নেতা থেকে বঙ্গবন্ধু -১৩

52

আ.ফ.ম. মোদাচ্ছের আলী

[গত সংখ্যার পর]
১৯৬৫ সালে ভারতের সাথে যুদ্ধ চলাকালে যে সকল রাজনীতিবিদ ভারতীয় আক্রমণের তীব্র নিন্দা করেন আমি তাহাদের অন্যতম। সরকারের যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে পূর্ণভাবে সমর্থন করার জন্য আমি আমার দল ও জনসাধারণের প্রতি আহŸান জানাই। যুদ্ধ প্রচেষ্টার সাম্ভব্য সকল প্রকার সাহায্য প্রদান করার জন্যও আমার দল পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগ ইহার সকল অঙ্গের নিকট নির্দেশ প্রেরণ করে। যুদ্ধ চলাকালে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের বাসভবনে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সম্মেলনে আমি প্রদেশের অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে এক যুক্ত বিবৃতিতে ভারতীয় আক্রমণের প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করি এবং দেশের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম ও সাহায্য করার জন্য জনসাধারণের প্রতি আহŸান জানাই। যুদ্ধাবসানে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব প্রদেশ ভ্রমণকালে আমি ও অন্যান্য রাজনীতিবিদগণ আমন্ত্রিত হইয়া তারার সহিত সাক্ষাৎ করি। সেই সময় পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্ত শাসন প্রদান ও যুদ্ধাকালে আমাদের অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে এ প্রদেশের সামরিক প্রতিরক্ষার ব্যাপারে স্বয়ংসম্পূর্ণ করিয়া তুলিবার জন্য প্রেসিডেন্টের নিকট আবেদন জানাই। কারণ যুদ্ধকালে পূর্ব পাকিস্তান দেশের জন্য অংশসহ বিশ্ব হইতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িয়াছিল। আমি তাসখন্দ ঘোষণাকেও সমর্থন করিতেছিলাম। কারণ আমি এবং আমার প্রতিষ্ঠান অগ্রগতির জন্য বিশ্ব শান্তিতে আস্থাবান। আমরা বিশ্বাস করি যে সকল আন্তর্জাতিক বিরোধ শান্তিপূর্ণ উপায়ে মীমাংসা হওয়া উচিত। ১৯৬৬ সালের গোড়ার দিকে লাহোরে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় জাতীয় সম্মিলনীর বিষয় নির্বাচনী কমিটির নিকট আমি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্যাবলীর নিয়মতান্ত্রিক সমাধান- ছয়দফা কর্মসূচি উপস্থিত করি। ছয়দফা কর্মসূচিতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান উভয় অংশের জন্যই পূর্ণ আঞ্চলিরক স্বায়ত্তশাসনের দাবি করা হইয়াছে। অতপর আমার প্রতিষ্ঠান পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগ ছয়দফা কর্মসূচী গ্রহণ করে এবং দেশের উভয় অংশের মধ্যকার অর্থনৈতিক ও অন্যান্য বৈষম্য দূরীকরণের অনুকুলে জনমত যাচাই ও গঠনের জন্য ছয় দফার পক্ষে জনসভা অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হয়। ইহাতে প্রেসিডেন্টসহ অন্যান্য সরকারী নেতৃবৃন্দ ও সরকারি প্রশাসনতন্ত্র আমাকে অস্ত্রের ভাষায় গৃহযুদ্ধ ইত্যাদি হুমকি প্রদান করে এবং একযোগে এক ডজনেরও অধিক মামলা দায়ের করিয়া আমাকে হয়রানি করিতে শুরু করে। ১৯৬৬ সালের এপ্রিলে আমি যখন খুলনায় একটি জনসভা করিয়া যশোর হইয়া ঢাকা ফিরিতে ছিলাম তখন তাহারা যশোরে আমাকে পথরোধ করে এবং আপত্তিকর বক্তৃতা প্রদানের অভিযোগে ঢাকা হইতে প্রেরিত এক গ্রেপ্তারী পরোয়ানা বলে এইবারের মতো প্রথম গ্রেফতার করে।
