নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে করণীয়

18

অমল বড়ুয়া

আমরা যেন এক ঘোরের মধ্যে আছি! নিদারুন অস্থিরতায় কাটছে আমাদের যাপিতজীবনের দিনগুলো। চর্তুদিকে বিশৃংখলার ঘনঘটা। অজানা শঙ্কা আর আতঙ্ক ধরে আছে সময়ের নাটাই। অসহিষ্ণুতার ক্ষার নোনাজলে হাবুডুবু খাচ্ছে সমাজ। অসহায়ত্বের বিনিসুতায় বাঁধা আমাদের হাত-পা। চেতনার ইথারে কেবলই অবশ জড়তার প্রতিধ্বনি। বোধ-বুদ্ধির স্খলন চলছে সর্বত্র। হিংসা-প্রতিহিংসা আর জিঘাংসার দারুন দহনে দগ্ধ দেশ-কাল-সমাজ। হারিয়ে যাচ্ছে মানবিক বোধ-শোধ আর নৈয়ায়িক বিবেকপ্রসূত বিবেচনা। নীতিহীনতার পঙ্কিলতায় ডুবছে যেন জনসমাজ! চিত্তবিকারের আবিলতায় আড়ষ্ট মানুষ। অন্যায়-অনাচার আর অবিচারের খড়গ সন্ত্রস্ত করে তুলছে জনগণকে। লোভ-দ্বেষ-মোহ আর স্বার্থের হাতে বন্দি বিবেক ও চেতনা। দিনকে দিন আমরা হয়ে পড়ছি অন্ধ, মূঢ়, বধির ও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। হয়ে পড়ছি আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপর ও পৌরুষহীন। বন্ধ্যাত্ব আমাদের ক্রমাগত গ্রাস করছে। চেতনায় বন্ধ্যাত্ব। বিবেকে বন্ধ্যাত্ব। বোধ আর বোধিতে বন্ধ্যাত্ব। আবার বন্ধ্যাত্ব দখল করে আছে আমাদের মনুষ্যত্বকেও। টালমাটাল ঘুণে ধরা বন্ধ্যা সমাজে আমাদের বসবাস। আমরা মানছি না কোনো নিয়ম-নীতি, দায়িত্ব-কর্তব্য কিংবা ধার ধারছি না মূল্যবোধ আর ন্যায়-নৈতিকতার। আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে নৈতিকতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা। নীতিহীনতার দগদগে ঘা আমরা বয়ে নিয়ে চলছি নিরবে নির্মোহ নির্লিপ্ততায়। মনুষ্যত্বের মন্বন্তর চলছে এখন সর্বত্র। ভোগছি আমরা মানসিক বৈকল্যে। সন্তানের হাতে নির্দয়ভাবে খুন হচ্ছে মাতা-পিতা। ছোট-খাটো বিষয়ে আবেগতাড়িত হয়ে কিশোর-কিশোরিদের আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে অহরহ। বাড়ছে শিশু ধর্ষণ ও খুনের মতো দুধর্ষ ঘটনা। ক্ষমতাবানদের প্রলোভনে প্রলুব্দ কিশোর-তরুণরাও বিশৃংখলায় মেতে ওঠে। অলিতে-গলিতে নেতা আর কথিত বড়ভাইদের হাত ধরে গড়ে উঠছে কিশোর গ্যাং। ঘটছে শিক্ষকদের ওপর হামলার ঘটনা। আবার শিক্ষকরাও রাজনীতি, অর্থ, ক্ষমতা আর পদ-পদবীর লোভে বিকোয় নিজেদের নীতি-নৈতিকতা। অন্যের সন্তানকে মানুষ করার যে অহংকার শিক্ষকের ছিল সেটা খাটো হতে থাকে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের অংক বিজ্ঞান ও ইংরেজিতে দক্ষ করে তোলার শিক্ষা দেয়ার চেয়ে নৈতিকতার শিক্ষা না দেয়ার কারণে। আসলে এখন আমাদের দরকার নৈতিকতার শিক্ষা। খোলা উচিত নৈতিকতা শিক্ষার বিদ্যালয়। দেশের বড় বড় বিশ^বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা নেয়া দেশসেরা মেধাবীরাই তো দুর্নীতি করছে। কোনো কুলি, মজুর, নিরক্ষর ও গরীবলোক দুর্নীতি করছে না কিন্তু। নিরাপত্তাহীনতার ডামাঢোলে বাড়ছে মানবাধিকার লঙ্ঘনজনিত ঘটনা। মহাসড়কে বাড়ছে দুর্ঘটনা। দেশের বাজার ও ক্রেতারা জিম্মি গুটিকতেক সিন্ডিকেটের হাতে। তাদের অভেদ্য জালে আর জুলুমে দেশের ত্রাহি অবস্থা। কেবল ব্যবসায়িক মুনাফাই তাদের লক্ষ্য। তারা যেন পরিবারহীন, সমাজহীন ও