নুনভাত

184

কার্তিক মাস। ধান কাটার মৌসুম শুরু হয়েছে। ছেঁড়া কাঁথাগুলো পুঁটলি করে বাঁধে তারা। জং ধরা কাস্তেটা কামারের দোকান থেকে নতুন আল উঠিয়ে গুঁজে পুটলির ভেতরে। গামছাটা শক্ত করে কোমরের সঙ্গে বাঁধে। ভার বাওয়া লাঠির আগায় বাঁধে কাঁথার পুটলিটা। তারপর লাঠিটা কাঁধে ফেলে দলে দলে বেরিয়ে পড়ে। গুড়ের গন্ধে পিঁপড়ের দল যেমন ছোটে, তেমনি সার বেঁধে হাঁটে তারা। চর অঞ্চালের বড় বড় পাকা ধানের মাঠগুলো তাদেরকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। শোনা যাচ্ছে, এবার চরে খুব ধান হয়েছে। পাকা ধানের সোনালী ক্ষেতের শিশির ভেজা ছবি তাদের মনে স্বপ্ন এনে দেয়। ক্ষেতভরা পাকাধান তাদের মনে নেশা ধরিয়ে দেয়। এবার সময় মতো বৃষ্টি হয়েছিল, জোয়ারের পানিতে ছিল পলিমাটি। তাই ধান ফলেছে বেশ। গেরহস্থের মুখে ভেজায় হাসি। গত বছর বন্যার পানিতে মার গেছে ধান। এবার যা ফলন হয়েছে, গতবারের ক্ষতি পুষিয়ে যাবে নিশ্চয়।
গতর খাটা মৌসুমী শ্রমিকের দল প্রতি বছরের ন্যায় এবারও এসেছে। রোজ তিনবেলা পেটভরে ভাত খেতে পায়। ধান কাটার মুজুরি নগদ মেলে। রুজি কম হয় না। চোখকান গুঁজে খাটতে পারলে মাস তিনিকের খোরাকি হয়ে যায়। তাই প্রতি মৌসুমে তারা চরে ধান কাটতে আসে। গেরহস্থ বাড়ির কাছারি ঘরে অথবা খোলা মাঠে খড়-বিছালী দিয়ে অস্থায়ী ডেরা বেঁধে থাকে তারা। ধান কাটা পুরো মৌসুম থাকে। বিছালী বিছিয়ে শোয়। পাতলা কাঁথায় শীত মানে না। শেষ রাতের দিকে কুয়াশা আর হিমেল বাতাসে হাত-পা জমে যায়। অভ্যাস মতো মানুষগুলো সকাল হবার আগেই জেগে উঠে। শকনো খড় দিয়ে আগুন জ্বেলে হাত-পা সেঁকে। শীতার্ত মানুষগুলো গোল হয়ে বসে আগুন তাপায়। আগুনের হলকায় তাদের মুখগুলো কয়লার মতো লাল দেখায়। তামাক খায় তারা। ততক্ষণে বড় পাতিলে ভাত রান্না হয়। রমিজ পেঁয়াজ কুটে। রমিজের পেঁয়াজের প্রসংসা করে দলের সবাই। তারপর পোড়া মরিচ আর সরিষা তেলে মাখানো গোল্লা গোল্লা করে তৈরি হয় আলু ভর্তা। ধোঁয়া ওঠা ভাতে লবণ ছিটিয়ে খেতে খুব মজা লাগে। মাটির সানকীভরা নুন ভাত বড়ই তৃপ্তি করে খায় তারা। নুন ভাতের নোনতা স্বাদে পেটের ক্ষুধা ছাপা পড়ে। পেট ভরে ভাত খেতে পারাটাই তাদের কাছে পরম সুখ। তারপর কাস্তেগুলো টেনে নেয়। মাঠজোড়া ধান কাটার ঘসঘস আওয়াজ ওঠে একটানা। কিছুক্ষণ ধান কাটলেই শরীরের হি হি ভাবটা আর থাকেনা। কুয়াশার ঘোলাটে ভাব কাটতে থাকে। ধীরে ধীরে সূর্য ওঠে। শরীরে গরম অনুভূতি হয়। কপালে চিকন ঘাম দেখা দেয়। সূর্য আরো উপরে উঠলে দূরে বাড়িঘরগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠে।
পান-বিড়ি আর হাতে একজগ পানি নিয়ে আসে গেরহস্থ বাড়ির গোমস্তা কাশেম। এসেই তাড়া দেয়- ‘হাত চালাও মিয়ারা। এই জমির ধান কাটা শেষ করতে অইবো দুপ্রের আগে। আরো তিনখান জমিন আছে।’
কাশেমের কথা শুনে মন্ত াজের গা জ্বালা করে। গেরহস্থ বাড়িতে বছর ঠিকা কাম করে সে। কথা বলে, যেন সে-ই গেরহস্থ!