আমাকে যশোর মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে উপস্থিত করা হইলে তিনি আমাকে অন্তবর্তীকালীন জামিন প্রদান করেন। আমি ঢাকার সদর দক্ষিণ মহকুমা প্রশাসকের সম্মুখে উপস্থিত হইলে তিনি আমার জামিনে অসম্মত হন কিন্তু মাননীয় দায়রা জজ প্রদত্ত জামিন বলে সেই দিনই মুক্তি পায় এবং সন্ধা সাতটায় নিজ গৃহে গমন করি। সেই সন্ধায়, আটটায় পুলিশ পুনরায় আপত্তিকর বলিয়া কথিত এক বক্তৃতার উপর সিলেট হইতে প্রেরিত এক গ্রেপ্তারী পরোয়ানা বলে আমার বাসগৃহ হইতে আমাকে গ্রেফতার করে। পুলিশ সেই রাতেই আমাকে সিলেট নিয়ে যায়। পরদিন প্রাতে আমাকে আদালতে উপস্থিত করা হইলে সিলেটের মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট আমার জামিন আবেদন বতিল করিয়া আমাকে কারাগারে প্রেরণ করেন। পরদিবসে সিলেটের মাননীয় দায়রা জজ আমার জামিন প্রদান করেন কিন্তু মুক্ত হইবার পূর্বেই পুলিশ পুনরায় আপত্তিকর বলিয়া কথিত এক বক্তৃতা প্রদানের অভিযোগে আমাকে কারা দরজায়ই গ্রেফতার করে। এবারের গ্রেফতারী পরোয়ানা মোমেনশাহী হইতে প্রেরিত হইয়াছিল। সেই রাত্রে পুলিশ পাহারাধীন মোমেনশাহী লইয়া যাওয়া হয় এবং একইভাবে মোমেনশাহীর মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট আমান জামিন প্রদানে অস্বীকৃত হন এবয় পরে মাননীয় জায়রা জজ প্রদত্ত জামিনে মুক্তি লাভ করিয়া ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করি। উপরোক্ত সকল ধারাবাহিক গ্রেপ্তারী প্রহসন ও হয়রানি ১৯৬৬ সালে সংগঠিত হয়।
১৯৬৬ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে সম্ভবত ৮ মে, আমি নারায়নগঞ্জে এক জনসভায় বক্তৃতা প্রদান করি এবং রাত্রে ঢাকায় নিজগৃহে প্রত্যাবর্তন করি। রাত একটার সময় পুলিশ ডিফেন্স অব পাকিস্তার রুল এর ৩২ ধারায় আমাকে গ্রেফতার করে। একই সঙ্গে আমার প্রতিষ্ঠানের বহু নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করা হয়। ইহাদের মধ্যে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দিন আহমদ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগের সহ সভাপতি খোন্দকার মোশতাক আহম্মদ. প্রাক্তন সহ সভাপতি জনাব মুজিবুর রহমান, চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব আজিজ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগের প্রাক্তন কোষাধ্যক্ষ জনাব নুরুল ইসলাম চৌধুরী, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগের শ্রম সম্পাদক জনাব জহুর আমদ চৌধুরী সহ বহু অন্যান্য। ইহার অল্প কয়েকদিন পরে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব মিজানুর রহমান, চৌধুরী এম.এন. এ. প্রচার সম্পাদক জনাব মোমেন এডভোকেট, সমাজকল্যাণ সম্পাদক ওবায়দুর রহমান, ঢাকা জেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি জনাব শামসুল হক, ঢাকা শহর আওয়ামীলীগের সভাপতি জনাব হাফিজ মোহাম্মদ মূসা, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগ কেন্দ্রীয় পরিষদ সদস্য মোল্লা জালাল উদ্দিন আহমদ এডভোকেট পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগ সভাপতি ও প্রাক্তন মন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, প্রাক্তন এম. এ. এ জনাব আমজাদ হোসেন, এডভোকেট জনাব আমিনুদ্দিন আহম্মদ, পাবনার এডভোকেট জনাব আমজাদ হোসেন, নারায়নগঞ্জ আওয়ামীলীগ সভাপতি জনাব মুস্তফা সরওয়ার, নারায়নগঞ্জ আওয়ামীলীগ সম্পাদক জনাব মহিউদ্দিন আহমদ, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগ কার্যলয় সম্পাদক জনাব মোহাম্মদুল্লাহ, এডভোকেট ও সংগ্রামী নেতা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, ঢাকা জেলা আওয়ামীলীগ কার্যলয় সম্পাদক জনাব সিরাজউদ্দিন