নিত্যপ্রিয় দাশ আনোয়ারাবাসীর কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন

6

ছাবের আহমদ চৌধুরী

আনোয়ারা সদর ইউনিয়নের দীর্ঘ দুই যুগের চেয়ারম্যান নিত্যপ্রিয় দাশ একজন সহজ-সরল মানুষ ছিলেন। যে কেউ কোন কাজে সহযোগিতা চাইলে সাথে সাথে ছুটে যেতেন। লোভ তাকে স্পর্শ করতে পারেনি। চেয়ারম্যান নিত্যপ্রিয় দাশ এর জন্ম ১৯৩৪ সালে আনোয়ারা থানার বোয়ালগাঁও গ্রামে। তার মৃত্যু হয় ২৬শে মার্চ ২০০০ সালে ৬৬ বছর বয়সে কলকাতার একটি হাসপাতালে। নিত্য চেয়ারম্যান এর বাবা গৌড়চন্দ্র দাশ ও মাতা সাবিত্রী রাণী দাশ। গৌড়চন্দ্র দাশের ৪ সন্তানের মধ্যে নিত্যপ্রিয় সবার ছোট। সাদাসিধে নিরঅহংকার প্রকৃতির লোকটি মানুষের মঙ্গলার্থে কিছু করার জন্য উদগ্রীব থকবেন। জনকল্যাণমূলক যেকোন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তিনি ছিলেন নাছোড়বান্ধা। সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হলেও উপজেলা পরিষদের সভায় অন্যান্য ইউনিয়নের সমস্যা সমাধানেও তিনি ছিলেন সোচ্চার। কলকাতা থেকে যেদিন তাঁর মরদেহ আনোয়ারা গ্রামের বাড়িতে আনা হয় সেদিন শোকার্ত মানুষের ঢল নামে। ১৯৬৯ সালে সারাদেশ আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে উত্তাল। সেই সময়ে ছাত্রলীগের নেতাদের পাঠিয়ে বিভিন্ন স্কুলে সভা-সমাবেশ করার জন্য সহযোগিতা করেছিলেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় সিংহরা স্কুলের মাঠে এক নির্বাচনী জনসভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল, উপমহাদেশখ্যাত নারীনেত্রী কুন্দপ্রভা সেনগুপ্তা সেই জনসভার প্রধান অতিথি ছিলেন। তৎকালীন আওয়ামী লীগ প্রার্থী আতাউর রহমান খান কায়সার ও আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু ঐ জনসভায় বক্তৃতা করেছিলেন। সেই অনুষ্ঠান পরিচালনা করে ছিলেন চেয়ারম্যান নিত্যপ্রিয় দাশ। উক্ত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা নুরুল হক। ১৯৯৭ সালের ৭ই মার্চ আনোয়ারা থানা সদরে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ দিবস উদ্যাপন অনুষ্ঠান চলছিল। ঐ ভাষণ দিবস অনুষ্ঠানে সন্ত্রাসীরা অতর্কিত হামলা চালিয়ে সভা পন্ড করে দেয়। সেই দিন সাহসী ভূমিকা নিয়ে সন্ত্রাসীদের হামলার প্রতিবাদে এগিয়ে এসেছিলেন চেয়ারম্যান নিত্যপ্রিয় দাশ, উনি ঐদিন সাহস নিয়ে এগিয়ে না এলে, অনেক ছাত্রলীগ যুবলীগ ও আওয়ামীলীগের কর্মী হতাহত হত। তার সেই সাহসী ভূমিকার কথা আনোয়ারার মানুষ কখনো ভুলবে না। জাতীয় জীবনে ১৫ আগস্টের কলংকজনক অধ্যায়ের পর তিনি নানাভাবে নির্যাতিত ও লাঞ্ছিত হয়েছেন। সাহস ও ধৈর্যের সাথে সেই প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন। নিত্যপ্রিয় চেয়ারম্যানের মৃত্যুর খবর পেয়ে আমি ফিরিঙ্গীবাজার বাসায় যাই। ওখানে গিয়ে দেখি আমাদের বর্ষীয়ান নেতা এম ইদ্রিস বি.এম, শামশুদ্দিন আহমদ চৌধুরী, আবুল মনসুর চৌধুরী, সাংবাদিক জামাল উদ্দিন, এডভোকেট হরিপদ চক্রবর্তী, তাপস হোড়সহ অনেকে আছেন। আমি যখন বললাম, নিত্যবাবুর মরদেহ কলকাতা থেকে কখন নিয়ে আসবে, সেই মুহূর্তে একজন ছেলে আমাকে বলে টেলিফোন করে কলকাতায় যোগাযোগ করতে হবে। আমি তাকে বলি আপনাকে তো চিনলাম না। তখন সে বলল, আমি নিত্য চেয়ারম্যানের বড় ভাই সুরঞ্জন দাশের ছেলে সন্তোষ দাশ। বর্তমানে আমার চাচা নিরঞ্জন দাশের ছেলে যীশু দাশ মরদেহ নিয়ে আমার চাচী শিল্পী রাণী দাশসহ কলকাতায় অবস্থান করছেন। তখন আমি বললাম, টেলিফোন করার ব্যবস্থা আছে আমার সাথে কেউ একজন আসেন। তখন এডভোকেট হরিপদ চক্রবর্তী বললেন, তুমি সন্তোষ দাশকে সাথে নিয়ে যাও। তখন আমি শিল্পপতি আলহাজ্ব মোহাম্মদ আইয়ুব সাহেবের এ বি গ্রæপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের খাতুনগঞ্জ অফিসে যায়।
