নেতা থেকে বঙ্গবন্ধু -২

78

আ.ফ.ম. মোদাচ্ছের আলী

[গত সংখ্যার পর)
এদিকে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সরকারি ঘোষণা করার ষড়যন্ত্র টের পেয়ে পূর্ব পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবী মহল জাগ্রত হয়। সাংগঠনিকভাবে প্রথম প্রতিবাদ আসে তমদ্দুন মজলিস থেকে। জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শুরু থেকেই ভাষা আন্দোলন এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর তমদ্দুনের বাংলা ভাষার পক্ষে দাবি উত্থানের পরপরই তাদের এই দাবির পক্ষে পল্লির প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে ২৭ বছরের তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান স্বাক্ষর সংগ্রহ করেন। ১৯৪০ সালেই তিনি রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হয়ে উঠেছিলেন এবং বেঙ্গল মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ১৯৪৬ সালে তিনি কোলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন। বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক সরদার সিরাজুল ইসলাম ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন ভারত বিভাগের আগে ছাত্রদের একমাত্র প্রতিষ্ঠান ছিল নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ। ১৯৪৭ এর আগস্টে এই ছাত্র প্রতিষ্ঠানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাত্র ২১ দিনের মধ্যে ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর কমরুদ্দিন আহাম্মদ, শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দিন আহমদ, শামসুদ্দিন আহাম্মদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, নুরুদ্দিন আহাম্মদ, আবদুল অদুদ প্রমুখের প্রচেষ্টায় পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ প্রতিষ্ঠা হয়। এর কারণ ছিল বাঙালির ভাষা, কৃষ্টির প্রতি সাম্ভব্য হামলার প্রতিরোধ এবং জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য সংগ্রাম করা। তাঁরা আগেই অনুমান করেছিলেন, মুসলমানদের জন্য দুটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বদলে এক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত আসবে এবং ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বদলে পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত হবে।
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলীম ছাত্রলীগ, গণ আজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ ও তমদ্দুন মজলিস ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল সংসদের নেতা ও শিক্ষকরা ভাশার দাবিতে আন্দোলন এগিয়ে নিতে থাকেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে চলতে থাকে ক্লাস বর্জন ও সভা সমাবেশের কর্মসূচি। ১৯৪৮ সালের ২৮ ফেব্রæয়ারী তমদ্দুন মজলিস ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সভায় ভাষার দাবিতে ১১ মার্চ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সাধারণ ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত হয়। সভার সম্মতিতে এক বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন শেখ মুজিবুর রহমান, নইমুদ্দিন আহমদ ও আবদুর রহমান চৌধুরী। মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের এই প্রথম পর্যায়ে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ দিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেদিন ভাষার দাবিতে প্রথম ধর্মঘট পালিত হয়। নেতারা রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন সড়কে ধর্মঘটের পক্ষে প্রচারণা চালাতে থাকে। শেখ মুজিবুর রহমান আবদুল গণি রোডে সচিবালয়ের প্রথম গেটের সামনে প্রচার চালাচ্ছিলেন। ওদিকে তখন রাজপথে নেমেছে বাংলা ভাষার দাবিতে মিছিল। মিছিলে পুলিশ ব্যাপক লাঠিচার্জ করে। ও ছাত্র নেতাদের গ্রেফতার করে। গ্রেফতার হন শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব সহ অনেক ছাত্র নেতা। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের নেতেৃত্ব দিতে গিয়েই স্বাধীন পাকিস্তানে শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমবার রাজবন্দি হয়ে কারাগারে গেলেন।
ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই শেখ মুজিবুর রহমান সামনে থেকে নেতেৃত্ব দিয়েছিলেন এবং আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে তাৎপর্যপূর্ণ ভুমিকা রেখেছিলেন। রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহম্মদ ১৯৫২ সালের ১৬ ফেব্রæয়ারি থেকে আমরণ অনশন শুরু করেন। তখন অসুস্থতার কারণে ঢাকা মেডিকেল কলেজে স্থানান্তর করা হয় তাঁদের। বন্দি অবস্থায় অবশ্য সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যহত থাকে এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলী দেন তাঁরা। দৈনিক ইত্তেফাকে ১৭ ফেব্রæয়ারি প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, পাকিস্তান সংগ্রামের জঙ্গি কর্মী, ছাত্র-যুব আন্দোলনের অগ্রনায়ক ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের বিনা বিচারে কারাবাস ও বন্দি দিনগুলোর নিষ্ঠুর নিষ্পেষণে জীর্ণ স্বাস্থের জন্য উৎকন্ঠা ও ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ তুলিয়া প্রদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এই প্রদেশের সকল কর্মী বিশেষ করিয়া শেখ মুজিব ও মহিউদ্দিনের আশুমুক্তির জন্য আবেদন পেশ করিয়াছেন। আবেদনপত্রে মাওলানা ভাষানীসহ বিশিষ্ট ছাত্রনেতা, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকরা সই করেন। এ ছাড়া মানবতার নামে শেখ মুজিব ও মহিউদ্দিনের মুক্তির আবেদন জানিয়ে মাওলানা ভাসানী একটি পৃথক বিবৃতি দেন যা ২৪ জানুয়ারি ইত্তেফাকে প্রকাশিত হয়। বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘আমি জানিতে পারিয়াছি যে গত ১৬ ফেব্রæয়ারি হইতে নিরাপত্তা বন্দি শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহম্মদ আমরণ অনশন ধর্মঘট শুরু করিয়াছেন। আমি মানবতার নামে আবেদন করিতেছি যে আশঙ্কাজনক স্বাস্থ্যের দিকে চাহিয়াও যেন তাহারা শেখ মুজিব ও মহিউদ্দিন আহাম্মদকে মুক্তি দেন।’ ২১ ফেব্রæয়ারি ১৯৫৩ সালে যুবনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতেৃত্বে প্রথম প্রভাত ফেরি নেমেছিল ঢাকার রাজপথে। মিছিলের অগ্রভাগে ছিলেন শেখ মুজিব ও মাওলানা ভাসানী। শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনা ও নেতেৃত্বে সেই মিছিলে আরো ছিলেন আতাউর রহমান খান, আবদুস সামাদ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ছাত্রবাসের প্রতিনিধিগণ। এতবড় সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ মিছিল এর আগে দেখা যায় নি। সেদিন স্কুল কলেজ, দোকান-পাট, বাজার-ঘাট, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক, রেল, সিনেমা হল সব বন্ধ ছিল। মিছিল যখন এগিয়ে যাচ্ছিল তখন অনেক বাড়ির ছাদ থেকে মহিলারা মিছিলের উপর ফুল ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন। আজিমপুর কবরস্থানে শহীদদের ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। সর্দার সিরাজুল ইসলাম লিখেছেন, ওই দিন সকাল থেকে শেখ মুজিবুর রহমান সাইকেলে করে গোটা ঢাকা শহর টহল দিয়ে বেড়ান এবং মিছিলের সামনে থেকে নেতেৃত্ব দেন। পরে আরমানিটোলা ময়দানে লক্ষাধিক লোকের সভায় শেখ মুজিব বক্তৃতা দেন। তাঁর অনুরোধে গাজীউল হক নিজের লেখা প্রথম গাণটি “ভুলব না….” পরিবেশন করেন। সভায় অন্যান্য ¯েøাগানের মধ্যে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, গণপরিষদ ভেঙে দাও, স¤্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক ইত্যাদি এবং চারটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। (ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু, দৈনিক জনকন্ঠ ২০১২)
