নিরাপত্তা নিয়ে টনক নড়েছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের

76

দেশের সব বিমানবন্দরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। জারি করা হয়েছে সতর্কাবস্থা। গত রবিবার বিমান ছিনতাই চেষ্টার পর এ নির্দেশনা দেয়া হয়। পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ইতিমধ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিরাপত্তা ঘাটতির কারণেই এধরনের ঘটনা ঘটেছে। এদিকে উড়োজাহাজে অভ্যন্তরীণ ভ্রমণে ছবিযুক্ত পরিচয়পত্র বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বিমান ছিনতাই চেষ্টার মামলার তদন্তের ভার পড়েছে কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের উপর। সিভিল এভিয়েশনের জিম্মায় দেয়া হয়েছে ময়ূরপঙ্খী ।
সূত্র জানায়, বিমান ছিনতাই চেষ্টার ঘটনার পর নড়েচড়ে বসেছে স্বরাষ্ট্র, বিমান মন্ত্রণালয়সহ সরকারের উচ্চপর্যায়। সব বিমানবন্দরে নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশনা দেয়া হয়। পর্যাপ্ত সংখ্যক আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েনের নির্দেশনা দেয়া হয়। আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ যাত্রীদের দেহ ও লাগেজ তল্লাশি আরো জোরদার করার নির্দেশনা দেয়া হয়।
বিমানরবন্দর সূত্রে জানা যায়, ঢাকা শাহজালাল বিমানবন্দর, চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দর, সিলেট ওসমানি বিমানবন্দর, কক্সবাজার বিমানবন্দরসহ দেশের সব বিমানবন্দরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে আর্মড পুলিশের সংখ্যা। বিমানবন্দরে প্রবেশ পথেও নিরাপত্তা তল্লাশি বাড়ানো হয়েছে। নিরাপত্তা চৌকির সংখ্যাও বৃদ্ধি করা হয়েছে। বহিরাগত কাউকে অভ্যন্তরে যেতে দেয়া হচ্ছে না।
সরেজমিনে চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে গিয়ে দেখা যায়, আগের চাইতে অনেক বেশি কড়াকড়ি। নিরাপত্তা ব্যবস্থাও আগের মত ঢিলেঢালা নেই। প্রবেশমুখে নিরাপত্তা চৌকিতেও কঠোর ব্যবস্থা। তল্লাশি ছাড়া কোনও ব্যক্তি বা গাড়ি প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। দ্বিতীয়, তৃতীয় ধাপেও একই অবস্থা। যাত্রীদের সঙ্গে কাউকেই ভেতরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। এছাড়া যাত্রীদের দেহ দফায় দফায় তল্লাশি করা হচ্ছে। লাগেজও স্ক্যান করা হচ্ছে।
বিমানবন্দর ব্যবস্থাপক উইং কমান্ডার সরওয়ার ই আলম বলেন, বিমানবন্দরের নিরাপত্তা সবসময় কঠোর থাকে। এ ঘটনার পর তা আরো বাড়ানো হয়েছে। কোনও ধরনের গাফেলতি কারো নেই। সব সংস্থাই দায়িত্ব পালন করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিরাপত্তা ঘাটতির কারণেই বিমান ছিনতাই চেষ্টার ঘটনা ঘটেছে। তারা বলছেন, এটি বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা দেবে। এর আগেও নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে যুক্তরাজ্য বাংলাদেশ থেকে কার্গো বিমান চলাচল সাময়িক বন্ধ রেখেছিল।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, বাংলাদেশি একটি বিমান ছিনতাই চেষ্টার ঘটনা এই প্রথম ঘটল। যা বহির্বিশ্বে ভাবমূর্তি নষ্ট করতে যথেষ্ট। প্রশ্ন হচ্ছে কিভাবে অস্ত্র নিয়ে একটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে কেউ উড্ডয়নের সুযোগ পেল? এটি স্পষ্টত, নিরাপত্তাদুর্বলতার কারণে হয়েছে। বাংলাদেশ বিমানের সাবেক পরিচালক কাজী ওয়াহিদুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, এত নজরদারির পরও কিভাবে এমনটি ঘটলো? এটিই প্রমাণ করে যে, নিরাপত্তায় ঘাটতি ছিল। তার মতে, কোনো না কোনোভাবে নিরাপত্তার ঘাটতি হয়েছে। এটি মেশিনে হোক কিংবা এর পেছনে অন্য কেউ থাকুক।
