নীতিহীন রাজনীতি ও রাজনীতিক

84

 

একসময় সমাজ ছিল সাম্যবাদী। সবাই দলবেঁধে খাদ্য জোগাড় করত, সবাই মিলে খেতো। একক চিন্তা বা ব্যক্তিগত লাভালাভের হিসাব তখন ছিল না।
যেদিন থেকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির উদ্ভব সেদিন থেকে জবরদখল, সেদিন থেকেই রাজনীতির শুরু। অতএব রাজনীতি মানেই অপরের রাজ্য-সম্পদ আর ক্ষমতা দখলের চর্চা। অ্যারিস্টটল, কার্লমার্ক্স এঁরা রাজনীতিকে সভ্য-শোভন ও গণমানুষমুখী করে তোলার চিন্তা-ভাবনা করেছিরেন। রাজনীতি যে গণমানুষের মুক্তির কথা বলে, অধিকারের কথা বলে, সাম্যের কথা বলে তা শিখিয়েছিলেন কার্ল মার্ক্স।
গত শতকের ৮০ দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে বিপর্যয় নেমে আসে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে। রাজনীতি থেকে সুস্থতা, সভ্যতা ও মানবতাবোধ বিদায় নিয়েছে তখন থেকে। সমাজ-রাষ্ট্র-রাজনীতিকে প্রতিনিয়ত অমানবিক করে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে পুঁজিবাদী বিশ্বের নয়া কৌশল। এজন্যে বিশ্বের দেশে দেশে ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টিতেও ব্যাপত তারা। ক্ষমতার এককেন্দ্রিকতায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ বিশ্ব মোড়ল। যে দেশটি প্রকৃত অর্থে কোনোদিন বিশ্বের কোনো সাধারণ মানুষ অর্থাৎ নির্যাতিত নিপীড়িত-বঞ্চিত জনগণের পাশে দাঁড়ায়নি। নিঃস্বার্থভাবে একটি দানা-পানি দিয়েও সাহায্য করেনি কোনো দেশ বা জাতিকে।
সামন্তবাদী সমাজের রাজনীতিও ছিল হত্যা-ষড়যন্ত্র-ক্ষমতাদখলের কূটচালে আবদ্ধ। ফলে রাজনীতিতে শুভবোধের চর্চা করতে হয়েছে, এখনো করতে হচ্ছে বিপুল প্রতিকুল পরিবেশের মধ্য দিয়ে। ভারতীয় উপমহাদেশে বিশেষ করে আমাদের এ অঞ্চলেও রাজনীতিক বেচাকেনা অর্থাৎ প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের ইতিহাসও নতুন নয়। রাজনীতিকরা বেচা-বিক্রি হয়েছেন অনেক আগে থেকেই। বেশি পেছনে না গিয়ে ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধের কথা স্মরণ করি। যে যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার কথাই ধরি। সেদিন মীরজাফর বিক্রি হয়েছিলেন বলেই বাংলার পতন হয়েছিল। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের সূত্রপাত হয়েছিল। সেদিনের যুদ্ধে মীরজাফর ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা বিশ্বাসঘাতকতা না করলে উপমহাদেশের ইতিহাস অন্যভাবে লিখতে হতো হয়ত। অন্তত ব্রিটিশদের কাছে পরাজিত হওয়ার গ্লানি আমাদের বহন করতে হতো না। পরে ভারতজুড়ে এমন হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মীর জাফরের কারণে ব্রিটিশরা ১৯০ বছর ভারত শাসন করে যেতে পেরেছিল। পলাশী থেকে চট্টগ্রামের মাস্টারদা সূর্য সেনকে ধরিয়ে দেওয়ার ঘটনা এমন বিশ্বাসঘাতকতার ধারাবাহিকতা মাত্র।
