নীল বালক

59

একদিন অদ্ভুত একটি ঘটনা ঘটে গেল তুর্যের ঘরে। সে দেখল টিনের চালের গোলাকার ছিদ্র দিয়ে নীল আলো নেমে এসে পড়েছে ঘরের মেঝেতে। তার মনে হলো, আলোর ভেতরে অসংখ্য ছোট ছোট প্রাণি ওড়াউড়ি করছে। সে কৌতূহলী হয়ে একটি আঙুল ঢুকিয়ে দিল আলোর ভেতরে। আঙুলটি নীল রঙ্গে রঙ্গীন হয়ে গেল। ভারি মজা পেল তুর্য।
তারপর সে ভাবল, আচ্ছা আমি নিজেই রঙ্গীন হচ্ছি না কেন? এই বলেই সে আলোকরশ্মির মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালো এবং দেখতে দেখতে তার পায়ের তলা থেকে মাথার চুল পর্যন্ত ঘন নীল হয়ে গেল। মনে হচ্ছে তার শরীরে নীল আলোরা খেলা করছে। তার আনন্দ আর ধরে না।
তুমি কেমন আছ তুর্য? ঘরের উপর থেকে কে যেন প্রশ্ন করল।
কে কথা বলে? কে! মাথা ঘুরিয়ে বলে উঠল তুর্য।
আমি ম্যাল্টন ভোঁ।
ভোঁ? সেটা আবার কী? আমি তো জীবনেও এমন নাম শুনিনি।
না শোনারই কথা। কারণ তোমার সাথে আমার কখনো দেখা হয় নাই।
তুমি কোত্থেকে এসেছ ভোঁ? উপরের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল তুর্য।
আমি এসেছি অনেক দূরের এক গ্রহ থেকে। আমি ও আমার বন্ধুরা কিছুদিন যাবৎ আসা যাওয়া করছি তোমাদের এই গ্রহে। তোমাদের আকাশটা অনেক সুন্দর। তোমাদের গ্রহের নাম পৃথিবী আর আমাদের গ্রহের নাম পিকুলাই ডিডি।
পিকুলাই ডিডি। এটা কোথায়? আমাদের শহরে নাকি?
কোকল কোকল শব্দ করে হেসে উঠল ভোঁ। বলল, সেটা এই পৃথিবী থেকে এত্ত দূরে যে সেটা তুমি ভাবতেই পারবে না এখন। আমি তিন আলোকবর্ষ দূর থেকে এখানে এসেছি। তুমি বড় হলে জানতে পারবে আমাদের গ্রহটি তোমার এখান থেকে কত দূরে। আমি এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। দেখলাম, তুমি খুব একা। কিছুতেই মন বসছে না তোমার। আমি আমার চোখ থেকে এক ফালি আলোর রশ্মি ফেললাম তোমার ঘরে। দেখতে চাইলাম এই আলোর রশ্মি দিয়ে তুমি কী কর। বাহ্ তুমি কৌতূহলী হয়ে খেলায় মেতে উঠেছ দেখছি।
আমাদের পিকুলাই ডিডি গ্রহের শিশুরা অনেকটা যন্ত্রের মতো। ওরা এতটাই কৌতূহলী যে নতুন কিছু পেলেই চটপট বসে পড়ে গবেষণার কাজে। এর আদ্যোপান্ত না জানা পর্যন্ত ওরা খাবারের কথা পর্যন্ত ভুলে যায়।
তাই নাকি! আচ্ছা এই রঙ্গীন আলো যদি চলে যায়, তখন? জানতে চাইল তুর্য।
না যাবে না। আমি তোমাকে একটি জিনিস দিয়ে যাচ্ছি। এ নিয়ে কল্পনার ডানায় চড়ে অদ্ভুত আনন্দে মেতে থাকবে তুমি।
সেটা কী?
একটি পেনসিল। পেনসিল দিয়ে তুমি অদ্ভুত সব কান্ড করে ফেলতে পারবে। ভাল থেকো তুর্য, আমি গেলাম। একথা বলেই ভোঁ উধাও হয়ে গেল। আর আলোটি মেঝেতে পড়ে গড়াগড়ি খেতে খেতে একটি পেনসিল হয়ে গেল। নীল আলোর ঝলমলে রঙ্গীন পেনসিল। যা সুন্দর!

দুই.
তুর্যের মন চঞ্চল হয়ে উঠল।
সে ঝটপট একটা খাতা নিয়ে বসে পড়ল খাটের ওপর। কী আঁকবে প্রথম! ভাবতে ভাবতে সে একটা ফুল আঁকল। কালো কালির দাগ দেখে সে বলল ওহুঁ এখানে যদি লাল রং হতো! আরেকটা আঁক দিতেই লাল রঙ বেরিয়ে এলো। আশ্চর্য তো! তারপর সে আঁকল একটা প্রজাপতি। পাখাগুলো যদি লাল নীল আর সবুজ হতো বলতেই তার মনের মতো রঙ বেরিয়ে আসতে লাগল পেনসিল থেকে। তুর্য আনন্দে লাফিয়ে উঠে বলল পেয়ে গেছি আমার মনের মতো পেনসিল পেয়ে গেছি।
একি! প্রজাপতিটা আঁকা শেষ করতেই নড়ে উঠল যে। তারপর পাখা মেলে ঘর জুড়ে ওড়াউড়ি করতে লাগল। তুর্য পেনসিল সামলাবে নাকি প্রজাপতির পেছনে ছোটাছুটি করবে এখন?
তারপর সে আঁকল একটা বিড়ালছানা। ছানাটির লেজে পেনসিলের শেষ টান দিতেই মিয়াঁও করে এক লাফে চলে গেল খাটের তলে। সে চুপি দিয়ে বলল, তুমি আমার মতোই একা নাহ্? রাখ, তোমার জন্য দারুন সঙ্গী বানিয়ে দিচ্ছি। সে এঁকে ফেলল একটি নেংটি ইঁদুর। ইঁদুরটি নড়ে উঠতেই বিড়ালছানাটি কান খাড়া করে ওৎ পেতে বসে পড়ল। ইঁদুরটি দিল ভোঁ দৌড়। তার পিছু নিল ছানাটি। টম এ্যান্ড জেরির মতো কান্ড ঘটতে লাগল ঘরে।
তুর্য ওদের দুষ্টুমি ভালই উপভোগ করতে লাগল। কিন্তু মাঝে মধ্যে বড্ড বাড়াবাড়ি রকম দুষ্টুমি করছে ওরা। সে ভাবল ওদেরকে শাসন করতে হবে। অনেক ভেবেচিন্তে একটি পুতুল আঁকল সে। দুর্দান্ত এক পুতুল। একি, পুতুলটি লাঠি নিয়ে ইঁদুর আর বিড়ালের পেছনে ছুটছে যে! ওদের ছোটাছুটি আর ধাপাধাপিতে ঘরের জিনিসপাতি সব এলোমেলো হয়ে গেছে। হাঁড়ি-পাতিল, বাসন কোশন, গ্লাস প্লেইট বই খাতা কোনোটাই ঠিক জায়গায় নেই। মাঝে
মধ্যে তুর্যের পিঠের উপর দিয়ে ছোটে ওরা। সে পিঠ বাঁকা করে বিড়বিড় করে বলে, না, আমি আর পুতুল আঁকব না। তুর্য এখন অন্য কিছুু আঁকার কথা ভাবছে।