নৈতিক আদর্শ ও পরিমার্জিত চরিত্রের বাস্তব প্রশিক্ষণের মাস হল রমজান

27

সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী

নৈতিকতা, চরিত্র, আদর্শ এক ও অভিন্ন বিষয়। যার ইংরেজি প্রতিশব্দ হল- গড়ৎধষরঃু, ঈযধৎধপঃবৎ, ঊঃযরপং। আরবীতে যাকে বলা হয় আখলাক। তাই আখলাক শব্দের আভিধানিক অর্থ হল- নৈতিকতা, চরিত্র, ব্যক্তিত্ব, অভ্যাস, স্বভাব, সদাচার, জন্মগত স্বভাব প্রভৃতি’। (আল মুনজিদ ১ম খ. পৃঃ ৯৪)। ইসলামী শরীয়তের পরিভাষায় কোনো মানুষের আচার-আচরণ ও দৈনন্দিন কাজকর্মের মধ্য দিয়ে যে স্বভাব প্রকাশ পায় তাকে আখলাক বা নৈতিকতা বলে।
নীতির প্রতি মূল্যায়ন, সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন থেকেই আসে নীতিবোধ ও আদর্শিক গুণাবলি। আর এই নীতিবোধ থেকেই নৈতিকতা। অর্থাৎ নিয়ম থেকে নীতি, আর নীতি থেকে নৈতিকতা। নৈতিকতা হলো নীতিবোধ ও গুণাবলির দর্শন অর্থাৎ জীবন দর্শন। জীবনকে সুপথে-সুকাজে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার বৈশল্যকরণী।
নীতি নৈতিকতা মূলত একটি প্রশিক্ষণ। এটা শেখার জন্য ব্যবস্থা, অনুশীলন ও চর্চার প্রয়োজন। মানুষের জীবনের সততা, মহানুভবতা, উদারতা, ন্যায় পরায়ণতা, সভ্যতা, সাধুতা, অখÐতা, একত্রতা, পূর্ণতা সর্বোপরি স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, চরিত্র, মহত্ব ও আদর্শিক গুণাবলির সংমিশ্রিত আত্মশুদ্ধির স্বর্ণফসল হলো নৈতিকতা। জীবনচেতনার প্রথম সূর্যসিঁড়ি হলো নৈতিকতা। নৈতিকতা মানুষের জীবনের স্বচ্ছতার দিগন্তবিস্তারী প্লাবন ডেকে এনে দেয়। তাই মানুষের বিবেক ও মূল্যবোধের জাগরণকেই নৈতিকতা বলা হয়।
নৈতিকতা সমস্ত অন্যায়, অত্যাচার, নিপীড়ন ও নির্মমতার আঘাত থেকে রক্ষা করার জন্য এক সাহসী প্রতিবাদী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত। নৈতিকতা হলো আত্মশুদ্ধি, আত্মার মুক্তি ও শান্তির বাতিঘর। মানবিক গুণাবলি বিকশিত হওয়ার একমাত্র পথ নৈতিকতা। মানুষের ক্যারিয়ার গড়ার মাধ্যম হলো নৈতিকতা। জাতির সর্বক্ষেত্রে অবক্ষয় রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই নৈতিকতা। সর্বত্র নৈতিক অবক্ষয় প্রতিরোধে রুচিশীল নীতিবান ও যোগ্যতাসম্পন্ন লোকদের শান্তির ধর্ম ইসলামের ছায়াতলে কাতারবদ্ধ হতে হবে। সর্বক্ষেত্রে সবাইকে নৈতিকতার চর্চার বিষয়টিকে অধিকতর গুরুত্ব দেয়া উচিত।
ইসলামে ইবাদতসমূহ নৈতিক চরিত্রের অন্যতম প্রশিক্ষণ : ইসলামের ইবাদতসমূহ চরিত্রের সাথে ওতপ্রোতভাবে সংযুক্ত। যে ইবাদত উত্তম চরিত্রের প্রতিফলন ঘটায় না, তার কোন মূল্য নেই। নামাজ আদায়ের ক্ষেত্রে দেখা যায় নামাজ একজন মানুষকে অশ্লীল অপছন্দনীয় কাজসমূহ হতে রক্ষা করে, আত্মশুদ্ধি ও আত্মার উন্নতি সাধনে এর প্রভাব রয়েছে অন্যতম। আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেন : নিশ্চয়ই নামাজ অশ্লীল ও অপছন্দনীয় কাজ হতে বিরত রাখে। [সূরা আল-আনকাবূতঃ ৪৫]