তখন ব্রিটিশ শাসনের শেষ দিকে। রাজনীতি তখনও জমিদার জোতদার নবাব শ্রেণীর দখলে। অভিজাতরাই তখন মুসলিম লীগ করতেন। অবিভক্ত বাংলায় তখন একটু একটু পরিবর্তনের হাওয়া লাগতে শুরু করেছে। শেখ মুজিবুর রহমানের মতো কিছু তরুণ রাজনীতিকে গণমানুষের করে গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। ভারতবর্ষ স্বাধীন হতে যাচ্ছে সে সময়ও রাজনীতিকরা কীভাবে বেচা-কেনা হতেন তার একটি চমৎকার বর্ণনা আছে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে। তা থেকে সামান্য উদ্ধৃতি দিচ্ছি। যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষকে কেন্দ্র করে তখন বাংলায় মুসলিম লীগ সরকারের পতন হয়েছে। অর্থাৎ পতন ঘটানো হয়েছে। ওই সময়ের কথা বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘এর পূর্বে আমার ধারণা ছিল না যে, এমএলএরা (নিম্ন সভার সদস্য) এইভাবে টাকা নিতে পারে। এরাই দেশের ও জনগণের প্রতিনিধি। আমার মনে আছে, আমাদের উপর ভার পড়ল কয়েকজন এমএলএকে তাদের নাম বলতে চাই না, কারণ অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন। একজন এমএলএকে মুসলিম লীগ অফিসে আটকানো হলো। তিনি বারবার চেষ্টা করেন বাইরে যেতে। কিন্তু আমাদের জন্য পারছেন না। কিছু সময় পরে বললেন, “আমাকে বাইরে যেতে দিন, কোনো ভয় নেই, বিরোধীদল টাকা দিয়েছে। আমি যদি কিছু টাকা আনতে যাই আপনাদের ক্ষতি কি? ভোট আমি মুসলিম লীগ পক্ষেই দেব।” আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইলাম তাঁর দিকে। বৃদ্ধ লোক, সুন্দর চেহারা, লেখাপড়া কিছু জানেন, কেমন করে এই কথা বলতে পারলেন আমাদের কাছে? টাকা নেবেন একদল থেকে অন্য দলের সভ্য হয়ে, আবার টাকা এনে ভোটও দেবেন না। কতটা অধঃপতন হতে পারে আমাদের সমাজের। এই ভদ্রলোককে একবার রাস্তা থেকে ধরে আনা হয়েছিল। শুধু সুযোগ খুঁজছিলেন কেমন করে অন্য দলের কাছে যাবেন।’
এ রকম আরেক এমএলএকে আনতে বঙ্গবন্ধুকে রংপুর পাঠানো হল। যুদ্ধাবস্থায় প্রায় উপোস থেকে তিনি ওই জমিদার কাম এমএলএর বাড়ি পৌঁছানোর পরে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন না কিছু খাব কিনা। পথে খেয়েছি কিনা। বলতেন, ‘এখনতো রাত তিনটা বাজে। বিছানার কি দরকার হবে?’ বললাম, দরকার নেই যে সময়টা আছে বসিয়েই কাটিয়ে দেব। ঘুমালে আর উঠতে পারব না। খুবই ক্লান্ত। একদিকে পেট টনটন করছে, অন্যদিকে অচেনা রংপুরের মশা। একদিন পরে তিনি এসেছিলেন (কলকাতায়) তাঁকে পাহারা দেওয়ার জন্য লোক রাখা হয়েছিল। তবু পেছনের দরজা দিয়ে এক ফাঁকে তিনি পালিয়ে গিয়েছিলেন। খোঁজাখুঁজি করেও তাঁকে পাওয়া যায় নি। আমরা ছাত্র ছিলাম, দেশকে ভালোবাসতাম, দেশের জন্য কাজ করতাম। এই সকল জঘন্য নীচতা এই প্রথম দেখলাম। পরে যদিও অনেক দেখেছি। এই সমস্ত খান বাহাদুরদের দ্বারা পাকিস্তান আসবে, দেশ স্বাধীন হবে ইংরেজদের তাড়ানো যাবে। বিশ্বাস করতে কেন যেন কষ্ট হয়।
এই তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকেই বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের মার্চের প্রথম সপ্তাহে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের (এম.এনএ, এম এলএ) শপথ বাক্য পাঠ করিয়েছিলেন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। টাকার বিনিময়ে নিজদলের বিপক্ষে ভোট দিয়ে যেন ষড়যন্ত্র পাকাতে না পারেন সে লক্ষেই বঙ্গবন্ধু সংবিধানে ৭০ অনুচ্ছেদ সংযোজন করেন। এ আইনের কারণে বর্তমানে কোনো সংসদ সদস্য ফ্লোর ক্রস করতে পারে না, অর্থাৎ নিজদলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারবে না সংসদে।