আহম্মদ, রাজারবাগ ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ সহ সভাপতি জনাব হারুনুর রশীদ, তেজগাও ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ সভাপতি জনাব শাহাবুদ্দিন চৌধুরী, ঢাকা সদর উত্তর আওয়ামীলীগ সম্পাদক হসাক আবদুল হাকিম, ধানমন্ডি আওয়ামীলীগ সহ সভাপতি রশিদ মোশারফ, শহর আওয়ামীলীগ কার্যালয় সম্পাদক জনাব সুলতান আহম্মদ, অন্যতম আওয়ামীলীগ কর্মী জনাব নুরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম শহর আওয়ামীলীগ অস্থায়ী সম্পাদক জনাব আবদুল মান্নান, এডভোকেট হাসনাইন, মোমেনশাহীর অন্যতম আওয়ামী কর্মী জনাব আবদুর রহমান সিদ্দিকীসহ বহু আওয়ামীলীগ কর্মী, ছাত্রনেতা ও শ্রমিকনেতাকে পাকিস্তান রক্ষার বিধি ৩২ ধারা বলে কারান্তরালে নিক্ষেপ করা হয়। আমার দুই ভ্রাতুষ্পুত্র পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক শেখ ফযলুল হক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শেখ শহিদুল ইসলামকেও কারারুদ্ধ করা হয়। অধিকন্তু পূর্ব পাকিস্তানের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় বাংলা দৈনিক ইত্তেফাককেও বর্তমান শাসকগোষ্ঠী নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এর একমাত্র কারণ হইল যে, ইত্তেফাক মাঝে মাঝে াামার প্রতিষ্ঠানের নীতিসমূহ সমর্থন করিত। সরকার ইহার ছাপাখানা বাজেয়াপ্ত করে এবং ইহার আর্ন্তজাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন ওরফে মানিক মিয়াকে দীর্ঘকালের জন্য কারারুদ্ধ রাখিয়া তাহার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি ফৌজদারী মামলা দায়ের করে। যুগপৎ চট্টগ্রাম মুসলিম চেম্বার অব কমার্সের প্রাক্তন সভাপতি, চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্টের প্রাক্তন সহ সভাপতি ও অন্যতম আওয়ামীলীগ নেতা জনাব ইদ্রিসকেও পাকিস্তান রক্ষা বিধি বলে অন্ধ কারাকক্ষে নিক্ষেপ করা হয়।
আমাদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে আমার প্রতিষ্ঠান ১৯৬৬ সালের ৭ জুন সাধারণ ধর্মঘট আহŸান করেন। প্রদেশব্যাপী এই হরতালের দিন পুলিশের গুলিতে ঢাকা ও নারায়নগঞ্জে ১১ ব্যক্তি নিহত হয়। পুলিশ প্রায় ৮০০ লোককে গ্রেফতার করে এবং অসংখ্য লোকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। পূর্ব পাকিস্তানের গর্ভনর জনাব মোনেম খান প্রায়শই তাহার লোকজন এবং সরকারী কর্মচারি সমক্ষে উন্মুক্তভাবে বলিয়া থাকেন যে, যতদিন তিনি গদীতে আসীন থাকিবেন ততদিন শেখ মুজিবকে শৃঙ্খলিত থাকিতে হইবে। ইহা অনেকেই অবগত আছেন। আটকাবস্থায় কারাকক্ষেই আমাকে বেশ কয়েকবার বিচারালয়ের সম্মুখীন হইতে হইয়াছে। প্রায় ২১ মাস আটট রাখিবার পর ১৯৬৮ সালের ১৭/১৮ তারিখ রাত একটার সময় আমাকে দৈহিক বলপ্রয়োগ করিয়া আমাকে ঢাকা সেনানিবাসে লইয়া আসে এবং একটি যুদ্ধকক্ষে আটক রাখে। আমাকে বহির্জগৎ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া নির্জনে রাখা হয় এবং কাহারও সহিত সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ করা হয়। আমাকে খবরের কাগজ পর্যন্ত পড়িতে দেওয়া হইত না, বিশ্ব হইতে সকল যোগাযোগবিহীন অবস্থায় এইভাবে আমাকে দীর্ঘ পাঁচ মাসকাল আটক থাকিতে হয়। এই সময় আমাকে অমানুষিক মানসিক নির্যাতন সহ্য করিতে হয় এবং আমাকে সকল প্রকার দৈহিক সুযোগ সুবিধা হতে বঞ্চিত করা হয়। এই মানসিক অত্যাচার সম্বন্ধে যত অল্প প্রকাশ করিতে হয় ততই উত্তম। (চলবে)
লেখক: শিশু সাহিত্যিক, বঙ্গবন্ধু গবেষক ও প্রাবন্ধিক