসই এবং আকারে ছোট পণ্য তৈরি করে থাকে। প্রযুক্তির মাধ্যমে খাদ্য দ্রব্য সিলভার তৈরীর কাজে ব্যবহৃত হয়। ন্যানো প্রযুক্তি প্রয়োগের ফলে উৎপাদিত ঔষধ ব্যবহার করে দ্রæত আরোগ্য লাভ করা যায়। ইলেকট্রিক শিল্পের বৈপ্লবিক পরির্বুন আনা যায় (যেমন : ন্যানো ট্রানজিস্টর, প্লাজমা ডিসপ্লে, ন্যানো ডায়োড ইত্যাদি)। ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহার করে মহাকাশের নানা রকম যন্ত্রপাতি উৎপাদন করা হয়। ন্যানো প্রযুক্তি রোবট তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। কম্পিউটার হার্ডওয়ার তৈরিতে ন্যানো প্রযুক্তি উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা পালন করে। আর ন্যানো টেকনোলজির ব্যবহারের মাধ্যমে কম খরচে উৎপাদন হলেও জিনিস পত্রের গুনগত মান বৃদ্ধি পাবে এবং দ্রব্যম‚ল্য কমে যাবে। ব্যয় হ্রাস হলো ন্যানো টেকনোলজির প্রধান সুবিধা। চিকিৎসাবিজ্ঞানে ন্যানো প্রযুক্তি খুবই কার্যকর ভ‚মিকা রাখছে। ঔষধ তৈরির আণবিক গঠন, যাতে রোগাক্রান্ত কোষে সরাসরি ঔষধ প্রয়োগ করা যায়। ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনুভুতিসম্পন্ন কৃত্রিম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তৈরি করা সম্ভব। ন্যানো সেন্সর ব্যবহার করে মানবদেহের রক্তের ভেতর ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান বায়োমার্কার সম্পূর্ণভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে। ন্যানো সুঁচ ব্যবহার করে সুক্ষèভাবে শুধুমাত্র ক্যান্সার আক্রান্ত কোষে ঔষধ প্রয়োগ করে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করা যায়। শিল্পকারখানায়ও ন্যানো প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখে। শিল্পকারখানা থেকে নির্গত ক্ষতিকর ধোঁয়াকে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে অক্ষতিকর গ্যাসে রূপান্তরের মাধ্যমে বাতাস পরিশোধন করতে পারে। রাসায়নিক শিল্পে সানস্ক্রিন এ ব্যবহৃত টিটানিয়াম ডাই-অক্সাইড তৈরির কাজে ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। ইলেক্ট্রনিক্স শিল্পে বিদ্যুৎ খরচ, ওজন এবং আকৃতি কমিয়ে কার্যক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরণের ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রপাতি তৈরিতে ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহার করে অতি ক্ষুদ্র রোবট তৈরির গবেষণা চলছে। কম্পিউটারের মেমোরি, গতি, দক্ষতা ও কার্যক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য হার্ডওয়্যার এবং ভিডিও গেমস কনসোল তৈরিতে ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়। মহাকাশ অভিযানে ব্যবহৃত বিভিন্ন নভোযানকে হালকা করে তৈরি করে জ¦ালানির পরিমাণ কমাতে ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের লাসভেগাসে ২০১৭ সালে অনুষ্ঠিত ফুড সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি সোসাইটির বার্ষিক সভায় খাদ্য সুরক্ষা, গুণমান, সংবেদনশীলতা এবং স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে করা উচিত বলে মত দেয়া হয়। মার্কিন কৃষি বিভাগের জাতীয় খাদ্য ও কৃষি ইনস্টিটিউট গত কয়েক বছরে খাদ্য শিল্পে ন্যানো প্রযুক্তি প্রয়োগের জন্য ১০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে। পরিবেশ রক্ষায়, পরিবেশ-বান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবনে, পানির বিশুদ্ধকরণে ন্যানো- প্রযুক্তি সম্বলিত ছাঁকনি ব্যবহারে, শিল্পকারখানার বর্জ্য শোধনে ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। ন্যানো প্রযুক্তির এসব যুগান্তকারী অবদান আমাদের জীবনযাত্রাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিু করতে সক্ষম। ফসলের রোগ নির্ণয়, রোগবালাই ব্যবস্থাপনা, ন্যানো পেস্টিসাইড, ন্যানো ফার্টিলাইজার, ন্যানো হার্বিসাইড, অগ্রাধিকারভিত্তিক ফুড প্যাকেজিং, মাটির দূষণ নির্ণয় ও দুরীকরণ, ফসল উন্নয়ন (জাত), উদ্ভিদে জলবায়ু পরির্বুনের অভিঘাত সহনশীলতা বৃদ্ধি, সেচের দক্ষতা বৃদ্ধি, প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণ এবং নিখুঁত (প্রিসিশন) কৃষিতে ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায়। তাছাড়া ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহারের বিস্তৃতি দিনকে দিন বাড়ছে। ক. মহাকাশের নানান যন্ত্রপাতি, খ. জ্বালানি তৈরীতে, গ. ঔষধ ও কসমেটিকস তৈরীতে, ঘ. কম্পিউটার হার্ডওয়ার তৈরী, ঙ. ন্যানো রোবট তৈরী, চ. বস্ত্র শিল্প, ছ. ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতিতে ন্যানো প্রযুক্তি কার্যকর ভ‚মিকা রাখছে। ন্যানো প্রযুক্তির কিছু সাধারণ অসুবিধা রয়েছে। এ অসুবিধাগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অতিরিক্ত ব্যয়বহুল; ন্যানোপার্টিকেল মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর। ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা চাকরী হারাবেন; ফলে বেকারত্ব বাড়বে। আবার পরিবেশের উপর এর সম্ভাব্য বিরূপ প্রভাব নিয়েও সংশয় রয়েছে। তারপরও পৃথিবীর বহু দেশে ন্যানো প্রযুক্তি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চলছে।
ন্যানো প্রযুক্তির ভিত্তিতে অনেক অনেক নতুন নতুন টেকনোলজির উদ্ভব হচ্ছে। নতুন নতুন পণ্য ও সেবার সূচনা করছে এবং সেই সাথে ব্যবসায়িক সুযোগের দ্বার উন্মোচন করছে। আশা করা হয়েছিল যে, আমেরিকাতে ২০১০ সালের আগে ন্যানো প্রযুক্তি সম্পর্কিত পণ্যের বাজার ১ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌছবে এবং ৮ লক্ষ নতুন চাকরির সুযোগ করে দেবে। ন্যানো প্রযুক্তির গুরুত্বের কথা চিন্তা করে মার্কিন সরকার র্বুমানে ন্যানো প্রযুক্তি সংক্রান্ত গবেষণাতে ২০০০ সালে ৪২২ মিলিয়ন ডলার এবং ২০০৩ সালে ৭১০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। শুধু সরকারই নয়, পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও ন্যানো প্রযুক্তি গবেষণায় অর্থ সরবরাহ করছে। তার কারণ হল ন্যানো প্রযুক্তি সম্ভাবনার এক নতুন দুয়ার উন্মোচন করতে যাচ্ছে। যদিও ন্যানো প্রযুক্তি খুব ক্ষুদ্র টেকনোলজি সংক্রান্ত জিনিসগুলি নিয়ে কাজ করে যার ব্যাস একটি চুলের ব্যাসের ৮০ হাজার ভাগের এক ভাগ, কিন্তু এর ক্ষেত্র দিন দিন আরও বর্ধিত হচ্ছে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক