নূর আহমদ চেয়ারম্যান এবং চট্টগ্রাম পৌরসভায় শিক্ষা বিপ্লব : একটি পর্যালোচনা

713

বিশ শতকের শুরুতে চট্টগ্রাম শহরের এনায়েতবাজার ওয়ার্ডে পÐিত কলিমউল্লাহ মাস্টার এনায়েত বাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় (বর্তমান কলিমউল্লাহ মাস্টার প্রাথমিক বিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শহর চট্টগ্রামে সাধারণ শিক্ষার গোড়াপত্তন করেন। কলিমউল্লাহ মাস্টার নিজেই এ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন এবং সমৃদ্ধ চট্টগ্রামের স্বপ্নদ্রষ্টা প্রখ্যাত নূর আহমদ চেয়ারম্যান ছিলেন এ বিদ্যালয়ের ছাত্র। সম্ভবত কলিমউল্লাহ মাস্টারের বিদ্যোৎসাহী মনোভাব নূর আহমদের চেতনাকে শানিত করে এবং সময় ও সুযোগের সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে বাধ্যতামূলক অবৈতনিক শিক্ষার প্রচলন করেন। অতি দ্রæত এ ব্যবস্থাকে পুরো শহরব্যাপী ছড়িয়ে দিয়ে তিনি শুধু ভারতে নয়; এশিয়ায়ও আলোচিত হন। তাঁর এ অবিস্মরণীয় প্রচেষ্টায় শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা শিক্ষার্থীই বৃদ্ধি পায়নি, বরং শিক্ষার হারে অবিভক্ত বাংলায় চট্টগ্রাম পৌরসভা সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছে ছিল। চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ কর্তৃক ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত মাসিক মুখপত্র ‘চট্টগ্রাম সংবাদ’-এ আলাদীন আলী নূর লিখিত প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়, “ব্রিটিশ যুগে অবিভক্ত ভারত উপমহাদেশসহ সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ায় সর্বপ্রথম ভারতের বরোদায় অবৈতনিক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তিত হয় এবং দ্বিতীয় দৃষ্টান্তস্বরূপ চট্টগ্রামে জনাব নূর আহমদ সাহেব ১৯২৭ সনে অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষা চালু করেন। বর্ণিত অঞ্চলে তখনো কিন্তু বালিকা প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তিত হইয়া ছিল না”। আলাদীন আলী নূর-এর এ বক্তব্যের স্বপক্ষে আর কোন তথ্য পাওয়া না গেলেও ধরে নেয়া যায় অবৈতনিক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয় পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় নূর আহমদ চেয়ারম্যানই প্রথম চট্টগ্রামে প্রবর্তন করেন। ১৯২১ সালে নূর আহমদ চট্টগ্রাম পৌরসভার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৫৪সালে তিনি শারীরিক অক্ষমতার অজুহাতে অব্যাহতি নেন। এ দীর্ঘ তেত্রিশ বছর তিনি চট্টগ্রামের অবকাঠামোর উন্নয়ন ও নাগরিক সুযোগ-সুবিদার পাশাপাশি মানুষের মননের উন্নয়নে শিক্ষা নামক বৃক্ষের যে বীজ বপন করেন তা আজ মহীরুহ রূপধারণ করেছে।


জন্ম, শিক্ষা ও কর্মজীবন : ১৮৯০ খ্রিঃ ২৫ ডিসেম্বর নূর আহমদ উক্ত আলকরণ মহল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হাজী আমজাদ আলী সওদাগর চট্টগ্রামের একজন খ্যাতিমান ব্যবসায়ী ছিলেন। আমজাদ আলীর পৈত্রিক নিবাস ছিল ফেনী জেলার পরশুরাম থানার চন্ডুল নামক গ্রামে। শৈশবকালে তিনি পিতার সাথে চট্টগ্রামের আলকরণে এসে বসবাস শুরু করেন। নূর আহমদ চেয়ারম্যানের মাতা পেয়ারজান। তিনিও ছিলেন সুপ্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান ও মহীয়সী। পিতা ও মাতার অতি আদরের সন্তান নূর আহমদ পিতার ব্যবসায়ী ব্যস্ততার মধ্যেও নিজপুত্রের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং তাঁকে একজন ভবিষ্যত সু-নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর কর্তব্যবোধ থেকে তিনি বিচ্যুত হননি। তা ছাড়া নূর আহমদের প্রচÐ মেধা এবং শিক্ষা অর্জনের প্রতি তার একাগ্রতা তাঁকে অভীষ্ট লক্ষে নিয়ে গিয়েছিল। নূর আহমদ-এর শিক্ষা জীবনের সময়কাল, শহরে জীবন ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা সবগুলো বিবেচনায় তিনি শিক্ষা জীবনের সূচনালগ্ন থেকে ‘প্রথম’ শুধু প্রথম স্থান অর্জন করে সর্বোচ্চ ডিগ্রি পর্যন্ত একই ধারায় শিক্ষা জীবন শেষ করেছিলেন। পরবর্তীতে কর্ম ও মর্মকে ধারণ করে জীবনেও যে প্রথম স্থান নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন তাঁর দৃষ্টান্ত তৎসময়ে পুরো বাংলা অঞ্চলে দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। জানা যায়, চার বৎসর ৬মাস বয়সে পিতা নূর আহমদকে স্থানীয় মসজিদের মক্তবে ধর্মীয় প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তি করা হয়। সাত বৎসর বয়সে তাঁকে এনায়েত বাজারে মাষ্টার কলিম উল্লাহ্ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্ত করা হয়। বিশ শতকে আলকরণ, এনায়েতবাজার, আন্দরকিল্লা, জামালখান এলাকা মিলে এটিই একমাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। কলিম উল্লাহ মাষ্টার এ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন এবং নূর আহমদ এর ছাত্র ছিলেন। ১৯০৩ সালে এখান থেকে তিনি পঞ্চম শ্রেণিতে প্রথম স্থান লাভসহ প্রাইমারি বৃত্তি লাভ করেন। এরপর তিনি মিউনিসিপ্যাল হাই স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯১০ সালে এন্ট্রাস পরীক্ষায় জেলা বৃত্তি নিয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। ১৯১২ খ্রি. চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে দুটি স্কলারশীপ (চট্টগ্রাম জেলা ও বিভাগীয়)সহ আই.এ পাশ করে একই কলেজে আরবি ও ফার্সি বিভাগে বি.এ অনার্সে ভর্তি হন। ১৯১৫ খ্রি. বি.এ অনার্স-এ প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান লাভ করেন। পরের বছর ১৯১৬ খ্রি. কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ইতিহাসে এম.এ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে গোল্ড মেডেল লাভ করেন। ১৯১৭ খ্রি. তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএল (আইন) পরীক্ষায় ও প্রথমস্থান লাভ করে চট্টগ্রামে ফিরে আসেন এবং আইন পেশায় যোগদান করেন। ১৯০৩ থেকে ১৯১৭ সন পর্যন্ত চৌদ্দ বছরের বর্ণাঢ্য শিক্ষাজীবনের প্রতিটি পরীক্ষায় নূর আহমদের অভূতপূর্ব সফলতা তৎকালীন নয় শুধু, বর্তমান সময়েও বিরল বললে অত্যুক্তি হবে না। অথচ তাঁর তী² মেধা ও ঈর্ষনীয়ভাবে সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করা সত্তে¡ও ইংরেজ আমলের লোভনীয় সরকারি চাকরি, শিক্ষকতা বা পৈত্রিক ব্যবসা কোনটিতে না গিয়ে নিজের অর্জনকে চট্টগ্রামবাসীর জন্য উৎসর্গ করতে মনস্থির করলেন। তাই শিক্ষাজীবন শেষে মাত্র এক বছর আইন পেশায় থেকে তারপর আধুনিক চট্টগ্রামের এক দুর্ভেদ্য স্বপ্ন নিয়ে পুরোপুরি সমাজ সেবার ব্রতে নেমে