যাকাতও অনুরূপভাবে অন্তরকে পবিত্র করে, আত্মাকে পরিমার্জিত করে এবং তাকে কৃপণতা, লোভ ও অহংকারের ব্যাধি হতে মুক্ত করে। আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেনঃ তাদের সম্পদ হতে আপনি সাদকাহ গ্রহণ করুন যার মাধ্যমে আপনি তাদেরকে পবিত্র ও পরিমার্জিত করবেন। [সূরা আত্-তাওবাহঃ ১০৩]
আর হজ্জ হচ্ছে আত্মশুদ্ধি এবং হিংসা বিদ্বেষ ও পঙ্কিলতা থেকে আত্মাকে পরিশুদ্ধি ও পরিমার্জনের জন্য একটি বাস্তবমুখী প্রশিক্ষণশালা । আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেনঃ যে এ মাস গুলোতে নিজের উপর হজ্জ ফরয করে নিল সে যেন হজ্জের মধ্যে কোন প্রকার অশ্লীলতা, পাপাচার ও ঝগড়া বিবাদে লিপ্ত না হয়। [সূরা আল-বাকারাহঃ ১৯৭]
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেনঃ যে ব্যক্তি অশ্লীল কথা-বার্তা ও পাপ কর্ম না করে হজ্জ পালন করল সে তার পাপরাশি হতে তার মা যেদিন জন্ম দিয়েছে সে দিনের মত (নিষ্পাপ) হয়ে ফিরে এল। (বুখারী-১৫২১ ও মুসলিম-১৩৫০)
রমজান আত্মশুদ্ধির প্রশিক্ষণের মাস: রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেনঃ এটা হল ধৈর্যের মাস। আর ধৈর্য অবলম্বনের প্রতিদান হচ্ছে বেহেশ্ত। এটা পরোপকার ও সহানুভূতির মাস এবং এটা এমন একটি মাস যাতে ঈমানদারগণের রুযী বৃদ্ধি করা হয়ে থাকে। এ মাসে যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে ইফতার করায়, তার বিনিময়ে তার সমস্ত গুণাহ মাফ হয়ে যায় এবং সে জাহান্নাম হতে মুক্ত হয়। (বায়হাক্বী-৩৯, ইবনু খোযাইমা-১৮৮৭)
অনুরূপভাবে সওম বা রোযা তাক্কওয়ার দিকে নিয়ে যায়। আর তাক্বওয়া হচ্ছে মহান চরিত্রের অন্যতম। যেমন- আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেনঃ হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর রোযা ফরয করা হয়েছে যেমনি ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর, যাতে তোমরা তাক্বওয়া লাভ করতে পার। [সূরা আল-বাকারাহ-১৮৩]
রোযা অনুরূপভাবে শিষ্টাচার, ধীরস্থিরতা, প্রশান্তি, ক্ষমা, মুর্খদের থেকে বিমুখতা ইত্যাদির প্রতিফলন ঘটায়। নবী করীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেনঃ তোমাদের কারো রোযার দিন যদি হয়, তাহলে সে যেন অশ্লীল কথাবার্তা না বলে, হৈ চৈ অস্থিরতা না করে, যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সাথে লড়াই করে সে যেন বলে আমি রোযাদার। (বুখারী-১৯০৪ ও মুসলিম-১১৫১)
‘রামাদ্বান’ শব্দটি আরবি ‘রাম্দ্ব’ ধাতু থেকে উদ্ভূত। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে দহন, প্রজ্বলন, জ্বালানো বা পুড়িয়ে ভস্ম করে ফেলা। রমজান মাসে সিয়াম সাধনা তথা রোযাব্রত পালনের মাধ্যমে মানুষ নিজের সমুদয় জাগতিক কামনা-বাসনা পরিহার করে আত্মসংযম ও কৃচ্ছ্রপূর্ণ জীবন যাপন করে এবং রিপুকে দমন করে আল্লাহর একনিষ্ঠ অনুগত বান্দা হওয়ার সামর্থ্য অর্জন করে। মাহে রমজান মানুষের অভ্যন্তরীণ যাবতীয় অহংকার, কুপ্রবৃত্তি, নফসের দাসত্ব জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় বলে এ মহিমান্বিত মাসের নাম ‘রমাদ্বান’। ইসলামের অনুসারীদের জন্য আল্লাহ তাআলার বিরাট নিয়ামত রমজান মাস।
তাই শুধুমাত্র পানাহার ত্যাগের নাম রোযা নয়; বরং সকল প্রকার নিষিদ্ধ কাজ থেকে বিরত থাকার নাম হলো রোযা। প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন: “যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা ও অনুরূপ কাজ পরিহার করল না, তার খাদ্য ও পানীয় থেকে বিরত থাকার মধ্যে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। [ বুখারী-৫৭১০)
তিনি আরও এরশাদ করেন: “তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি রোযা রাখে সে যেন কোনো রকম অশ্লীলতা ও হৈ-হুল্লোড় না করে। কেউ যদি তাকে গালাগাল দেয় বা তার সাথে ঝগড়া করে সে যেন বলে আমি রোযাদার’ (বুখারি-১৮৯৪ ও মুসলিম-১১৫১)
তিনি আরও এরশাদ করেন, (রোযাদারগণের পক্ষে) রোযা হচ্ছে ঢালস্বরূপ। সুতরাং তোমাদের মধ্যে কেউই রোযা অবস্থায় নির্লজ্জ কথা বলবে না এবং বাজে বকবে না। যদি কেউ রোযাদারকে গালি দেয় অথবা তার সাথে লড়াই করতে আসে, তবে সে যেন বলে দেয় যে, আমি রোযাদার। (বুখারি-১৭৬১, মুসলিম-১৯৪৬)
তিনি সাবধান করে এরশাদ করেন, ‘বহু রোযাদার এমনও রয়েছে, যে ক্ষুধায়-পিপাসায় কষ্ট পাওয়া ব্যতীত তাদের রোযা রাখায় আর কোন ফল নেই। এমনিভাবে বহু রাতজাগা নামাজী রয়েছে, যাদের রাত জাগরণ ব্যতীত অন্য কোন লাভ হয় না।’
নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন এরশাদ করেন, যে রোযাদারের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আমার নিষিদ্ধ বস্তুসমূহ হতে বিরত থাকল না, তার শুধু পানাহার হতে বিরত থাকায় কোন লাভ নেই।’ (ইবনু মাযা-১৬৯০, নাসায়ী- ৩২৫০, আহমদ-২/৪৪১)
প্রকৃতপক্ষে পবিত্র মাহে রমজান মুসলমানদের জন্য একটি বার্ষিক প্রশিক্ষণ কোর্স, যার মাধ্যমে রোযাদারদের জীবন প্রভাবিত হয়। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, “যে ব্যক্তি পবিত্র রমজান মাস ভালোভাবে যাপন করবে, তার সমগ্র বৎসর ভালোভাবে যাপিত হবে।”(হিলয়া-৭/১৪০)।
তিনি আরও এরশাদ করেন, “আমার উম্মত যদি মাহে রমজানের গুরুত্ব বুঝত, তাহলে সারা বছর রমজান কামনা করত।”(মাজমাইয যাওয়ায়েদ-৩/১৪১, আল পাওয়ায়েদ: শাওকানী-১/২৫৪)
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- ‘যে ব্যক্তি রমজান মাসে ঈমানের সাথে ও ছওয়াবের আশায় রোযা রাখে, তার অতীত গোনাহ মাফ হয়ে যায়। (বুখারী-৩৮. মুসলিম-৭৬০)
অতএব রোযাদারকে পানাহারের পাশাপাশি কান, চোখ, মুখ, ও হাত-পাকে মিথ্যা এবং নিষিদ্ধ কাজ ও কথা থেকে বিরত রাখতে হবে, অন্যথায় তা শুধুমাত্র উপবাস যাপন ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন: “কিছু রোযাদার এমনও আছে যার রোযা থেকে তার প্রাপ্য হলো শুধুমাত্র ক্ষুধা ও পিপাসা এবং কিছু রাত জাগা ইবাদতকারী এমনও আছে যার রাত জাগা থেকে প্রাপ্য হলো একমাত্র অনিদ্রা।” [ইবনে মাজাহ -১৬৯০]

লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, সাদার্ন
বিশ্ববিদ্যালয়, খতীব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