দেশহীন লুটেরা। নেই কোনো ন্যায়-নৈতিকতা কিংবা নিজের বা দেশের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা। তাদের কার্যকলাপে মনে হয় আবার ফিরে এসেছে মাৎস্যন্যায়। দেশপ্রেমহীনতার কারণেই তো আবার অনেকে দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে সরকারী কর্মচারীদের বেতন বাড়ে আর শ্রমিক, গামেন্টস কর্মী, দিন-মজুর, খেটে খাওয়া মানুষ ও বেসরকারি চাকরীজীবিদের বেতন বাড়ে না। ছা-পোষা নি¤œ ও মধ্যবিত্ত মানুষের ভোগান্তি বাড়ে। সেবাগ্রহিতারা সেবা পেতে গলদঘর্ম হয়। ধর্ম আমাদের মনুষ্যত্বের বিকাশ সাধন করে। সহিষ্ণুতা, সৌহার্দ, সম্প্রীতি, আত্মশুদ্ধি, শান্তি ও ভালবাসা শেখায়। জাগ্রত করে বোধ ও বিবেককে। কিন্তু সেই ধর্মের ধুয়া তুলে হামলা হয়। সেই ধর্মের নামে টানা হয় বিভেদ রেখা। কারো কোনো মাথা ব্যথা নেই। রাষ্ট্র দোনোমোনায় ভোগে। কেবল জনগণের রক্তক্ষরণ হয়।
আমরা যেন আদিম অসভ্যতার অতল গহŸরে হারিয়ে যাচ্ছি; যেন ডুবছি শ্যাম তিমিরে। আমাদের গন্তব্য কোথায়? আমরা সবাই আত্মকেন্দ্রিকতা ও আত্মশ্লাঘায় নিমগ্ন। নীতি-নৈতিকতা ও সামাজিক দায়বদ্ধতা কারো মাঝে নেই। আমরা যেন ভুলে গেছি আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্য, ধর্ম-পুণ্য, পারিবারিক-সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কর্তব্য আর দায়বদ্ধতা।
একটা সময় ছিল যখন আমরা সৎ চরিত্রবান ও নীতিবান মানুষকে সম্মান করতাম। আর এখন সম্মান করছি টাকাওয়ালাকে; ক্ষমতাওয়ালাকে আর দুর্নীতিবাজকে। সম্মান আর সংবর্ধনা দিচ্ছি সমাজে অনৈতিক কর্মকাÐে জড়িত ঘুষখোর, দুর্নীতিপরায়ণ, ক্ষমতাবান ও পেশিশক্তির অধিকারীকে। এতে করে ঘটছে নৈতিকতা ও ম‚ল্যবোধের দারুণ অবক্ষয়। তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরী এই অবক্ষয়ের ¯্রােতে ভেসে হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের পথে, মন্দের বৃত্তে। ছিনতাই, অপহরণ, গুম, খুন, হানাহানি, নষ্ট রাজনীতি আর সন্ত্রাসে প্রতিনিয়ত জড়িয়ে যাচ্ছে। বাড়ছে উগ্রতা, হিং¯্রতা, উচ্ছৃঙ্খলতা ও অসহিষ্ণুতার মতো ভীতিকর আচরণ। বাড়ছে ক্ষমতার অপব্যবহার। আমাদের সমাজে চলছে অর্থ-সম্পদ ও বিত্তের পেছনে অবিরাম ছুটে চলার অসম প্রতিযোগিতা।
লোভের বশবর্তী হয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার এই প্রতিযোগিতায় হারাচ্ছে নিজের বিবেক, বোধ ও চরিত্র। অবলীলায় বিসর্জন দিচ্ছে আপন নৈতিকতা আর মূল্যবোধকে। এখন সমাজের নিন্ম থেকে উচ্চস্তর পর্যন্ত ডুবে আছে দুর্নীতি, অপকর্ম আর অনৈতিক কর্মকাÐে। দেশ, সমাজ ও সংস্কৃতির সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম-নীতি, আইন-কানুন ও মূল্যবোধ থাকে। আর এই নিয়ম-নীতি ও আইন-কানুন মানুষ গ্রহণ করে; সম্মানের সহিত মেনে চলে; শুদ্ধভাবে প্রতিপালন করে। ফলে সমাজে বিরাজমান থাকে শান্তি, সম্প্রীতি, ভ্রাতৃত্ববোধ, স্থিতিশীলতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সমাজকে সকল প্রকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংঘাত, সংঘর্ষ ও অনৈতিক কর্মকাÐ থেকে দুরে রাখে। এতে করে মানুষ সমাজে শান্তি ও সমৃদ্ধি নিয়ে বেঁচে