নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাবলয়

52

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ করা হবে আগামীকাল রবিবার। এ নির্বাচনকে ঘিরে চট্টগ্রামজুড়ে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা বলয় সৃষ্টি করা হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় মাঠে নেমেছে সেনাবাহিনী, বিজিবি, র‌্যাব ও পুলিশ। নগরী ও জেলায় টহল দিচ্ছে তাদের বহনকারী গাড়ি। প্রস্তুত রাখা হয়েছে পুলিশের সাঁজোয়া যান, এম্বুলেন্স ও ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি। নাশকতার আশংকায় মোড়ে মোড়ে চালানো হচ্ছে তল্লাশি। নগরীর প্রবেশমুখগুলোতে কড়া নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।
পুলিশ বলছে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় এমন কোন কাজ কাউকে করতে দেয়া হবে না। যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলায় পুলিশ প্রস্তুত। এদিকে জামায়াত অধ্যুষিত হিসেবে পরিচিত তিন আসনে বিশেষ নজরদারি করা হচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুরোর উপরও কড়া নজর রাখা হয়েছে।
রিটার্নিং কর্মকর্তা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা মোতাবেক গত রবিবার রাত ১২টা থেকেই মোতায়েন করা হয় সেনাবাহিনী। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে ৪০৭ উপজেলায় সশস্ত্রবাহিনী দায়িত্ব পালন করবে। এর মধ্যে ৩৮৯ উপজেলায় সেনাবাহিনী এবং ১৮ উপজেলায় নৌবাহিনী টহল দেবে। চট্টগ্রামেও মোতায়েন রয়েছে সেনাবাহিনী। সেনা সদস্যরা বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় টহল দিচ্ছে। বিজিবি, র‌্যাব সদস্যরাও টহল দিচ্ছে।
সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের ১৬টি আসনে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করবেন সেনা ও নৌবাহিনীর ১ হাজার ৪২৮ জন সদস্য। এর মধ্যে নগর ও জেলার ১৫টি আসনে ১ হাজার ৩২৭ জন সেনা সদস্য এবং চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ) আসনে ১০১ জন নৌ সদস্য নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করছেন। নির্বাচন পরবর্তী সময় পর্যন্ত স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে বিজিবি, র‌্যাব, কোস্টগার্ড এবং পুলিশকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সহায়তা দেবেন সেনা ও নৌবাহিনীর সদস্যরা।
জানা যায়, মেজর পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তার নেতৃত্বে প্রতিটি সংসদীয় আসনে ২ বা ৩ প্লাটুন সেনা সদস্য মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন। রিটার্নিং কর্মকর্তা, সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা কিংবা প্রিজাইডিং অফিসারের চাহিদা অনুযায়ী ভোটকেন্দ্রসহ সার্বিক নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন তারা। পুরো চট্টগ্রামে ৩০ সদস্যের ৪৪ প্লাটুন সেনাবাহিনীর নির্বাচনী দায়িত্ব সমন্বয় করছেন ৭ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ) আসনে একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নেতৃত্বে ২৫ সদস্যের ৪ প্লাটুন নৌবাহিনী নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে মাঠে রয়েছেন কোস্ট গার্ডের ১৩৪ জন সদস্য।
রিটার্নিং কর্মকর্তা অফিস সূত্রে জানা যায়, ১৬টি সংসদীয় আসনে ৩০ সদস্যের ৭১ প্লাটুন বিজিবি মাঠে কাজ করছে। নির্বাচন উপলক্ষে ১২টি উপজেলায় স্থাপন করা ১২টি অস্থায়ী ক্যাম্প থেকে জেলার ১০ আসন ও জেলা সংশ্লিষ্ট ৩ আসনের কার্যক্রম এবং হালিশহর বিজিবির রিজিওনাল সদর দফতর থেকে নগরের ৩ আসনে বিজিবির নির্বাচনী দায়িত্ব সমন্বয় করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে বিজিবি নির্বাচনী এলাকায় টহল দেয়া শুরু করেছে।
সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, বিজিবি ছাড়াও র‌্যাবের ৪৬টি পেট্রোল ও মোবাইল টিমসহ ৩৮১ জন সদস্য এবং পুলিশের ১৬টি স্ট্রাইকিং টিম, ১৬টি স্ট্যান্ডবাই টিম, ২০০টি মোবাইল টিমসহ ৩ হাজার ৩৩৩ জন সদস্য চট্টগ্রামে নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করছেন।
রিটার্নিং কর্মকর্তা ও বিভাগীয় কমিশনার মো. আবদুল মান্নান জানান, নির্বাচনে যাতে সকল ভোটার নির্বিঘ্নে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারেন, সেজন্য সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। নিরাপত্তায় কোন ধরনের ফাঁক-ফোঁকর নাই। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পর্যাপ্ত সংখ্যক সদস্য মাঠে রয়েছে। স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে সেনা-বিজিবিও রয়েছে। নির্বাচন ঘিরে কেউ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারবে না।
