নির্ভীক সাহিত্যিক আহমদ ছফা

13

 

লেখায় যাকে অসাধারণ করে তোলে, ফুটে তোলেন বাংলাদেশি জাতিসত্তার পরিচয়। তিনি আর কেউ নন, আমাদের প্রিয় সাহিত্যিক আহমদ ছফা। তিনি ছিলেন একজন সফল বুদ্ধিজীবী, লেখক, ঔপন্যাসিক, কবি ও চিন্তাবিদ ছিলেন। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ও সলিমুল্লাহ খানসহ আরো অনেকের মতে, আহমদ ছফা হলেন মীর মোশাররফ হোসেন ও কাজী নজরুল ইসলামের পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি মুসলমান লেখক। আহমদ ছফা তাঁর বিখ্যাত ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ (১৯৭৬) প্রবন্ধে বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয় হাজার বছরের বিবর্তন বিশ্লেষণপূর্বক তাদের পশ্চাদগামিতার কারণ অনুসন্ধান করেছেন। তিনি একাধারে প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছোটগল্প, কবিতা লিখে গেছেন স্বপ্রতিভায়। বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (১৯৭২), বাঙালি মুসলমানের মন (১৯৮১), ওঙ্কার (১৯৭৫), একজন আলী কেনানের উত্থান-পতন (১৯৮৮), অলাতচক্র (১৯৯৩), গাভী বিত্তান্ত (১৯৯৫), অর্ধেক নারী অর্ধেক ঈশ্বরী (১৯৯৬), পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ (১৯৯৬), যদ্যপি আমার গুরু(১৯৯৮), ফাউস্ট (১৯৮৬) ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাবলী। আহমদ ছফার বাঙালি মুসলমানের মন (১৯৮১) প্রবন্ধ সংকলনটিকে বাংলা ভাষায় রচিত গত শতাব্দীর ‘সেরা দশ চিন্তার ঊনয়ের’ একটি বলে মনে করেন আনিসুজ্জামান ও সলিমুল্লাহ খানসহ আরো অনেকে আহমদ। আহমদ ছফা তাঁর প্রথাবিরোধিতা, স্পষ্টবাদিতা, স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গীর জন্য লেখক ও বুদ্ধিজীবী মহলে বিশেষ আলোচিত ছিলেন। জীবদ্দশায় তাঁকে বিদ্রোহী, বোহেমিয়ান, উদ্ধত, প্রচলিত ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাহীন ও বিতর্কপ্রবণ বলে অভিহিত করেছেন অনেকে।
১৯৭৫ সালে লেখক শিবির পুরস্কার ও ১৯৯৩ সালে বাংলা একাডেমীর সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন আহমদ ছফা। তিনি কখনো পুরস্কার বা পদক প্রত্যাশা না করলেও, তাঁকে ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তাঁকে সাহিত্যে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করা হয়। এছাড়াও তাঁকে বিভিন্ন পদক ও পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা উত্তর রচিত বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস (১৯৭২) প্রবন্ধগ্রন্থে আহমদ ছফা বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের মানচিত্র অঙ্কন করেন এবং আগাম বর্ণনা করেছেন বাংলাদেশি বুদ্ধিজীবীদের সুবিধাবাদিতার স্বরূপ উন্মোচন করেন তথা বুদ্ধিজীবীদের সত্যিকার দায়িত্বের স্বরূপ ও দিকনির্দেশনা বর্ণনাপূর্বক তাদের সতর্ক করে দিতে বুদ্ধিজীবীদের ব্যর্থতায় বাংলাদেশের কী দুর্দশা হতে পারে তা সম্পর্কে।
সাহিত্যিক আহমদ ছফা ও তাঁর রচনাকর্ম অনেক লেখক, শিল্পী, চলচ্চিত্রকর ও বুদ্ধিজীবীকে প্রাণিত করেছে; বরেন্য লেখক হুমায়ূন আহমদ, ফরহাদ মজহার, মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, তারেক মাসুদ, সলিমল্লাহ খান তাঁদের মধ্যে অন্যতম। আহমদ ছফার প্রতিটি উপন্যাস ভাষাগত অনুপম, বিষয়বস্তু ও রচনাশৈলীর অভিনবত্বে অনন্য। মানসিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থসামাজিক সূ²াতিসূ² অনুষঙ্গসহ আহমদ ছফার চরিত্র সৃষ্টির তথা কাহিনী কথনের পারঙ্গমতা অসামান্য। আবুল ফজল ও আরো অনেকের মতে ছফার ওঙ্কার (১৯৭৫) বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সর্বোত্তম সাহিত্যিক বহিঃপ্রকাশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক রাজনীতির প্রেক্ষিতে রচিত গাভী বৃত্তান্ত (১৯৯৫) বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ব্যঙ্গাত্মক উপন্যাসগুলোর একটি। পুষ্প বৃক্ষ ও বিহঙ্গ পুরাণ-এ (১৯৯৬) ছফা ঢাকা শহরের প্রেক্ষিতে ফুল, পাখি, বৃক্ষ তথা বৃহৎপ্রকৃতির সাথে মানুষের সম্পর্কের এক নিজস্বতা উপস্থাপন করেন। বর্তমানে ছফা স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী বলে বিবেচিত।
আহমদ ছফার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পিতার প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণ গাছবাড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে গাছবাড়িয়া নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। রাজনৈতিক কারণে আত্মগোপনে থাকায় শিক্ষার ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়নি। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে উত্তর চট্টগ্রামের নাজিরহাট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। একই বৎসরে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে। পরে বাংলা বিভাগে ক্লাশ করা অব্যাহত রাখেননি। ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে এমএ পরীক্ষা দেয়ার আগেই বাংলা একাডেমির পিএইচডি গবেষণা বৃত্তির জন্য আবেদন করেন এবং তিন বছরের ফেলোশিপ প্রোগ্রামের জন্য মনোনীত হন। গবেষণার বিষয় ছিল ‘১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব, বিকাশ, এবং বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে তার প্রভাব’। ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে পিএইচডি অভিসন্দর্ভের জন্য জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সান্নিধ্যে আসেন। দীর্ঘকাল তাঁদের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকে। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে প্রাইভেটে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পরীক্ষা দেন। মৌখিক পরীক্ষা হয় একুশে মার্চ। পিএইচডি সম্পন্ন করা পরে আর সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ১৯৭১ সালে ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’ গঠন ও এর বিভিন্ন কার্যক্রমে সক্রিয় অংশ নেন। ৭ই মার্চ ‘স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা’ হিসেবে প্রতিরোধ প্রকাশ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এপ্রিল মাসে কলকাতা চলে যান। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সেখান থেকে ‘দাবানল’ নামক পত্রিকা সম্পাদনা করেন। দেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশে ফিরে লেখালেখি করতে থাকেন। ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে দৈনিক ইত্তেফাকের সাংবাদিক নাজিমুদ্দিন মোস্তানের সহায়তায় কাঁটাবন বস্তিতে ‘শিল্পী সুলতান কর্ম ও শিক্ষাকেন্দ্র’ চালু করেন। ১৯৮৬-তে জার্মান ভাষার ওপর ডিপ্লোমা ডিগ্রিও লাভ করেন তিনি।
যা তাঁকে পরবর্তী সময়ে গ্যাটের অমর সাহিত্যকর্ম ফাউস্ট অনুবাদে সহায়তা করেছিল। কাজ ও লেখার মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশ ও বাংলাভাষাকে তিনি উচ্চ স্থানে তুলেছেন বা চেষ্টা করেছেন।
১৯৪৩ ইংরেজি সালের ৩০ জুন আহমদ ছফার জন্ম হয়।, চট্টগ্রামের তৎকালীন পটিয়া থানার বর্তমান চন্দনাইশ উপজেলার দক্ষিণ গাছবাড়িয়া গ্রামে। তাঁর বাবার নাম হেদায়েত আলী মায়ের নাম আছিয়া বেগম। মৃত্যুবরণ করেন ঢাকায়, ২০০১ সালের ২৮ জুলাই। তাঁকে রাজধানী ঢাকার মিরপুর সাধারণ কবরস্থানে দাফন করা হলেও, বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাঁর স্থান হয়নি।
লেখক: সাংবাদিক