কাটা ধানের মুঠিটা আলার উপর রেখে মন্ত াজ বলে,-
তুই যেমুন কামলা, আমরাও তেমন কামলা। তোর এতো খবরদারি কিসের রে‌্য ?
কি কইলা মিয়া? কাশেমেরে কণ্ঠে ঝাঁঝ। চোখে আগুনের ফুলকির মত রাগ। লতিফ মাথা ঝুঁকে ধান কাটছিল, সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মন্ত াজের কাথায় সায় দেয়- ‘হ ঠিকইতো কইছে মন্তাজ ভাই। তুই বছর ঠিকা কামলা, আমরা মৌসুমী কামলা। দু’জনের মইদ্দে তফাৎ কি?’
কাশেম প্রথমে ছেতে গেলেও কথাটা তার মনে দাগ কাটে।
দুপরের রোদটা তাপ ছড়ায়। ধান কাটার ঘসঘস শব্দে গোমস্তা কাশেমের মনে কোথায় যেন কি ঘটে যায়। জন্মের আগে মা বিধবা। ভাত-কাপড়ের কষ্টে মা জমিলা খাতুন মুন্সীবাড়ির ছোট গিন্নীর ঘরে কাম নেয়। শীত-বর্ষা নেই, রোজ সকালে মুন্সীবাড়িতে যায়, ফিরে সন্ধ্যায়। ছোটগিন্নীর সংসারে সাবাই খাওয়ার পর বেঁচে যাওয়া ভাতগুলো নিয়ে জমিলা সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে। রাতের বেঁচে যাওয়া পান্তা ভাত জমিলা লবণ মেখে কাঁচা মরিচ দিয়ে খায়। বছরের পর বছর পার হয়ে যায় জমিলার লবণ ভাতের জীবন পাল্টায় না। পেটের ক্ষুধায় আধমরা হলে সে চায় ভাত। লিউলি ফুলের মতো সাদা একথালা ভাত আর একছিমটি লবণ। ক্ষুধার অন্ন তার লবণ ভাত।
ক্ষুধার কষ্টের মতো কষ্ট দুনিয়াতে নাই। তাবৎ মানুষ যেন ক্ষুধার কাছে পরাজিত। ক্ষুধার জন্যই তো জমিলার সারদিন গতর খাটা। একটু বড় হওয়ার পর কাশেমকেও লাগিয়ে দিয়েছে মুন্সেফ বাড়ির কামে। সে হয়ে গেছে কামলা। মুন্সেফ বাড়ির গোমস্তা। চারটা গরু সে সামলায়। দুটা হালের গরু। একট দুধের গাই। বাচুরটা অকারণে এদিক সেদিক দৌড়ায়। বাড়িতে ফুটপরমাশ খাটা ক্ষেতেখোলার কাম সারা বছর তাকে একাই করতে হয়। মৌসুমে দলে দলে ভিন গেরামের মানুষ আসে চরে। তখন চরের মাঠঘাটে গমগম করে। ধান কাটা, ধান মাড়াই, ধান সেদ্ধ, ধান শুকানো, খড়-বিছালীর এলোমেলা স্তূপ গেরামের চেহারাটাই অন্য রকম হয়ে যায়। বৌ-ঝিরা ব্যস্ত থাকে ধান সামলানোর কাজে। সারাদিন রোদ থাকে, এমন জায়গায় গোবর মাটি দিয়ে লেপে ধান শুকানোর খলা তৈরি করে। শীতের পিঠা, খেজুরের রস, পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধে শীতের সোনালী বিকেলগুলো ছবির মতো হয়ে ওঠে। ধান কাটতে আসা ভিন গেরামের কামলারা এলে গোমস্তা কাশেম আর গোমস্তা থাকে না, গেরহস্থ থেকেও এককাঠি ক্ষমতাবান হয়ে উঠে। জমিনের আইলে দাঁড়িয়ে সে কেবল তাড়া দেয়-
‘এই মিয়া, নাম কি তুমার, লগের মানুষ ক্যামন কইর‌্যা ধান কাটে দেহ না?