পড়েন। প্রফেসর শায়েস্তা খান ২০১১ সালের দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশের বর্ষপূর্তি সংখ্যায় “নূর আহমদ চেয়ারম্যান ‘জনপ্রিয়’ নেতা ছিলেন নাÑ ছিলেন জনগণের ‘প্রিয়জন’ শিরোনামে লিখিত নাথিদীর্ঘ প্রবন্ধে বলেন ‘যেহেতু ব্রিটিশ শাসনামলে তৎকালীন বাঙালি মুসলমানদের সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান খুবই কম ছিল, তাই রাজনীতির মাধ্যমে সমাজ সেবার উদ্দেশ্যে তিনি আইন পেশা ছেড়ে সমাজসেবার অঙ্গনে পদচারণা শুরু করেন’। প্রফেসর শায়েস্তা খাঁন-এর উক্ত মতামত নূর আহমদের কর্ম ও রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ ও কার্যক্রমের সুস্পষ্ট প্রমাণ মিলে।
নূর আহমদের শিক্ষাজীবনের এসব সফল ও আনন্দময় অভিযাত্রায় একেবারে যে, কন্টকমুক্ত ছিল তা নয়। বরং প্রতিকুলতার প্রচÐ ঝড়-তুফান অতিক্রম করে বীরের ন্যায় শিক্ষা জীবনের সফলতাকে জয় করেছিলেন। কারণ তিনি যখন সপ্তম শ্রেণিতে, বয়স যখন ১৭ বছরের কাছাকাছি ১৯০৭ খ্রি. তার পিতা হাজী আমজাদ আলী মৃত্যুবরণ করেন। অভিভাবকহীন তরুণ নুর আহমদের পিতার মৃত্যুতে শূন্যতা শোকবহমান হৃদয় যখন উদ্বিগ্ন তখন আত্মীয়স্বজন ও মহল্লার মুরব্বীদের নিকট থেকে নির্দেশ আসে পড়ালেখা এতটুকুতে ছুকিয়ে যেন পৈত্রিক ব্যবসার হাল ধরেন। তৎসাথে বিয়ের প্রস্তাবটি ছিল বিব্রত ও বিচলিত করার মত। সামাজিক দায়বদ্ধতাকে কাঁধে নিয়ে অনেকটা বাধ্য হয়ে ১৭ বছর বয়সে চট্টগ্রামের তৎকালীন প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী হাজী চান্দ মিয়া সওদাগরের কন্যার সাথে তাঁর বিয়ে হয় । একজন ধার্মিক ও বিদ্যুৎসাহী ব্যক্তি হাজী চান্দ মিয়া, অধ্যাবসায়ী, সৎ ও ধার্মিক জামাতা পেয়ে যেন তার মনিকাঞ্চন যোগ হয়েছিল। অল্প সময়ে বিয়ের পিড়িতে বসা, পিতার ব্যবসা-বাণিজ্য দেখাশোনার মধ্যেই শিক্ষা জীবনেও কোন রকম ছেদ পড়তে দেননি নুর আহমদ নিজেই। তাঁর স্বপ্ন তাঁকে ঘর-সংসার ও পশ্চাদপদ চিন্তা থেকে বহুদূরে নিয়ে গিয়েছিল তখন “সন্তান হইতে সাধনা করিলেÑ লভিবে জন্মভূমি” এ চেতনায় পথ চলা বৈ আর কী-বা উপায় ছিল। এসব তীর্যক অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে শিক্ষাজীবন যখন একেবারে শেষপ্রান্তে তখন জননী পেয়ারজান বিবি (১৯১৭ খ্রি.) মৃত্যুবরণ করেন।
পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে নূর আহমদ : স্বপ্ন দেখা আর তা বাস্তবায়ন করার সুযোগ খুব কম মানুষের ভাগ্যে জোটে। চট্টগ্রাম পৌরএলাকার তৎকালীন সময়কালের সর্বোচ্চ ডিগ্রিপ্রাপ্ত শিক্ষিত ব্যক্তিত্ব নূর আহমদ সর্বশেষ আইন ব্যবসা ত্যাগ করে ১৯২১ সালে চট্টগ্রাম শহরের উন্নয়ন, শিক্ষা, সংস্কৃতি বিকাশ ও চট্টগ্রামবাসীর মৌলিক সমস্যার সমাধান করে চট্টগ্রাম বন্দর, শহরকে আধুনিক নগরীতে পরিণত করার প্রত্যয় নিয়ে মিউনিসিপ্যালটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। বহু প্রতিক‚লতা, প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর প্রতিবন্ধকতা, আর্থিক দৈন্যতা ও উপনিবেশ শাসকের অধীনে পরিচালিত প্রশাসনিক বিভিন্ন জটিলতার মধ্যে ও নূর আহমদ চেয়ারম্যান তার স্বপ্নের শহর চট্টগ্রামকে বিশ্বের দরবারে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। নিম্নে তা আলোচনা করা হল।
অবৈতনিক বাধ্যতামূলক প্রাইমারি শিক্ষার প্রবর্তন : নূর আহমদ চেয়ারম্যান তাঁর গভীর চিন্তা ও প্রত্যয় থেকে চিটাগাং মিউনিসিপ্যালটির পরিচালনায় ১৯২৭ খ্রি. পৌরসভা এলাকায় অবৈতনিক বাধ্যতামূলক প্রাইমারি শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। এটি ছিল শুধু চট্টগ্রাম নয়; পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্য একটি স্মরণীয় অধ্যায় ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ। একবছর পর ১৯২৮ খ্রি. উক্ত অবৈতনিক প্রাইমারি শিক্ষাকে মেয়েদের জন্য বাধ্যতামূলক করে বিশ্বব্যাপী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। নূর আহমদ শুরুতে কয়টি বিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন সেই সম্পর্কে সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের রেকর্ড অনুসন্ধান করেও সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ১৯৫৪ সালে যখন নূর আহমদ চেয়ারম্যান স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছিলেন তখন মোট ২১ টি বিদ্যালয়ের একটি নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়। ১৯৭৫ সালে বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাইমারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দাঁড়ায় বালক ২৪টি ও বালিকা ২৩ টি।
নূর আহমদ চেয়ারম্যান এর প্রবর্তিত প্রাইমারি শিক্ষাব্যবস্থাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক বিষয়টি এতদঞ্চলে নতুন ধারণা। ইতোমধ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পরিচালনায় ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় কয়েকটি প্রাইমারি, এন্ট্রাস স্কুল, কুইন্স স্কুল (ইংরেজি মাধ্যম), মীর এয়াহিয়া স্কুল (আরবি ও ফার্সি মাধ্যম), পরে নর্ম্মাল ও মাদ্রাসা স্কুল নামে দু’ধারার শিক্ষা পদ্ধতি চালু হলেও এতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল অপ্রতুল। গুরু ঠাকুর, মৌলভী ও মাস্টার মশাইগণের বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষার্থীদের স্কুলে আনা দায় হয়ে পড়েছিল। ১৮৮৫ সালে কাজেম আলী মাস্টার (১৮৫২-১৯২৬) চিটাগাং মিডল ইংলিশ৩১ স্কুল প্রতিষ্ঠার পর তাঁকে রীতিমত রাস্তায় ও মহল্লায় হেঁটে হেঁটে শিক্ষার্থীদের স্কুলে আনতে হতো। নূর আহমদ চেয়ারম্যান শহর চট্টগ্রামবাসীদের তিক্ত অথচ বাস্তবতা উপলব্ধি করেই ৫ থেকে ১১ বৎসর বয়সি সকল শিশু, কিশোর-কিশোরীকে স্কুলে ভর্তি ও নিয়মিত স্কুলে পাঠানোর জন্য নিম্নোক্ত কঠোর পদক্ষেপগুলো নিয়েছিলেন:
১. চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালটি এলাকার ৫-১১ বৎসর বয়সি প্রত্যেক ছেলেমেয়েকে বাধ্যতামূলক স্কুলে ভর্তি করতে হবে। মিউনিসিপ্যালটি এ ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা হুবহু নিম্নোক্ত “যদি ৫ হইতে ১১ বৎসর বয়স্ক ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি করাইয়া দেওয়া না হয়, তবে বাধ্যতাম‚লক প্রাথমিক শিক্ষা আইন বলে কোর্টের মারফত এই সব ছেলেমেয়েদের অভিভাবকগণকে এইসব ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি করাইয়া দেওয়ার ব্যাপারে বাধ্য করা যাইতে পারে। এই আইন অমান্য করা কোর্টের দÐনীয় অপরাধরূপে গণ্য। অনুন্নত, অজ্ঞ, নিরক্ষর ও দরিদ্র জনসাধারণের মধ্যে সর্বাত্মক প্রাথমিক শিক্ষা চালু করিতে হইলে এই অবৈতনিক বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন বলবৎ করা ছাড়া গত্যন্তর নাই।