সেই সময় ¯েøাগান ছিল বাঙালির প্রাণশক্তি। মিছিলের ¯েøাগান মানুষকে উজ্জীবিত করত। বাংলাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে “জয় বাংলা” ¯েøাগান ছিল সঞ্জীবনী শক্তি। প্রতিটি যুদ্ধ জয়ের পর বীর মুক্তিযোদ্ধারা “জয় বাংলা” ধ্বনিতে মুখরিত হতেন। এ ¯েøাগানটি তৎকালীন ছাত্র নেতেৃবৃন্দ কিছু কিছু জায়গায় ব্যবহার করলেও ১৯৭০ এর ৭ জুন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ভাষণে “জয় বাংলা” ¯েøাগান প্রথম উচ্চারণ করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ কে ভালবাসতেন, ভালবাসতেন বিদ্রোহী কবি নজরুল কে। তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতায় তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃত করতেন। বঙ্গবন্ধুর মধ্যে নজরুলের অবস্থান ও ছিল দৃঢ়। তাইতো বিদ্রোহী কবিকে তিনি ভারত থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। অন্য কারো পক্ষে এটি সম্ভব ছিল না।১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলার মাটিতে জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের জন্মদিবস উপলক্ষে নজরুল একাডেমি আয়োজিত নজরুল উৎসবে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদানের জন্য একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক কবি তালিম হোসেন কর্তৃক অনুরুদ্ধ হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে বাণী প্রদান করেন, তার একটি অংশে তিনি বিদ্রোহী কবিকে নিয়ে লিখেন, “বিদ্রোহী কবির এমন এক সময় আবির্ভাব, যখন মধ্যাহ্ন মার্ত্তন্ডের মত বাংলা সাহিত্য ও কাব্যে রবীন্দ্রনাথের বিশ্বজয়ী প্রতিভা সমস্ত দিক, সমগ্র আকাশ, সমস্ত সাহিত্য-চেতনাকে পরিব্যপ্ত করেছিল। কাব্যের অনুভুতির, চেতনার, ছন্দের, সুরের, প্রকাশের, যে পথ দৃষ্টিতে পড়ে, সে পথের মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে আছেন মেঘেতে মাথা ঠেকিয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু নজরুল কাব্যের অনন্য সাধারণ স্বাতন্ত্র্য হলো তাঁর কাব্যের স্বকীয়তা আপন মহিমায় ভাস্বর। বৈপ্লবিক কাব্য-জগতে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন স্বতন্ত্র একক একটি সম্পূর্ণ নতুন ব্যক্তিত্ব।” নজরুল, রবীন্দ্রনাথ এই দুই মহান কবি থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রধান দুটি মৌলিক সত্বাকে বঙ্গবন্ধু ধারণ করেছিলেন। একটি আমাদের প্রাণের জাতীয় সংগীত “আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি”, অন্যটি আমাদের সঞ্জীবনী শক্তি, হৃদয়ের ¯েøাগান “জয় বাংলা”। ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি ১৯৭০ এর ৭ জুন বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সের জনসভায় প্রথম জয় বাংলা ¯েøাগান উচ্চারণ করেন। যদিও এর পূর্বে কিছু ছাত্র নেতা এই ¯েøাগান দিতেন। বঙ্গবন্ধু এটি নিয়ে চিন্তা করেছিলেন। “বাংলা বাঙালির জয় হোক” “বাংলার জয় হোক” “বাঙালির জয় হোক” এই অভিনাসি পংক্তিগুলো নজরুল বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস থেকে চয়ন করেছিলেন। “কবি নজরুল, বঙ্গবন্ধু ও জয় বাংলা” প্রবন্ধে শামসুজ্জামান খান লিখেছেন, কবি নজরুল “ভাঙার গান” কাব্য গ্রন্থে “পূর্ণ অভিনন্দন” কবিতায় হুবহু “জয় বাংলা” শব্দটি ব্যবহার করেছেন এবং খুবই আশ্চয্যের ব্যাপার, ফরিদপুরের এক বিপ্লবী অধ্যক্ষের যাকে কবি মাদারীপুরের “মর্দ্দবীর” বলে উল্লেখ করেছেন, তার কারামুক্তি উপলক্ষে এই কবিতাটি রচিত। (চলবে)
লেখক : শিশু সাহিত্যিক, বঙ্গবন্ধু গবেষক ও প্রাবন্ধিক