নোবেল বিজয়ী সৈনিকদের আর্তনাদ

481

জালাল উদ্দিন আহমদ

যাদের শরীরের রক্ত ঘামে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আজকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত হলো গ্রামীণ ব্যাংক। যাদের পরিশ্রম ও ত্যাগে অর্জিত হলো নোবেল পুরস্কার আজ তারা দ্বারে দ্বারে ঘুরছে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত¡াবধানে দেশের সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী ও কৃষি ব্যাংকের আওতায় গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্প হিসেবে গ্রাম পর্যায়ে ভূমিহীন ও বিত্তহীনদের মাঝে ঋণ সুবিধা পৌঁছে দেয়। ১৯৮৩ সালের মাঝামাঝি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলি এই প্রকল্প চালাতে অপারগতা প্রকাশ করলে প্রকল্প প্রধান প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস নিজ কর্মস্থল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাওয়ার জন্য প্রকল্পে কর্মীদের কাছে মতামত ব্যক্ত করেন। বাংলাদেশ সরকার ভূমিহীন ও বিত্তহীন মানুষে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের কথা বিবেচনা করে ১৯৮৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ‘গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ ১৯৮৩’ জারি করে এবং সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ মর্যাদায় প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে ২ অক্টোবর’ ১৯৮৩ তে প্রতিষ্ঠিত হলো গ্রামীণ ব্যাংক নামে আরও একটি সরকারি ব্যাংকের।
এরপর হতে শুরু হলো সহকর্মীদের নতুন উদ্যমে পথ চলা। তারা নিজেদের সমস্ত মেধা, শ্রম দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো। অজপাড়া-গাঁয়ের মেঠো, কর্দমাক্ত ও পিচ্ছিল পথে মাইলের পর মাইল গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটে বেড়িয়েছে। কোথাও আবার গামছা পরে খাল পার হতে হয়েছে। রাতের পর রাত শীতের মধ্যে কষ্ট করে থাকতে হয়েছে গ্রামের স্কুলের বারান্দায় তা আজ অবিশ্বাস্য। গ্রামের কাঠ মোল্লাদের রোষানলের শিকার হতে হয়েছে, পড়তে হয়েছে রাতে ডাকাতের কবলে। অনেক স্থানে সর্বহারাদের দ্বারা প্রাণের হুমকিতেও থেমে থাকেনি গ্রামীণ ব্যাংকের তখনকার কর্মী বাহিনীর কার্যক্রম। প্রতিটি দিন রোদ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে চলতে হয়েছে মাইলের পর মাইল। সকালে ঘুম থেকে উঠে বেরিয়ে পড়তে হতো। রাস্তায় বের হলেই গ্রামের কাঠ মোল্লাদের অব্যক্ত ভাষায় কটূক্তি ও মহাজনদের ঘৃণাভরা দৃষ্টি কর্মী বাহিনীর গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার অগ্রগতি থামাতে পারেনি। কাজের খেয়ালে কখন যে দুপুর গড়িয়েছে সকালের নাস্তাও হয়নি এমন অনেক দিন পার হয়েছে। কর্মীদের আত্মত্যাগে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হলো গ্রামীণ ব্যাংক এবং ২০০৬ সালে নোবেল পুরস্কার অর্জনের মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে ঠাঁই করে নিয়েছে এক অনন্য শিখরে। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস যাদের মেধা, শ্রম ও ত্যাগের বিনিময়ে আজ গ্রামীণ ব্যাংক একটি স্বাবলম্বী ও লাভজনক প্রতিষ্ঠানে অধিষ্ঠিত হয়েছে সেই কর্মী বাহিনী তাদের অধিকার বাস্তবায়নের জন্য দ্বারে দ্বারে ধর্না দিচ্ছে।