স্বাধীন বাংলাদেশে নেতা বেচাকেনার সংস্কৃতি চালু হলো ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে জাতির পিতাকে হত্যার পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে। সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া তখন ইচ্ছা পোষণ করলেন রাজনীতি করবেন। দল গঠন করবেন। জড়ো করলেন শাহ আজিজদের মতো শীর্ষ রাজাকারদের। অন্যান্য দল থেকে সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার সাহায্য ভয় দেখিয়ে অর্থ দিয়ে অন্যদল থেকে নেতা ভাগিয়ে গঠন করলেন রাজনৈতিক দল। স্বাধীনতা বিরোধী, রাজাকার, চীনাপন্থি কমিউনিস্ট, মুসলিম লীগার ও নীতি ভ্রষ্ট রাজনীতিক নিয়ে গঠিত হলো বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। তৎকালে স্বাধীনতা ও আওয়ামীলীগ বিরোধী সবাই জড়ো হলেন জেনারেল জিয়ার পেছনে।
পরবর্তীতে জেনারেল এরশাদও তার গুরু জেনারেল জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। অন্যদল থেকে নেতা কিনে দল গঠন করেছেন। যুগে যুগে মীরজাফর থেকে কাজী জাফর, রায় বল্লভ থেকে মওদুদের মতো নেতার অভাব হয়নি রাতারাতি ভোল পাল্টাতে এবং অর্থ ও ক্ষমতার বিনিময়ে স্বৈরশাসকদের ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করতে।
সেই এরশাদের গৃহপালিত প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর মৃত্যুর বছরখানেক আগে এরশাদের প্রসঙ্গে বলেছিলেন, গত ১০০ বছরের মধ্যে এমন বিশ্বাসঘাতক নাকি তিনি দেখেননি। যে স্বৈরাচারের দাসত্ব করেছিলেন তিনি, সেবাদাসে পরিণত হয়ে তার শাসন শোষণকে দীর্ঘায়িত করেছিলেন তেমন তাঁবেদার কাজী জাফর ও মওদুদদের মুখে নীতিকথা, গণতন্ত্র ইত্যাদির কথা মানায় না। বরং স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিকে নতুন করে কলুষিত করার অপরাধে দু’ জেনারেলের সাথে এ ধরনের রাজনীতিকদেরও বিচার হওয়া উচিত। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই বলে যারা রাজনীতির সুবিধাবাদিতাকে জিইয়ে রেখে নিজেদের ক্ষমতা ও লাভের অংশীদার করে রাখতে চান বর্তমান রাজনীতিতে তো তাদেরই খেলা চলছে। রাজনীতিকদের জন্যে রাজনীতিকে সত্যি কঠিন করে গেছেন জেনারেল জিয়া। তাই দেশে আজ পরীক্ষিত, সৎ নিবেদিতপ্রাণ রাজনীতিক নেই বললেই চলে। রাজনীতির নিয়ন্তা আজ পেশিশক্তি, কালোটাকার মালিক। যারা নিজেদের বিক্রি করার জন্যে কোরবানি পশুর মতো সেজেগুজে থাকেন। দেশে অবাধ লুটপাট চালাতে যারা ডান-বাম-মধ্য এক হয়ে যান। আজ জনগণের জন্য রাজনীতি করা, জনগণের কল্যাণের জন্য ভাবা রাজনীতিক বিরল হয়ে পড়েছে। এমনকি জাতির পিতার দল আওয়ামী লীগেও। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে বিএনপি-জামায়াত থেকে আওয়ামী লীগ নেতাদের আলাদা করা দুষ্কর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। একদিন হয়ত দলকেও আলাদা করা যাবে না।

লেখক : সাংবাদিক