একদম উজায় না তুমার দিক।’
রমিজ, লতিফ, সাত্তার, ফজু, ছোলেমান গোমস্তা কাশেমের বাঁজখাই গলায় আওয়াজ শুনে ভীত হয়। হাত চালিয়ে তখন কাম করে সবাই। লোকগুলো তাকে বেশ সমীহ করে। নিজেকে তখন জমিদার জমিদার মনে হয় গোমস্তা কাশেমের। আয়েশ করে একট বিড়ি ধরায়। সাহেবদের মতো নাকে মুখে ধোঁয়া ছাড়ে। মেলে ধরা ছাতার ছায়ায় দাঁড়ায়। মাথার উপর দুপুরের ঝকঝকে রোদ। ধান কাটা লোকগুলোর রোদপোড়া কালো কালো মুখগুলো ঘর্মাক্ত। লবণাক্ত ঘামের স্রোত কোপালে বেয়ে পড়ছে। কিন্তু আজ লতিফের মুখে ‘কামলা’ শব্দটি শুনে গোমস্তা কাশেমের মন কেমন যেন হয়ে যায়। সে ভাবে, আমি তো আসলেই মানুষ না, কামলা। কামলারা কি মানুষ?
পেটের ক্ষুধা, কেবল উদর ভর্তি করে ভাত খাওয়া, জঠর জ্বালার কাছে বন্দি হয়ে আছে যে, সে তো মানুষ না, জন্তু!
গোমস্তা কাশেমের বুক ভেঙ্গে কান্না আসে। বর্ষায় দু’কূল উপচানো নদীর জলের মতো তার চোখ বেয়ে অশ্রæ ঝরতে থাকে। বুকের ভেরত চলে নিরব এক ভাঙচুর। তবুও চোখের জল সে লোকগুলোকে দেখাতে চায় না। একটু আগেই যাদের সঙ্গে জমিদারি ফলানোর ক্যারদানি দেখিয়েছে, রাগ দেখিয়েছে, কান্নাভেজা চোখ নিয়ে কেমন করে দাঁড়াবে সে লোকগুলোর সামনে এখন! একঝাঁক দুঃখ আর গ্লাণি তাকে যেন ঝপটে ধরেছে।
মুন্সেফবাড়ির মোস্তাগিরি তার ভালো লাগে না। নিজের ভিটের দিকে পা বাড়ায়। একচিলতে শ্যাওলাপড়া উঠোন। ঘরের চাল অর্ধেক ছনে ছাওয়া, বাকি অর্ধেক জংধরা টিন। কোণার খুঁটিটা ভেঙ্গেপড়ায় একদিকে হেলে আছে ঘর। তরজার বেড়াটা মচড়ে পড়েছে। উঠোনে পা দিয়ো মায়ের বুকে জমা কফকাশিটা শুনতে পায় কাশেম। বয়স বেড়েছে জমিলা খাতুনের। চোখে ঝাপসা দেখে। পায়ের আওয়াজ শুনেই জমিলা কাশতে কাশতে বলে- কে-এ-এ, খুক্কু খুক্কু, একটানা কাশির শব্দ। কুপি বাতির ম্লান আলোয় কাশেম দেখে তার মা কাঁথামুড়ি দিয়ে শুইয়ে আছে। পাটের আঁশের মতো তেলহীন মাথার চুলগুলো এলোমেলো। ভাঁজপড়া কপালে হাত রাখে গোমস্তা কাশেম। মনে হয়, এটা তার মায়ের কপাল নয়, নিজের হৃদপিন্ড।
কামারের হাফরের মতো শ্বাসটানা গলায় জমিলা খতুন বলে-
‘বাবা তুই এসেছিস? হাঁ।
ছোড়ক্যালে পেট পুইর‍্যে খাতি দিতে পারি‌ন্য নি বইল্যে।
তোঁর‍্যে মুনসফ বাইত্যে কামে দিল্যাম পেট পুইর‍্যে ছাট্টি খাতি পাইরব্যে।
জমিলা খাতুন দম ফেলে দম নিতে পারে না। গলায় শোঁ শোঁ আওয়াজ হয় কেবল। কুপি বাতিটা হাওয়ায় এপাশওপাশ করে।
ঃ মা, আমি গোমস্তার কাম ছাইড়া দিছি। গোমস্তাগিরি আর করবো না। কাইল থেইক্কা কামলা দেবো, কামলা। জমিলা খাতুনের চোখ দুটি স্থির। ঝাপসা দৃষ্টি দিয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কুপি বাতির আলোয় কাশেমের মুখটা যেন ক্ষণিকের জন্য গরম লোহার মতো লাল দেখায়।
ঃ কামলা দিয়্যা কি পেট পুইর‍্যে ভাত খাওন যায়, বাবা?