গ্রামীণ ব্যাংকের প্রায় ১২ হাজার কর্মকর্তা/কর্মচারী গ্রামীণ ব্যাংক হতে শতভাগ পেনশন সমর্পণ করে অবসরে এসে বর্তমানে আর্থিক কষ্টে, মানবেতর জীবনযাপন করছে। অনেকে সংসারের বোঝা বইতে না পেরে অকালেই রোগাক্রান্ত হয়েছে আবার অনেকেই অকালে এ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়ে মুক্তি পেলেও তার স্ত্রী ও সন্তানদের ভাসিয়ে গেছেন অভাবের অতুল সাগরে। এমন মুহূর্তে শতভাগ পেনশন সমর্পণকারীদের আর্থিক ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মানবতার মা, মেহনতী মানুষের আস্থার প্রতীক, মধ্যবিত্তের নয়নের মনি, উন্নয়নের রোল মডেল, বঙ্গবন্ধু সুযোগ্য উত্তরসূরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রজ্ঞাপন জারি করেন। সে মোতাবেক ১০০% পেনশন সমর্পণকারীগণ এবং প্রচলিত বিধানমতে পারিবারিক পেনশন ভোগীগণ প্রতি বছর দুইবার উৎসব ভাতা এবং মাসিক চিকিৎসা ভাতা প্রাপ্য হবেন। যা ০১-০৭-২০০৪ হতে কার্যকর হবে। শতভাগ পেনশন সমর্পণকারী অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা/কর্মচারীদের আর্থিক ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করণার্থে অবসর গ্রহণের তারিখ হতে ১৫ বছর সময় অতিক্রান্তের পর তাদের পেনশন পুনঃস্থাপন করা হবে। যা ০১-০৭-২০১৭ হতে কার্যকর হবে। এমন মুহূর্তে অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন তাদের মাঝে আশা জাগিয়েছে।
সরকারি উল্লেখিত প্রজ্ঞাপনসমূহ গ্রামীণ ব্যাংকে বাস্তবায়নের জন্য গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে প্রত্যেক জোনাল ম্যানেজারের মাধ্যমে এবং তাঁকে সরাসরি স্মারকলিপি প্রদান করা হয় এবং পরবর্তীতে গত ১০-০৯-২০১৮ইং তারিখ গ্রামীণ ব্যাংক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা/কর্মচারী কল্যাণ সমিতি, কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ হতে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এর সাথে দেখা করে যাবতীয় কাগজপত্রসহ দেখা করে এবং অবসরপ্রাপ্তদের আর্থিক দুঃখ-কষ্টের কথা উল্লেখপূর্বক ন্যায় সংগত বিষয়টি গ্রামীণ ব্যাংকে বাস্তবায়ন করার অনুরোধ করা হয়। তিনি তাৎক্ষণিক আশ্বাস দিলেও পরবর্তীতে কোন প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। পরবর্তীতে গ্রামীণ ব্যাংক অবসরপ্রাÍ কর্মকর্তা/কর্মচারী কল্যাণ সমিতির পক্ষ হতে বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতকে স্মারকলিপি প্রদান করলে এ সুবিধা তাদের পাওয়া উচিত বলে তিনি উল্লেখ করেন। সে প্রেক্ষিতে অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক যাচাই বাচাই করে এবং গ্রামীণ ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান খন্দকার মোজাম্মেল হক এর সাথে আলোচনা সাপেক্ষে অর্থ মন্ত্রণালয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ গ্রামীণ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক গ্রামীণ ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্তদের বিষয়টি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্তে একটি চিঠি লেখা হয়। কিন্তু তৎকালীন চেয়ারম্যান জনাব খন্দকার মোজাম্মেল হক এর অসুস্থতা এবং পরবর্তীতে তার মৃত্যুকালীন কারণে তা আর বাস্তবায়ন হয়নি বা গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে। অপর দিকে অর্থ মন্ত্রণালয় এর প্রবিধি মোতাবেক শতভাগ পেনশন বিয়ষটি বাধ্যতামূলক করা হলেও গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তাদের নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থে এ প্রজ্ঞাপন বাস্তবায়ন না করে এড়িয়ে যাচ্ছে।
গ্রামীণ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ায় গ্রামীণ ব্যাংক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ সমিতি, কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ হতে সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির মাননীয় সভাপতি জনাব আবুল হাসান মাহমুদ আলী এর সাথে সাক্ষাৎ করে তাঁকে একটি স্মারকলীপি প্রদান করা হয়। সে প্রেক্ষিতে গত ২৮-০৭-২০১৯ তারিখ অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ২য় বৈঠকে গ্রামীণ ব্যাংক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে এবং গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ উপস্থিত থাকতে বলা হয়। উক্ত বৈঠকে সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক উপস্থিত হলেও গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক উপস্থিত হননি। বৈঠকে সমিতির পক্ষ হতে অবসরপ্রাপ্তদের ন্যায্য দাবির পক্ষে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র উপস্থাপন করলে মাননীয় অর্থমন্ত্রী জনাব আ ম ম মুস্তফা কামাল বিষয়টি সমাধান করার আশ্বাস দেন। পরবর্তীতে ৩য় বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও মাননীয় অর্থমন্ত্রী উপস্থিত না থাকায় বিষয়টি আলোচ্যসূচিতে থাকলেও আলোচনা হয়নি। বর্তমানে বিষয়টি অমিমাংসিত রয়েছে।
মহান জাতীয় সংসদ এর মাননীয় হুইপ জনাব শামসুল হক চৌধুরী গত ১১-০৯-২০১৯ তারিখ মহান জাতীয় সংসদের ৭১ বিধিতে গ্রামীণ ব্যাংকের শতভাগ পেনশন সমর্পনকারী ১২ হাজার অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা/কর্মচারীগণের সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী ২০০৪ সালের ১ জুলাই হতে উৎসব ভাতা, চিকিৎসা ভাতা ও ২০১৬ সাল হতে বৈশাখী ভাতা এবং ২০১৭ সালের ১ জুলাই হতে অবসরে যাওয়ার পর হতে ১৫ বছর পূর্ণ হলে পেনশন পুনঃস্থাপন গ্রামীণ ব্যাংকে বাস্তবায়নের জন্য মাননীয় অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এছাড়াও গ্রামীণ ব্যাংক অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ সমিতির পক্ষ হতে সকল জেলা প্রশাসক মহোদয়ের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য যে, গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন ব্যয় নির্বাহের জন্য শাখা অফিস, এরিয়া অফিস, যোনাল অফিস ও প্রধান কার্যালয়ে কর্মরত সকল স্কেলপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীর মূল বেতনের ৬০% টাকা সংশ্লিষ্ট অফিসের ব্যয় দেখিয়ে পেনশন খাতে স্থানান্তর করা হয়। অবসর সংক্রান্ত সকল প্রকার ব্যয় এই পেনশন খাত থেকে প্রদান করা হয়ে থাকে। এই মুহূর্তে গ্রামীণ ব্যাংকের শতভাগ পেনশন সমর্পনকারীদের আর্থিক ও সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষে মানবতার মা, মেহনতী মানুষের আস্থার প্রতীক, সকল পেশাজীবীর মধ্যমনি, উন্নয়নের রোল মডেল, বঙ্গবন্ধু সুযোগ্য উত্তরসূরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছে। গ্রামীণ ব্যাংকে উল্লেখিত প্রজ্ঞাপন বাস্তবায়ন হলে তাদের আর্থিক কষ্ট যেমন লাঘব হবে তেমনি তারা তাদের আত্ম মর্যাদা ফিরে পাবে।
লেখক : সেক্রেটারি
গ্রামীণ ব্যাঙ্ক কর্মকর্তা কর্মচারী কল্যাণ সমিতি, কেন্দ্রীয় কমিটি