নুরার গৃহবাস

30

বেশ কদিন মানসিক বিপর্যস্তে ছিলো নুরা।গৃহবন্দী জীবন তার কখনো ভালো লাগে না।ক্লাস এইটে পড়ার সময় ক্লাস টেনের এক বড়ভাই তার হাতে চিরকুট গুজে দিয়েছিলো কমনরুমে র বাইরে ডেকে এনে।এবং সেটা দেখে ফেলে নুরার ইমিডিয়েট বড় মিনার ভাই।বাসায় যেতে না যেতেই মা র হাতে শলার ঝাড়ু দেখে রীতিমতো ভীমড়ি খাওয়ার যোগাড় নুরার। উত্তম মধ্যম খাওয়ার পর বুঝলো ভাইয়ার কাজ এসব।মা কে এসে লাগিয়েছে। সে তখন একটানা ১৫ দিন মা স্কুল যেতে দেয়নি। কি গুমোট ভাব মনে। বিশ্রী এক অবস্থা নুরার।কেউ তেমন কথা বলেনা।কেমন চোখে সবাই তাকায়।মনে মনে চিরকুট যে দিয়েছিলো হাতে তাকে অভিসম্পাত দিতে লাগলো।ভাবলো আর কোনদিন যদি কারো দেয়া চিঠি চিরকুট হাতে নেয়। তাহলে ওর নাম নুরা ই না। ক্লাস টেনের সে বড় ভাই অনেক চেষ্টা তদবির করলো নুরার মন পেতে। একে ওকে দিয়ে নানা গিফট ও পাঠাতে লাগলো। নুরা কেউ না দেখে মতো তা ফেরত পাঠালো প্রাপক বরাবরে। স্কুলের সবচেয়ে স্মার্ট সুন্দর ছেলেটা প্রত্যাখ্যাত হলো নুরার জীবন থেকে। আর কোন দিন ও ছেলের দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস দেখায়নি নুরা।মা র হাতের মার খাওয়ার ইচ্ছে আর নেই তার।
নুরার ক্লোজ ফ্রেন্ড মিতি অনেক ধানাইপানাই করলো ঐ ছেলের সাথে যোগাযোগ রাখার জন্য। মিতিটা একটু ওরকমই। এ বয়সে দু’চার টা প্রেম করেই ফেলেছে। মিনার ভাইয়া এটাও জানতো।নুরাকে প্রায়ই শাসাতো মিতির সাথে যেন না মিশে। নুরা মিতিকেও এড়িয়ে চলতে শুরু করলো এরপর থেকে। হুটহাট প্রেমে পড়ার কারণে মিতিটা লেখাপড়ায় অনেক পিছিয়ে পড়লো দিনদিন। নুরার কাছে এটাও একটা ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ালো।চুলোয় যাক ওসব আগে পড়াশোনা। বাবা-মা র মুখ উজ্জ্বল করাই নুরার একমাত্র ধ্যানজ্ঞান।
প্রথম প্রেম এভাবে উধাও হলো নুরার জীবন থেকে।
তারপর অনেক সময় বাদে বড় বড় মায়াবী চোখের ইশারায় নুরা ধরা খেলো আবার। তবে কেউ জানলো না, বুঝলো না। বয়সে দু তিন বছরের সিনিয়র ইশতিয়াক হোসেন নুরাকে অপেক্ষায় রেখে পাড়ি জমালো সাত সাগর তেরো নদীর ওপাড়ে ভেনিসের শহরে।
একটা সুপারশপ চালায় ইশতিয়াক নিজে।প্রায়ই দুসপ্তাহ থেকে তার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না।
শপে ও যায় না অনেকদিন। নিজে এটা ওটা নানা ওষুধ খেলো সেরে যাওয়ার জন্য।
নুরা যতোই বলে তুমি হসপিটালে যাও চেক আপ করো।ইশতিয়াক তাতে ভয়ে কুঁকড়ে যায়। অনীহা প্রকাশ করে। অজানা আশংকায় ইশতিয়াকের মন শংকিত হয়ে উঠে। চেক আপ টেস্ট এসব করতে যেয়ে আবার কি না কি ধরা দেয়। তারচেয়ে এই ভালো টুকটাক ওষুধে কাজ সারুক – আল্লাহ ভরসা।নুরাকেও আশ্বস্ত করে ইশতিয়াক। ভয় না পাওয়ার। আর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলে—
তোমাকে না পাওয়া অবধি আমি কোত্থাও যাচ্ছি না নুরা।আসছে বসন্তে আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা। তুমি ভুলে গেলেও আমি কিন্তু ভুলিনি। সো না যাওয়াযাওয়ি।আমি আছি থাকবো, যতোদিন তুমি আছো।
একনাগাড়ে কথাগুলো বলার সময় খুকখুক করে কাশিও দিতে লাগলো ইশতিয়াক। নুরার মনটা আরও বিষন্ন হয়ে পড়লো তা শুনে।
যতই ইশতিয়াক কে বুঝাতে চাইলো – ইশতি এসব তো ভালো ল²ণ না।প্লিজ তুমি হসপিটালে যাও। ডক্টরের পরামর্শ নাও।তারপর ওষুধ খাও।
ইশতিয়াক হেসেই উড়িয়ে দিলো নুরার কথা — আরে বোকা এখানে স্নো পড়ছে। তাই ঠান্ডা থেকে এরকম এক আধটু সারাবছরই লেগে থাকে। ডোন্ট ওরি মাই ডিয়ার।তুমি নিশ্চিন্তে ঘুমুতে যাও।আমি রাখছি।আবার দুদিন বাদে কথা হবে। বাই

সে দুদিন বাদে আর আসেনি ইশতিয়াক যোগাযোগের কোন মাধ্যমেই। নুরা আর কোন ভাবে যোগাযোগ করতে পারেনা তার ইশতির সাথে। না ফোনে, ম্যাসান্জারে, ইমুতে হোয়াটসঅ্যাপ কোত্থাও নেই তার ইশতিয়াক।
গৃহবন্দী জীবনের এগারতম দিনে টিভি তে চোখ রাখতেই নুরা দেখতে পায় ইতালিতে করোনায় আক্রান্ত ২৮ বছরের ইশতিশাক হোসেন নামের বাঙালির মৃত্যুর নিউজ।
মা নিউজের মাঝখানে বলে উঠলো— – আহারে কোন অভাগীর বুক খালি হলো কে জানে?
নোনা জলের ফোঁটায় নুরার দুচোখের পাতা ভারী হয়ে উঠলো।
নুরার গৃহবন্দী জীবন কখনো সুখকর হয়না – সেটা ও খুব ভালো করে জানে।