নীহাররঞ্জন রায়

3

 

ভারতের শেষ বহুশাস্ত্রজ্ঞদের মধ্যে অন্যতম একজন। জ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যেমন- শিল্পকলা, প্রাচীন ও আধুনিক সাহিত্য, ইতিহাস, ধর্ম, রাজনীতি এবং জীবনকাহিনীসহ নানা বিষয়ে তিনি বিচরণ করেন এবং বহু গ্রন্থ রচনা করেন। কর্মজীবনে তিনি বিবিধ পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নীহাররঞ্জন রায় ১৯০৩ সালে ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন স্থানীয় ন্যাশনাল স্কুলে, যেখানে তাঁর পিতা শিক্ষকতা করতেন। সিলেটের মুরারীচাঁদ কলেজ থেকে ইতিহাসে অনার্সসহ স্নাতক (১৯২৪) এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে ১৯২৬ সালে এম.এ পাস করেন। ঐ বছরই তিনি তাঁর Political History of Northern India, AD 600-900 ’ নিবন্ধের জন্য ‘মৃণালিনী স্বর্ণপদক’ পান। ১৯২৭ থেকে ১৯৩৩ সালে কিছুকাল তিনি তাঁর শিক্ষক অধ্যাপক বেণীমাধব বড়ুয়ার সঙ্গে বার্মায় কাটান এবং একত্রে বার্মিজ মন্দির স্থাপত্যের উপর ব্যাপক গবেষণা চালান। এ গবেষণার ফলে কারুশিল্পের প্রতি তাঁর আকর্ষণ গভীর হয় এবং তিনি উপলব্ধি করেন যে সমাজ, রাষ্ট্র ও সংস্কৃতির বৃহত্তর পরিমন্ডল থেকে বিচ্ছিন্নভাবে শিল্পকলা সম্পর্কে অধ্যয়ন করা যায় না। বার্মাতেই তাঁর মনে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অবিচ্ছিন্নতার ধারণা দৃঢ়বদ্ধ হয়, যা পূর্ণ পরিণতি লাভ করে ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত তাঁর বাঙ্গালীর ইতিহাস গ্রন্থে।
স্কুলে অধ্যয়নকালে নীহাররঞ্জন অনুশীলন ও যুগান্তরের মতো প্রসিদ্ধ বিপ্লবী দলের সমাজসেবামূলক কার্যক্রমে নিজেকে যুক্ত করেন। ১৯২৬ সাল পর্যন্ত অনুশীলন দলের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখেছিলেন। কলেজ জীবনে তিনি ছাত্র-স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন এবং গ্রাম পর্যায়ে কংগ্রেসের কাজে জড়িত থাকেন। ত্রিশের দশকের গোড়ার দিকে নীহাররঞ্জন কংগ্রেসের সত্যাগ্রহ আন্দোলনে এবং ১৯৪২-৪৩ সালের ভারত ছাড় আন্দোলনে পুনরায় যোগ দেন। ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনকালে ১৯৪২ সালে তিনি কারাবন্দি হন এবং জেলখানায়ই বাঙ্গালীর ইতিহাস রচনার কাজ শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পর নীহাররঞ্জন রায় সক্রিয় রাজনীতিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন, যদিও আট বছর রাজ্যসভার সদস্যপদে আসীন থেকেছেন। রাজনীতিতে অংশগ্রহণ তাঁকে স্বদেশ সম্পর্কে অন্তর্দৃষ্টি দিয়েছিল, জনঘনিষ্ঠ করেছিল। রাজনীতি তাঁকে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নিয়ে যায় এবং তৃণমূল পর্যায় থেকে সকল স্তরের মানুষের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগের এবং দেশের ব্যাপক পরিচয় লাভের সুযোগ ঘটিয়ে দেয়। নীহাররঞ্জনের পান্ডিত্য বহুক্ষেত্রে বিচরণশীল। ইংরেজিতে লেখা সত্তরটির বেশি ও বাংলায় লেখা ছত্রিশটি প্রবন্ধ, নিবন্ধ, ভাষণ এবং ইংরেজিতে পনেরটি ও বাংলায় সাতটি গ্রন্থের বিষয়বস্ত্ত ছিল ইতিহাস, চারুকলা, স্থাপত্য, নৃবিদ্যা, লিপিতত্ত্ব, ধর্ম, সাহিত্য, সমসাময়িক রাজনীতি এবং গান্ধী, নেহরু ও সুভাষচন্দ্র বসুর মতো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যকর্ম। কিন্তু তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা বাঙ্গালীর ইতিহাস প্রাচীনকাল থেকে মুসলিম শাসনের পূর্ব পর্যন্ত সময়ের বাঙালির ইতিহাসের একটি সুবিশাল গ্রন্থ। এটি প্রকৃত অর্থেই বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস বোঝার জন্য একাধারে পথনির্দেশক ও ভিত্তিস্তম্ভ। ১৯৮১ সালে মৃত্যুর কিছুকাল আগে তিনি বাঙ্গালীর ইতিহাস গ্রন্থের দ্বিতীয় খন্ড লেখার ইচ্ছা পোষণ করেন এবং তিনি মনে করেন যে, এটাই হবে তাঁর ‘সামান্য’ বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের ‘সর্বাধিক আনন্দময় পরিণতি’। কিন্তু তা আর পূর্ণ হয়নি। সূত্র: বাংলাপিডিয়া