মায়ের প্রশ্নের জবাব তার অজানা। মাথা নিচু করে বসে থাকে কতক্ষণ। অন্ধকারে বাদুড় উড়ে। নিশি পাখি ডানা ঝাপটায়। নদীর পারে হল্লা করে শৃগাল ডেকে উঠে-হুক্কা হুয়া, হুক্কা হুয়া।
শীতের কুয়াশামাখা ভোর। গাছের পাতায় জমে থাকা শিশির টুপটাপ ঝরে পড়ছে। দিগন্ত ধোঁয়াশা, ঝাঁপসা। কনকনে শীত। গায়ে পুরানো একটা চাদর জড়িয়ে, মেয়েদের মতো ঘোমটা মাথায় গোমস্তা কাশেম গিয়ে দাঁড়ায় চৌধুরী বাড়ির দরজায়। চৌধুরীবাড়ির দহলিজে বাঁশ-বিছালি দিয়ে ছাপড়াঘর তুলে থাকে মৌসুমি কামলারা। রমিজের ভাত রাঁধা তখন শেষ। পেয়াজ, কাঁচা মরিচ দিয়ে সে সেদ্ধ আলু দিয়ে ভর্তা তৈরি করছে। গোমস্তা কাশেম প্লেটে ধোঁয়া উঠা সাদা ভাত দেখে। নুন ছিটিয়ে ফজু, লতিফ, ছোলেমান ভাতের নলা ধরে মুখে পুরে দেয়। তাদের ক্ষুধাতুর মুখের গ্রাস নুনভাত গোমস্তা কাশেমের জিহ্বায় নোনতা স্বাদ জাগায়। সে বলে-
‘ফজু ভাই আমিও তুমাদের লগে কামলা দিমু। আমারেও লও তুমাদের দলে।’
গোমস্তা কাশেমের কথা শুনে ছোলেমান বলে, তুমি তো মুন্সেফ বাড়ির গোমস্তা। মালিক পক্ষের লোক। তুমি কি আমাদের মতো কাম কইরতে পারবা?
‘হ, পারমু। আমরে পাইরতেই অইবো।
আমি এহন আর গোমস্তা নাই। গোমস্তাগিরি ছাইর‌্যা দিছি। আইজ থেইক্যা আমিও তুমাদের মতো কামলা। কামলাগোর তবু স্বাধীনতা আছে, গোমস্তাগিরিতে কোনো স্বাধীনতা নাই।’
রমিজ তখন ভাত খেয়ে ফেলেছে। নিজের প্লেটটা ধুইয়ে এক থালা ভাত আর আলুভর্তার গোল দলাটা মাঝখানে বসিয়ে বাড়িয়ে দেয় কাশেমের দিকে। সাদা সাদা ধোঁয়া ওঠা ভাত নুন ছিটিয়ে খেতে থাকে কাশেম। বড়ই তৃপ্তি লবণ ভাতে। পূর্ব দিগন্তে তখন সূর্যের লাল মুখ উঁকি দিচ্ছে।