তখন আইয়ুব সাহেবকে বললাম, নিত্য চেয়ারম্যান কলিকাতায় মৃত্যুবরণ করেছে আপনার অফিস থেকে টেলিফোন করে যোগাযোগ করতে হবে। তখন আইয়ুব সাহেব বললেন, টেলিফোন নাম্বার দাও, ঐখান থেকে টেলিফোন করে কলিকাতায় যীশু দাশের সাথে আমি কথা বলি। তখন যীশু বলল, টাকার জন্য আমরা মরদেহ বাংলাদেশে আনতে পারছি না, আরেকটি সমস্যা নিত্য বাবুর স্ত্রী সড়কপথে আসছেন, যদি আমরা বিমানে যাই তাহলে তাকে নেওয়া তো কষ্ট হয়ে যাবে। তখন আইয়ুব সাহেব যীশু দাশের সাথে কথা বললেন। আইয়ুব সাহেব সাথে সাথে ইন্ডিয়ান এক ব্যবসায়ীকে টেলিফোন করে যীশু দাশের হাতে ১০,০০০/- (দশ হাজার) রুপি পোঁছে দেন। তারপর যীশু বলল, আমাদের ইন্ডিয়ান দুতাবাসের সহযোগিতা লাগবে, না হলে আমরা মরদেহ বাংলাদেশে নিতে পারব না। আমি সাথে সাথে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আতাউর রাহমান খান কায়সার ভাইকে আইয়ুব সাহেবের অফিস থেকে টেলিফোন করি। উনাকে চেয়ারম্যান নিত্যপ্রিয় দাশ এর মৃত্যুর খবর জানাই। সাথে সাথে কায়সার ভাই রাশিয়া থেকে ইন্ডিয়ার ডেপুটি হাই কমিশনার জনাব হুমায়ন কবিরকে টেলিফোন করে বলেন, আমার আনোয়ারার নিত্য চেয়ারম্যান কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেছে আপনি তাকে উনার ভাতিজা যীশু দাশের সাথে যোগাযোগ করে মরদেহটি বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন।
তখন যীশু দাশকে ইন্ডিয়ান হাই কমিশনার হুমায়ন কবিরের সাথে কায়সার ভাইয়ের কথা বলে দেখা করতে বললাম। সাথে সাথে যীশু দাশ হাই কমিশনার হুমায়ন কবিরের সাথে দেখা করল, তখন হুমায়ন কবির সাহেব জানতে চাইল, আতাউর রহমান খান কায়সার সাহেব তোমার কি হয়। তখন যীশু বলল, কায়সার চাচা আমাদের আত্মীয়। হুমায়ন কবির সাহেব বলল, তোমরা তো হিন্দু কায়সার ভাই তো মুসলিম তোমাদের কেমনে আত্মীয় হয়। তখন যীশু দাশ বলল, আমার চাচা আনোয়ারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিসাবে পারিবারিক সম্পর্ক খুব গভীর বিধায় আমরা হিন্দু সম্প্রদায় হলেও আত্মীয়ের চেয়ে বেশি পারিবারিক বন্ধন আছে, সে কারণে আমরা আত্মীয় বলছি। নিত্য চেয়ারম্যান এর ১ ছেলে ও ৪ মেয়ে রেখে যান। ছেলে নাম রুবেল দাশ, ৪ মেয়ে যথাক্রমে বাপ্পী দাশ, পম্পী দাশ, লাভলী দাশ, চুমকি দাশ ও স্ত্রী শিল্পী রানী দাশকে রেখে মৃত্যুবরণ করেন। দীর্ঘ ২ যুগেরও বেশি সময় আনোয়ারা সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৬৪ সালে ৩০ বছর বয়সে নিত্যপ্রিয় দাশ প্রথম চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়। ১৯৯৭ সালে বৃদ্ধ বয়সে পুনরায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য, আনোয়ারা থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি, আনোয়ারা থানা কেন্দ্রীয় পূজা উদ্যাপন পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, আনোয়ারা শ্রী রামকৃষ্ণ সারদা সেবাশ্রম এর আজীবন সদস্য ছিলেন। ইন্ডিয়ান ডেপুটি হাই কমিশনার জনাব হুমায়ন করিব সাহেব পরে আমেরিকার রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেছেন। নিত্যপ্রিয় দাশ আনোয়ারার সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হিসেবে পদাধিকারবলে সদর জামে মসজিদ পরিচালনা পরিষদের উন্নয়নমূলক কাজে ভূমিকা রাখার জন্য প্রতিটি সভায় আগ্রহভরে উপস্থিত থাকতেন। সর্বশেষ এই জনদরদী মানুষটি আত্মার সদগতি কামনা করি।
লেখক : সাবেক কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতা