নিরাপদ সড়ক : ইসলাম কি বলে ?

39

ফখরুল ইসলাম নোমানী

সড়ক দুর্ঘটনা একটি গুরুতর জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। সংবাদমাধ্যমে প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির খবর আসছে। বিষয়টি গভীর শঙ্কার ও উদ্বেগজনক। সড়ক-মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিল কিছুতেই থামছে না। চালকের অবহেলা, অনভিজ্ঞতা, অদক্ষতা কিংবা আরোহীদের অসচেতনতা যাই বলি না কেন, সড়ক দুর্ঘটনা যে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা সবার দায়িত্ব। এটি শুধু রাষ্ট্রের একক কাজ নয়, এর জন্য সবাইকে আন্তরিকভাবে চেষ্টা করতে হবে। আইন মানতে হবে। সড়কে বিঘ্ন সৃষ্টি হয় এমন কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে এবং সড়ককে নিরাপদে ব্যবহার উপযোগী করার জন্য সবাইকে উদ্যোগী হতে হবে। এ প্রসঙ্গে নবীজি (সা.) বলেন, ‘ঈমানের সত্তরটিরও বেশি শাখা আছে,এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান শাখা হলো, এ কথার স্বীকৃতি দেওয়া যে আল্লাহ তাআলা ছাড়া কোনো মাবুদ নেই। আর সবচেয়ে নিচের শাখাটি হলো রাস্তায় কোনো কষ্টদায়ক বস্তু থাকলে তা সরিয়ে দেওয়া। আর লজ্জাও ঈমানের একটি শাখা।’(নাসায়ি, হাদিস : ৫০০৫)
নিজেরা রাস্তা দখল করে দোকান-পাট,বাড়ি-ঘর করলে,রাস্তাকে আবর্জনার স্তূপ বানালে কিংবা যত্রতত্র মালামাল রাখলে, গাড়ি পার্কিং করলে,বেপরোয়া গাড়ি চালালে,ফিটনেসবিহীন গাড়ি বা অপরিপক্ব ড্রাইভার রাস্তায় নামালে, আইন না মেনে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তাপারাপারের চেষ্টা করলে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তাই নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে হলে আগে নিজেদের সচেতন হতে হবে। কারণ আমরা নিজেরা যত দিন সচেতন হব না, তত দিন সড়কের দুর্ভোগ লাঘব করা সম্ভব হবে না। তাই ইসলাম নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে প্রতিটি ব্যক্তির মাঝে সচেতনতা তৈরি করেছে এবং উৎসাহ দিয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে সড়কের আইন মেনে চলে নিজেকে সড়কের দুর্ভোগ সৃষ্টির কারণ না বানানো, কেউ বিপদে পড়লে তার বিপদে এগিয়ে আসা, মানুষের সঙ্গে সদাচরণ করা, সড়কে কোনো কষ্টদায়ক বস্তু থাকলে তা সরানোর ব্যবস্থা করা অত্যন্ত সওয়াবের কাজ। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, আদম সন্তানের দেহে ৩৬০টি সংযোগ অস্থি বা গ্রন্থি আছে। প্রতিদিন সেগুলোর প্রতিটির জন্য একটি সদকা ধার্য আছে। প্রতিটি উত্তম কথা একটি সদকা। কোনো ব্যক্তির তার ভাইকে সাহায্য করাও একটি সদকা। কেউ কাউকে পানি পান করালে তাও একটি সদকা এবং রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরানোও একটি সদকা।’ (আদাবুল মুফরাদ,হাদিস : ৪২৩)
সড়ক থেকে কষ্টদায়ক জিনিস সরিয়ে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতকরণ এতটাই ফজিলতের যে এর প্রতিদানে মহান আল্লাহ এক ব্যক্তিকে জান্নাত উপহার দিয়েছেন। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, এক ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় একটি কাঁটাযুক্ত ডাল দেখে বলে,আল্লাহর শপথ! আমি অবশ্যই মুসলিমদের চলাচলের রাস্তা থেকে এটা অপসারণ করব, যাতে তাদের কোনো কষ্ট না দেয়। ফলে তাকে জান্নাতে প্রবিষ্ট করানো হয়।’ (মুসলিম, হাদিস : ৬৫৬৪)