থাকে। মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণ হিসেবে ক). পারিবারিক ও সামাজিক, খ). অর্থনৈতিক, গ). রাজনৈতিক, এবং ঘ). ধর্মীয় এই চারটি বিষয়কে বিবেচনা করা যায়। কলহপূর্ণ পারিবারিক পরিবেশ ও ম‚ল্যবোধের অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ। পরিবারের সদস্যদের নেতিবাচক মনোভাব, নীতিহীনতা, ধর্মীয় গোড়ামি, মূল্যবোধের প্রতি অশ্রদ্ধা মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। ফলে পরিবারের কাছ থেকে ব্যক্তি নৈতিকতা ও মূল্যবোধের শিক্ষা পায় না। আর যেটুকু সহজাত থাকে তাও হারিয়ে ফেলে। মানুষের উচ্চাকাক্সক্ষা, উচ্চাভিলাস তার নৈতিক ম‚ল্যবোধের অবক্ষয় ঘটায়। অধিক সুখ আর বিলাসী জীবনের আশায় মানুষ যখন বিপথগামী হয় তখন সে মূল্যবোধকে অনায়সে ভুলে যায়। অন্যায়ভাবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের পথে মানুষ নীতি ও ম‚ল্যবোধে দৃঢ় থাকতে পারে না। কারণ নীতিহীনতা মানুষকে বিম‚ঢ় করে দেয়। অবৈধ সম্পদ অর্জনে মানুষ বেছে নেয় অসৎ পথকে। সে ভুলে যায় তার নীতি-নৈতিকতা ও ম‚ল্যবোধকে। বর্তমান যুগে মানুষ অতিরিক্ত গুরুত্ব দেয় তার আত্ম-স্বার্থ চরিতার্থ করাকে। ম‚ল্যবোধহীন সমাজে সেই আত্ম-স্বার্থের চরিত্র মুলত লালসামূলক এবং নীতি-নৈতিকতাবোধ শুন্য হয়। কিশোর-তরুণরা ক্ষমতার লালসায় রাজনৈতিক নেতা বা বড় ভাইদের প্ররোচনায় রাজনীতিতে যুক্ত হয়েই অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজি, ছিনতাই ও অন্যান্য অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। মাদকে আসক্ত হচ্ছে। বিপথগামী হচ্ছে। ধর্মকে ব্যবহার করে স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে ঘৃণা, বৈরিতা, বিদ্বেষ ছড়িয়ে জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টি করে। এতে কিশোর-তরুণ-যুবকসহ একটি বিশেষ মহলকে সম্পৃক্ত করে বিশৃংখলা সৃষ্টি করে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ঐক্য ও সংহতিকে বিনষ্ট করে দেয়। মানুষের প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো তার পরিবার। তাই নৈতিক শিক্ষা আর ম‚ল্যবোধের শিক্ষাও শুরু হয় পরিবারে। ফলে পরিবারকেই শিশুকে নৈতিকশিক্ষা ও সামাজিক ম‚ল্যবোধ শেখানোর দায়িত্ব নিতে হবে। পাঠ্য পুস্তকে নৈতিক শিক্ষার পাঠ সংযোজন করতে হবে। শিক্ষার লক্ষ্য কিন্তু মনুষ্যেত্বের বিকাশ ঘটানো। মানুষ হতে হলে মানবিক গুণাবলির শিক্ষা নেয়া জরুরী।
আমাদের উপমহাদেশে ধর্মীয় শিক্ষায় সুফল আসছে বলে মনে হয় না বরং ধর্মের নামে গোঁড়ামীর উত্থান দেখা যায়। নৈতিক শিক্ষা ও ম‚ল্যবোধ থাকলেই কেবল মানুষ তার নিজের, পরিবারের, সমাজের ও রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত থেকে সকল দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করে। নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত একজন মানুষ অন্যকেও উৎসাহিত করে নীতিবান হতে ও ম‚ল্যবোধের প্রতি সম্মান দেখাতে। সমাজের সর্বস্তরে সদাচার, জবাবদিহিতা, গণতন্ত্র ও সুশাসন নিশ্চিত করা গেলে নৈতিকতার অবক্ষয় রোধ করা সম্ভব।
লেখক : কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক