নুসরাত হত্যা মামলার রায় আজ

20

অধ্যক্ষের যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি, যে কারণে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল তাকে। আলোচিত সেই ঘটনার মামলাটির রায় হতে যাচ্ছে আজ বৃহস্পতিবার। মামলার সাত মাসের মধ্যে ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশীদ এ রায় দিতে যাচ্ছেন। ৬২ কার্যদিবস শুনানির পর এই রায় দেওয়া হচ্ছে, যাকে নজিরবিহীন বলেছেন আসামি পক্ষের কৌঁসুলি এম শাহজাহান সাজু।-খবর বিডিনিউজের
তিনি দাবি করেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো হত্যা মামলার আলামত হিসেবে কোনো তথ্য প্রজেক্টরের মাধ্যমে আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে। এ মামলার মূল দলিল হিসেবে নথিতে থাকা আদালতে প্রদর্শিত অডিও-ভিডিওর মাধ্যমে ঘটনার সঙ্গে আসামিদের সম্পৃক্ততা উন্মোচিত হয়। ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি হাফেজ আহমেদ আশা করছেন রায়ে ১৬ আসামির সবারই সর্বোচ্চ সাজা হবে।
তিনি বলেন, ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)- এর ৪ (১) ও ৩০ ধারায় রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগ প্রমাণ করেছে। রাষ্ট্রপক্ষ আশা করছে, রায়ে সব আসামি সর্বোচ্চ সাজা পাবে।’
কারও গায়ে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে হত্যার অপরাধে এই আইনের ৪ (১) ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদন্ড; সেই সঙ্গে সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা অর্থদন্ড। আর ৩০ ধারায় এই ধরনের হত্যায় প্ররোচনাও দন্ডনীয়।
মামলার আসামিদের সবাই গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন। রায়ের সময় তাদের সবাইকে আদালতে উপস্থিত করা হবে বলে জানিয়েছেন পিপি হাফেজ আহমেদ।
এদিকে আসামি পক্ষ থেকে নানা ধরনের হুমকি পাচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছে নুসরাতের পরিবার। তার মধ্যেই তারা আদালতের কাছে সন্তান হত্যার সুবিচারের আশায় রয়েছেন।
নুসরাতের পরিবারের জন্য বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থার কথা জানিয়েছে ফেনী পুলিশ; রায় ঘিরেও সতর্ক রয়েছে তারা।
সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা থেকে এবার আলিম পরীক্ষা দিচ্ছিলেন নুসরাত। ওই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ দৌলার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তুলেছিলেন তিনি। ওই ঘটনায় নুসরাতের মা মামলা করার পর গত ২৭ মার্চ পুলিশ গ্রেপ্তার করে অধ্যক্ষ সিরাজকে।
সিরাজ গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার পক্ষে নামে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। তার মুক্তি দাবিতে মানববন্ধনেও সক্রিয় ছিল মাদ্রাসার কিছু শিক্ষার্থী। মামলা তুলে নিতে ক্রমাগত হুমকিও দেওয়া হচ্ছিল বলে নুসরাতের পরিবারের অভিযোগ। এর মধ্যেই ৬ এপ্রিল পরীক্ষা শুরুর আগে পরীক্ষা কেন্দ্র সাইক্লোন শেল্টারের ছাদে নুসরাতকে কৌশলে ডেকে নিয়ে তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। অগ্নিদগ্ধ নুসরাতকে ঢাকায় এনে বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছিল; টানা পাঁচ দিন যন্ত্রণা সহ্য করে ১০ এপ্রিল মারা যান তিনি।
নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়ার দুদিন পর তার ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান আটজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও কয়েকজনকে আসামি করে হত্যাচেষ্টার মামলা করেন। নুসরাতের মৃত্যুর পর এটি হত্যা মামলায় পরিণত নেয়।
নুসরাতকে যখন ঢাকা মেডিকেলে আনা হয়েছিল, তখনও তিনি বলছিলেন, তিনি প্রতিবাদ করে যাবেন। প্রতিবাদী এই তরুণীর জন্য প্রতিবাদে ফেটে পড়েছিল দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ। বিচারের দাবিতে কর্মসূচি পালিত হয় গোটা দেশজুড়ে।
৭ এপ্রিল নুসরাত ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসকদের কাছে মৃত্যুকালীন জবানবন্দি দেন, যাতে তিনি অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে যান।
নুসরাত হত্যার মামলটি তদন্ত প্রথমে করছিলেন সোনাগাজী থানার পরিদর্শক কামাল হোসেন; কিন্তু ওই থানার ওসিসহ পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নুসরাত হত্যাকান্ডের সময় গাফিলতির অভিযোগ উঠলে তদন্তভার আসে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) উপর।
পিবিআইর পরিদর্শক শাহ আলম এজহারভুক্ত আট আসামির সঙ্গে আরও আটজনকে যুক্ত করে ১৬ জনকে আসামি করে গত ৫ মে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। তার পরের মাসে ২০ জুন ১৬ অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ১৬ আসামির বিচার। ৯২ জন সাক্ষীর মধ্যে ৮৭ জনের সাক্ষ্য নেওয়ার পর গত ৩০ সেপ্টেম্বর রায়ের দিন ঠিক করে আদালত।
অধ্যক্ষ সিরাজের বিরুদ্ধে প্রথম মামলায় নুসরাতের জবানবন্দি নেওয়ার ভিডিও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেওয়ায় সোনাগাজী থানার তৎকালীন ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে ঢাকার বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালে আলাদা মামলা হয়েছে।
নুসরাতের মা সোনাগাজী পৌরসভার চরচান্দিয়া গ্রামের বাসিন্দা শিরীনা আক্তার অভিযোগ করেছেন, এখনও তাদের নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে আসামিদের স্বজনরা।
তিনি বলেন, ‘তারা বলে, বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে ফেলবে, ঘরে বাতি দেওয়ার মতো কোনো লোক থাকবে না।’
দীর্ঘদিন ধরে যে পুলিশ পাহারা রয়েছে, তা রায় কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত রাখার অনুরোধ জানান তিনি।
আসামিদের কেমন সাজা আশা করছেন- জানতে চাইলে শিরীনা আক্তার বলেন, ‘আমার কলিজার টুকরা একমাত্র মেয়েকে ঘাতকরা যেভাবে হাত-পা বেঁধে পুড়িয়ে হত্যা করেছে, তেমন কঠিন সাজা যেন দেওয়া হয় প্রত্যেক আসামিকে। এমন শাস্তি হোক, যেন পৃথিবীর অন্য কোথাও কোনো মায়ের বুক এভাবে খালি না হয়।’
সোনাগাজী মডেল থানার ওসি মঈদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ঘটনার পর থেকে নুসরাতের বাড়িতে পুলিশ পাহারা রয়েছে। রায়কে কেন্দ্র করে বাড়িতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়েছে। সাদা পোশাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও নজরদারি করছে।’
৮০৮ পৃষ্ঠার ওই অভিযোগপত্রে ‘হুকুমদাতা’ হিসেবে অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাকে এক নম্বর আসামি করা হয়। অভিযুক্ত ১৬ জন আসামির মধ্যে ১২ জন আসামি আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।