সুবহানাল্লাহ! এ হাদিস দ্বারা বোঝা যায় যে আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় জনগণের কল্যাণে কাজ করা মহান আল্লাহর কাছে কতটা প্রিয়। নিরাপদ সড়ক বিনির্মাণের একটি অংশ হলো, নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া। তারাযাতে যৌন হয়রানির শিকার না হয় বা পর্দা রক্ষা করে গন্তব্যে পৌঁছতে পারে, তাই তাদের বসার সুযোগ করে দেওয়া, বৃদ্ধ, শিশু ও নারীদের বিবেচনায় সাবধানে গাড়ি চালানো ইত্যাদি। ‘সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সবার দায়িত্ব’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা শুধু সরকার বা চালকদের দায়িত্ব নয়, বরং দেশের সকল মানুষের দায়িত্ব। পথচারী থেকে শুরু করে সকল নাগরিকের দায়িত্ব। সবাইকে নিজ দায়িত্বপালন করতে হবে। নিরাপদ সড়ক উপহার দেয়া আমাদের সকলের ঈমানি দায়িত্ব।
আনাস বিন মালেক (রা.) বলেন, একবার মহানবী (সা.) তাঁর কতক স্ত্রীর কাছে এলেন। তখন তাঁদের সঙ্গে উম্মে সুলায়মও ছিলেন। মহানবী (সা.) বলেন, সর্বনাশ,হে আনজাশাহ! তুমি (উট) ধীরে চালাও। কেননা তুমি কাচপাত্র (মহিলা) নিয়ে চলেছ। (বুখারি, হাদিস : ৬১৪৯)
এ ছাড়া কোনো পথচারী পথ হারিয়ে ফেললে তাকে সঠিক পথ দেখিয়ে দেওয়াও অত্যন্ত সওয়াবের। এটিও নিরাপদ সড়ক নিশ্চিতকরণে করণীয় বিষয়গুলোর একটি। ইসলাম এ বিষয়টিকে এতটাই গুরুত্ব দেয় যে এর বিনিময়ে গোলাম আজাদ করার সমপরিমাণ সওয়াবের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বারাআ ইবনে আজিব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.)-কে আমি বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি একবার দোহন করা দুধ দান করে অথবা টাকা-পয়সা ধার দেয় অথবা পথ হারিয়ে যাওয়া লোককে সঠিক পথের সন্ধান দেয়, তার জন্য রয়েছে একটি গোলাম মুক্ত করে দেওয়ার সমপরিমাণ সাওয়াব। (তিরমিজি, হাদিস : ১৯৫৭)
নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করণে আরেকটি করণীয় হলো, মানুষের বিপদে এগিয়ে আসা, কেউ দুর্ঘটনার শিকার হলে কিংবা ছিনতাইকারীর খপ্পরে পড়লে বা অন্য যেকোনো ধরনের বিপদে পড়লে সাধ্যমতো তার সহযোগিতায় এগিয়ে আসা প্রতিটি মুসলমানের দায়িত্ব। কারণ একজন মুসলমান তার অপর মুসলমান ভাইকে কখনো বিপদে ফেলে রেখে যেতে পারে না। আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা পরস্পর হিংসা কোরো না, পরস্পর ধোঁকাবাজি কোরো না, পরস্পর বিদ্বেষ পোষণ কোরো না,একে অপরের ক্ষতি করার উদ্দেশে আগোচরে শত্রুতা কোরো না এবং একে অন্যের ক্রয়-বিক্রয়ের ওপর ক্রয়-বিক্রয়ের চেষ্টা করবে না। তোমরা আল্লাহর বান্দা হিসেবে ভাই ভাই হয়ে থাকো। এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তার ওপর অত্যাচার করবে না, তাকে অপদস্ত করবে না এবং হেয় প্রতিপন্ন করবে না। তাকওয়া এখানে, এ কথা বলে রাসুল (সা.) তিনবার তাঁর বক্ষের প্রতি ইঙ্গিত করলেন। একজন মানুষের মন্দ হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট যে সে তার ভাইকে হেয় জ্ঞান করে। কোনো মুসলিমের ওপর প্রত্যেক মুসলিমের জান-মাল ও ইজ্জত-আবরু হারাম।’ (মুসলিম, হাদিস : ৬৪৩৫)
বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ হলো মানুষের অসচেতনতা। তবে ড্রাইভার ও যাত্রীরা একটু সচেতন হলেই শতকরা ৮০ ভাগ দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব। আর মহাসড়কে যেহেতু অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত গতি, বেপরোয়া ওভারটেকিংয়ের কারণে। তাই অতিরিক্ত গতি ও বেপরোয়া ওভারটেকিং নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সেই সাথে নতুন ও অনভিজ্ঞ, অদক্ষ চালকদের জন্য কার্যকরী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে ১. ত্রুটিপূর্ণ ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন, ২. গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার, ৩. অতিরিক্ত যাত্রী এবং পণ্য পরিবহন, ৪. ট্রাফিক আইন না মানা, ৫. সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলা, ৬. চালকদের বেপরোয়া মনোভাব, অদক্ষতা ও অসতর্কতা ৭. অরক্ষিত রেললাইন, ৮. অতিরিক্ত গতি বেপরোয়া ওভারটেকিং ৯. রোড ডিভাইডার না থাকা, ১০. চালকদেও অদক্ষতা ও সঠিক প্রশিক্ষণ না থাকা, ১১. যাত্রীদেও রাস্তা পারাপাওে অসচেতনতা, ১২. যেখানে সেখানে যাত্রী ওঠানামা করা, ১৩. ভাঙারাস্তা, ১৪. এবং ট্রাফিক আইনের প্রতি চালক ও যাত্রীর অনাস্থা। এভাবে নানাবিধ কারণে সড়কে দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। এ দুর্ঘটনা থেকে জাতি পরিত্রাণ চায়।
যে কোনো মৃত্যুই দুঃখজনক। মৃত্যু যদি অকাল ও আকস্মিক হয় তবে তা মেনে নেয়া আরও কঠিন। প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে একের পর এক অকালমৃত্যু আমাদের শুধু প্রত্যক্ষই করতে হচ্ছে না এই দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক বিভীষিকাময় ও অরাজক পরিস্থিতিও মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সবার প্রচেষ্টায় এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতির নিরসন করতেই হবে। এভাবে চলতে পারে না। এভাবে মানুষের জীবনপ্রদীপ নিভে যেতে পারে না। পঙ্গুত্বের মতো দুর্বিষহ যন্ত্রণা নিয়ে মানুষ জীবন কাটাতে পারে না। কারণগুলো যেহেতু চিহ্নিত সেহেতু সড়ক দুর্ঘটনা রোধে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করা দুরূহ হবে কেন?
নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে সবার আগে আইনের প্রয়োগ জরুরি। তবে অনেক সময় শুধু আইন প্রয়োগ করেও সড়ক দুর্ঘটনা কমানো যায় না,তাই সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে ছোট বড় নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
আমরা সড়ক নিরাপত্তায় সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার বাস্তবায়ন দেখতে চাই। সড়কে মৃত্যুর মিছিল আর যেন দীর্ঘ না হয়। সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় সব রকম ব্যবস্থা নিতে হবে। দায়ীদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করার পাশাপাশি নিরাপদ চলাচলের বিষয়টি পরিবহন সংশ্লিষ্ট সবার উপলব্ধিতে আনতে হবে।সবাইকে সড়ক আইন মানতে বাধ্য করতে হবে।
শেষকথা : নিরাপদ সড়কে নিরাপদ থাকুন এবং অপরকে নিরাপদ থাকতে দিন-এই হোক আজকের সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতিজ্ঞা। নিরাপদ সড়ক উপহার দেয়া আমাদেও সকলের ঈমানি দায়িত্ব। মহান আল্লাহ সবাইকে নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে ইসলামের নির্দেশনাগুলো মেনে চলার তাওফিক দান করুন। দুনিয়া ও আখিরাতের নিরাপত্তা দান করুন। আমীন।
লেখক : হেড অব ফাইন্যান্স এন্ড একাউন্টস
এপিক হেলথ কেয়ার লিমিটেড