র‌্যাব সূত্রে জানা যায়, নির্বাচনকে ঘিরে করে বিশৃঙ্খলা মোকাবেলায় চট্টগ্রামজুড়ে টহল জোরদার করেছে র‌্যাব। প্রতি আসনে একজন অফিসারের নেতৃত্বে র‌্যাবের দুইটি করে টহল টিম কাজ করছে। নগরী ও জেলার বিভিন্ন উপজেলায় টহল ও তল্লাশী জোরদার করেছে র‌্যাব। গুরুত্বপূর্ণ উপজেলায় একজন অফিসারের নেতৃত্বে র‌্যাবের চারটি করে টহল টিম কাজ করছে।
র‌্যাব-৭ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, নির্বাচনকে ঘিরে নিরাপত্তা রক্ষায় মাঠে কাজ করছে র‌্যাব। নগরী ও জেলায় র‌্যাব সদস্যরা টহল দিচ্ছে। তিনি বলেন, নতুন করে সাতটি অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে।
জানা যায়, নাশকতার আশঙ্কায় সতর্ক অবস্থানে রয়েছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। দিন রাত পাহারা দিচ্ছে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। নগরী ও জেলার বিভিন্ন এলাকায় টহল দিচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। নগরীতে চেকপোস্ট বসিয়ে যানবাহন তল্লাশি চালানো হচ্ছে। সন্দেহভাজন লোকজনকেও তল্লাশির আওতায় আনা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, জামায়াত-শিবির অধ্যুষিত হিসেবে পরিচিত তিনটি আসনে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আসনগুলো হচ্ছে, সাতকানিয়া-লোহাগাড়া, বাঁশখালী ও সীতাকুন্ড। তবে সহিংসতা মোকাবিলায় সকল প্রকার প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা।
তিনি পূর্বদেশকে বলেন, কাউকে কোন ধরনের বিশৃঙ্খলা করতে দেয়া হবে না। সরাসরি ব্যবস্থা নেয়া হবে। একই সাথে নগরীতেও জামায়াত-শিবির অধ্যুষিত এলাকাগুলোর উপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
জানা যায়, ২০১৪ সালে সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া, বাঁশখালী এবং সীতাকুন্ড উপজেলায় ব্যাপক নাশকতা হয়েছিল, গাছ কেটে সড়কে রেখে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, গাড়িতে আগুন দেওয়া, বোমা মারা হয়েছিল। পুলিশের ধারণা, এবারও এ ধরনের স্যাবোটাজ হতে পারে। কারণ সাতকানিয়া-লোহাগাড়া ও বাঁশখালীতে জামায়াতের প্রার্থী আছে। তারা দেশের বিভিন্নস্থান থেকে তাদের ক্যাডারদের সেখানে এনে জড়ো করতে পারে।
পুলিশ এ তিনটি আসনে বাড়তি নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে। মোতায়েন থাকছে অতিরিক্ত পুলিশ। সেনা-বিজিবি ও র‌্যাবের টহল জোরদার করা হয়েছে।
জেলা পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা বলেন, নিরাপত্তার কোন ঘাটতি নেই। জানমালের নিরাপত্তায় সকল ব্যবস্থ্ইা নেয়া হয়েছে। ৩টি সাঁজোয়া যান প্রস্তুত রয়েছে। অতিরিক্ত ফোর্স থাকবে। ভোট কেন্দ্রে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে।
নির্বাচন কমিশন, সিএমপি ও জেলা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ভোট কেন্দ্রের পাহারায় মেট্রোপলিটন এলাকার সাধারণ কেন্দ্রে পুলিশ, আনসার, গ্রাম পুলিশের মোট ১৬ জন সদস্য নিযুক্ত থাকবেন। এর মধ্যে অস্ত্রসহ পুলিশ ৩ থেকে ৫ জন, অঙ্গীভূত আনসার ১১ জন ও গ্রাম পুলিশের একজন সদস্য নিযুক্ত থাকবেন। এসব এলাকার গুরুত্বপূর্ণ বা ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে মোট ১৭ জন ও অস্ত্রসহ ৪-৬ সদস্য নিযুক্ত থাকবেন। এর মধ্যে অস্ত্রসহ পুলিশ থাকবে ন্যূনতম চারজন।
মেট্রোপলিটন এলাকার বাইরে পুলিশ, আনসার, গ্রাম পুলিশের মোট ১৪ জন সদস্য নিযুক্ত থাকবেন। এর মধ্যে অস্ত্রসহ পুলিশ একজন, অঙ্গীভূত আনসার ১২ জন ও গ্রাম পুলিশের দু-একজন সদস্য নিযুক্ত থাকবেন। এসব এলাকার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে মোট ১৫ জন ও অস্ত্রসহ তিন-চারজন সদস্য নিযুক্ত থাকবেন। এর মধ্যে অস্ত্রসহ পুলিশ সদস্য থাকবেন ন্যূনতম দুজন।
ভোটকেন্দ্রের বাইরে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে থাকবেন সেনা ও নৌবাহিনীর সদস্যরা। র‌্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ড ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের সদস্যরা মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে টহল দেবেন।
রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক মো. ইলিয়াস হোসেন জানান, ভোটকেন্দ্র ঘিরে আমাদের পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকবে। সেখানে প্রথম পর্যায়ে আনসার, এরপর পুলিশ, এরপর র‌্যাব, এরপর বিজিবি থাকবে। সর্বশেষ সেনাবাহিনী কাজ করবে।
তিনি বলেন, ‘এরপরও কিছু কেন্দ্রে বাড়তি ফোর্স থাকবে। গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে একজনের পরিবর্তে দুজন পুলিশ থাকবে। ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে কোনো সমস্যা হবে না। নাশকতার আশঙ্কায় থানা, রেলওয়ে, টিভি স্টেশন, বিমান বন্দর, চট্টগ্রাম বন্দর, পানি শোধনাগারসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার উপর নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।