এর আগেও একাধিকবার বিমানবন্দরে যাত্রীদের তল্লাশি ও নিরাপত্তার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নানা প্রশ্ন তোলায় ইউরোপের দেশগুলোতে কার্গো পণ্য সরাসরি অবতরণ নিষিদ্ধ করা হয়। কয়েকটি রুটে সরাসরি বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। তখন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান রেডলাইনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। সংশ্নিষ্টরা বলছেন, সিভিল এভিয়েশনের কর্মীদের নিরাপত্তাবিষয়ক প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও তা কাজে আসেনি।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ এনামুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, বিমানের নিরাপত্তাহীনতায় যাত্রীরা উদ্বিগ্ন। সিভিল এভিয়েশনের নিরাপত্তা দুর্বলতার কারণে বাংলাদেশ স্বর্ণ চোরাচালানের স্বগরাজ্য হয়ে উঠেছে। প্রায়ই বিমান ও সিভিল এভিয়েশনের কর্মী ধরা পড়ছে স্বর্ণ চোরাচালান চক্রের সঙ্গে। নিরাপত্তার অভাবে বিমানে মশা ও পাখি ঢুকে পড়ছে। পাখির কারণে বিমানকে জরুরি অবতরণ করতে হচ্ছে।
বিমানের সাবেক পাইলট প্রকৌশলী খন্দকার এম জামান বলেন, পাইলটের বুদ্ধিমত্তায় বিমানযাত্রীরা রক্ষা পেয়েছেন। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, অস্ত্র নিয়ে কীভাবে একজন যাত্রী সবার চোখ এড়িয়ে বিমানে প্রবেশ করল। এ ঘটনা প্রমাণ করে, বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ফের ঢেলে সাজানোর সময় এসেছে।
এদিকে বিমান ছিনতাই চেষ্টার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলা তদন্তের ভার দেওয়া হয়েছে সিএমপি কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটকে। তদন্তে নেমে প্রথমেই আলামত হিসেবে বিমানটি জব্দ করে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের জিম্মায় দেওয়া হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার থেকে আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করেছে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। সোমবার রাতে পতেঙ্গা থানায় এ সংক্রান্ত মামলা দায়ের করা হয়। মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পেয়েছেন, সিএমপি’র কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের পরিদর্শক রাজেশ বড়ুয়া।
সিএমপি’র কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান উপ-কমিশনার মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টার মতো ঘটনার মামলা এই প্রথম পাওয়া গেছে। যেহেতু স্পর্শকাতর একটি ঘটনা, সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে।
জানা যায়, তদন্তকারী কর্মকর্তার নেতৃত্বে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের একটি টিম গতকাল মঙ্গলবার সকালে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়েতে গিয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। এ সময় উড়োজাহাজটির ভেতরেও তারা ঘুরে ঘুরে দেখেন। উড়োজাহাজটি এখন রয়েছে সিভিল এভিয়েশনের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক উইং কমান্ডার সরওয়ার ই আলমের জিম্মায়। এছাড়া র‌্যাব এবং সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো টিমের কাছে থাকা বাকি আলামত উদ্ধারের জন্য চিঠি পাঠানো হয়েছে।
এর আগে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সিভিল এভিয়েশনের প্রযুক্তি সহকারী দেবব্রত সরকার বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন। সন্ত্রাসবিরোধী আইন, ২০১২-এর ৬ ধারা এবং বিমান নিরাপত্তাবিরোধী অপরাধ দমন আইন, ১৯৯৭-এর ১১ (২) ও ১৩ (২) ধারায় দায়ের হওয়া মামলায় নিহত যুবক পলাশ আহমেদ ও অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) শাকিল মেরাজ স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
এতে বলা হয়, বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশন অথরিটির নির্দেশনা মতে, বিমানসহ সব এয়ারলাইন্সের অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে ভ্রমণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট যাত্রীদের বিমানবন্দরে বোডিং কার্ড নেওয়ার সময় টিকিটের সঙ্গে আবশ্যিকভাবে ফটো আইডি দেখাতে হবে। ফটো আইডি হিসেবে যাত্রীর বৈধ পাসপোর্ট বা ন্যাশনাল আইডি বা স্মার্ট কার্ড বা ড্রাইভিং লাইসেন্স বা স্টুডেন্ট আইডি অথবা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অফিস আইডি গ্রহণযোগ্য হবে।