২. ছেলে মেয়েরা বিনা কারণে একাক্রমে ১৫দিন স্কুলে অনুপস্থিত থাকলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ।
৩. মেয়েদের স্কুলগুলোকে ঝি (আয়া) নিয়োগ করে বাসা থেকে আনা-নেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ।
৪. শিক্ষকদের দায়িত্ব পালন ও পাঠদান নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পৌরসভার স্কুল পরিদর্শক পদে কর্মকর্তা নিয়োগ দান ইত্যাদি।
উল্লেখিত আইন অতিসত্বর কার্যকর হওয়ার ফলে দেখা যায় ১৯৩২-৩৩ সালে ৪৮৫জন পৌরবাসী অভিভাবকের নিকট তাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি না করার অপরাধে সতর্কীকরণ নোটিশ পাঠানো হয়েছিল। এর মধ্যে ১১৯জন অভিভাবক আইন অমান্য করলে তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা দায়ের হয়েছিল বলে জানা যায়। নূর আহমদ চেয়ারম্যানের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, অভিভাবকদের মধ্যে প্রতিক্রিয়াশীল কতেক চেয়ারম্যানকেও সহজে ছেড়ে দিবেন না- এমন মনোভাব পোষণ করতে দেখা যায়। ফলশ্রæতিতে স্বার্থান্বেষী উক্ত মহল চেয়াম্যানের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলা করে অপদস্থ করার প্রয়াস চালিয়েছিল। অবশ্য বিজ্ঞ আদালত মামলাটি খারিজ করে দেন।
জানা যায়, নূর আহমদ চেয়ারম্যান নিজেই মাঝেমধ্যে স্কুলগুলো পরিদর্শন করতেন এবং কোন রকম অনিয়ম বা শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিত দেখলেই ত্বরিৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন। তা ছাড়া পৌরসভা কার্যালয়ে এ সংক্রান্ত একটি অভিযোগবক্স একইভাবে বাড়ির বৈঠকখানায়ও একটি অভিযোগবক্স স্থাপন করেন। যেখানে নগরবাসী শিক্ষাসহ বিভিন্ন বিষয়ে অভিযোগনামা ফেলতেন। নূর আহমদ চেয়াম্যান প্রতিদিন বিকেলে বক্স দুটি খুলতেন এবং শিক্ষা সংক্রান্ত কোন অভিযোগ পেলে ত্বরিৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন বলে জানা যায়। দেখা যায়, নূর আহমদ চেয়ারম্যানের বিচক্ষণতা ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত তার পরিকল্পনার বাস্তবায়ন ও চিন্তার প্রসারতাকেই শুধুই এগিয়ে নেয়নি; বরং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শ্রেষ্ঠ বন্দর ও বাণিজ্য নগরী চট্টগ্রামকে বিশ্ব ইতিহাসে নতুনভাবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। চট্টগ্রাম শুধু ব্যবসা-বাণিজ্যে নয়; বরং শিক্ষার ক্ষেত্রেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শ্রেষ্ঠ আসনটি অর্জন করেছিলেন। এ সময়ে চট্টগ্রামই একমাত্র নগরী বা পৌরশহর যার শিক্ষার হার অবিভক্ত বাংলায় সর্বোচ্চ। এ বিষয়ে ১৯৪২ খ্রি. তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের বঙ্গীয় আইন পরিষদের অধিবেশনে অবিভক্ত বাংলার শিক্ষার অগ্রগতির বর্ণনা দিতে স্পষ্টভাবে বলেছিলেনÑ “শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলার মানুষ আজ আর পিছিয়ে নেই। আমি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর হতে এ পর্যন্ত শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের রিপোর্ট অনুযায়ী দেখা যায় যে, শিক্ষার হার ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হারের দিক দিয়ে সমগ্র বাংলার (অবিভক্ত বাংলা) পৌর এলাকায় চট্টগ্রাম পৌর এলাকা সর্বোচ্চ স্থান দখল করেছে। আর চট্টগ্রাম পৌর এলাকার এ সম্মানজনক অবস্থানের জন্য কৃতিত্বের দাবীদার হলেন এই পরিষদের (বঙ্গীয় আইন পরিষদ) সম্মানিত সদস্য জনাব নূর আহমদ। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর নিকট আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। এখানে একটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে, নূর আহমদ চেয়ারম্যানের ৩৩ বৎসরের সময়কালের প্রায় ২৬ বৎসরই ছিল ব্রিটিশ শাসনামল, বাকী ৮ বৎসর ছিল পাকিস্তান শাসনামল।
ব্রিটিশ আমলে যেখানে শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করে শিক্ষাকে পরিপূর্ণ ইংরেজি মাধ্যম বা মিশনারি শিক্ষায় রূপান্তর করে তাদের উপনিবেশ শাসনকে দীর্ঘতর করার অপপ্রয়াসে লিপ্ত ছিল। সেখানে বিচক্ষণ নূর আহমদ চেয়ারম্যান বাধ্যতামূলক বাংলা মাধ্যম প্রাইমারি শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে উপনিবেশ শাসকদের বিরুদ্ধে বুদ্ধিভিত্তিক চ্যালেঞ্জ (ওহঃবষবপঃঁধষ ঈযধষষধহমব) ছুড়ে দিয়েছিলেন এটি মূলত তাঁর দেশপ্রেমের স্বাক্ষর। ১৯১৮ সালের দিকে আমরা কাজেম আলী মাস্টারকেও একইরূপে দেখেছি। তিনি কাজেম আলী স্কুল প্রতিষ্ঠা করে চট্টগ্রামে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্র সৃষ্টি করার বুদ্ধিভিত্তিক প্রয়াস চালিয়েছিলেন। তাদের চিন্তাধারা সফলও হয়েছিল অনেকাংশে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্তি ও ব্রিটিশ উপনিবেশ শোষণ থেকে স্বাধীনতা লাভের পরও নূর আহমদ চেয়ারম্যান চট্টগ্রাম পৌরসভার চেয়ারম্যান পদে পুনঃনির্বাচিত হয়েছিলেন এবং তাঁর বাধ্যতামূলক অবৈতনিক শিক্ষার কার্যক্রমকে আরো গতিশীল করেছিলেন। ১৯৫৪ খ্রি. পর্যন্ত চেয়ারম্যানের পদে থেকে তিনি চট্টগ্রামের উন্নয়নে গতিধারার প্রধান অবলম্বন হিসেবে তিনি শিক্ষা শুধু শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। এতে শুধু চট্টগ্রামের খ্যাতি ছড়ায়নি; বরং পুরো বাংলার খ্যাতি বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছিল।
এড়াবৎহসবহঃ ধহফ চড়ষরঃরপং রহ চধশরংঃধহ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছেÑ ‘ঞযব ছঁবংঃরড়হ যড়ি ধিং ারৎঃঁধষষু ধ সড়হড়ঢ়ড়ষু ড়ভ গৎ. ঘঁৎ অযসবফ রহ ঃযব ১৯৫৩ ্ নঁফমবঃ ংবংংরড়হ ড়ঁঃ ড়ভ ধ ঃড়ঃধষ ড়ভ ১১৪০ য়ঁবংঃরড়হং ঃড় যিরপয ড়ৎধষ ড়ৎ ৎিরঃঃবহ ৎবঢ়ষরবং বিৎব মরাবহ, ৪৬৮ বিৎব ধংশবফ নু গৎ. অযসবফ ধষড়হব. নূর আহমদ গণপরিষদে কোন বিল উত্থাপন করলেই তা পরিষদ বিবেচনা করত। তিনি ১৯৪২ সালে আইন পরিষদে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং চট্টগ্রাম পৌরসভার পক্ষ থেকে পাঁচশ টাকার একটি চেক প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের নিকট হস্তান্তর করেছিলেন। তাছাড়াও তিনি হোমিওপ্যাথিক বোর্ড প্রতিষ্ঠার দাবি প্রস্তাব আকারে আইন পরিষদে উত্থাপন করেন এবং তা আইন পরিষদ পাশ করে। চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমী প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা অবিস্মরণীয়।
লেখক : সহকারী সম্পাদক, দৈনিক পূর্বদেশ