“নিজস্ব সক্ষমতা অর্জনের পূর্বে ভারতীয় পণ্য বর্জন আন্দোলন কর্মসূচি দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে”

4

সালাহউদ্দিন শাহরিয়ার চৌধুরী

১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর থেকে ভৌগলিক, ভাষা ও সাংস্কৃতিক কারণে ভারতের সাথে একটি সুসম্পর্ক বিদ্যমান ছিলো তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে তথা বর্তমান বাংলাদেশের। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত যখন আমাদের স্বাধীনতার স্বপক্ষে কাজ করছে তখনও একটি পক্ষ সার্বক্ষণিক ভারতের সাথে বৈরী মনোভাব পোষন করেছে। তাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত বিরোধীতা নতুন কোন বিষয় নয়, সেটি ক্রীড়া ক্ষেত্রে, ধর্মীয় ক্ষেত্রে, সামাজিক ক্ষেত্রে ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও বিরাজমান। বর্তমান বিরোধীদল রাজনৈতিকভাবে যখন সরকারকে কোনরূপ চাপ সৃষ্টি করতে পারছে না তখনই পুরনো কায়দায় ভারত বিরোধী ভূমিকা অবতীর্ন হয়েছে, যার নতুন সংস্করণ হচ্ছে ‘ভারতীয় পণ্য বর্জন আন্দোলন’। যদিও আপাতদৃষ্টিতে তা একটি রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি বলে প্রতিয়মান, কারণ ২০ মার্চ রাজধানীর বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক প্রেস ব্রিফিং এ বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কুদ্দুস রিজভী বলেন, বিএনপি সহ ৬৩টি দল ভারতীয় পণ্য বর্জন আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করেছে। শুধু তাই নয় বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বললেন ‘শুধু ভারতীয় পণ্য নয় ভারতকেও বর্জন করতে হবে’। অথচ অন্যদিকে ২৪ মার্চ, ২০২৪ রাজধানীর হোটেল ওয়েষ্টিনে বিএনপি ৩৮টি দেশের কুটনৈতিকদের নিয়ে যে ইফতার পার্টির আয়োজন করে সেখানে বিভিন্ন দেশের ক‚টনৈতিকদের সাথে ভারতের ডেপুটি হাইকমিশনার ড. বিনয় জর্জ সহ ভারতীয় হাইকমিশনের অনেক কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। সুতরাং জনগণ স্বাভাবিকভাবে বুঝে নিবে এটি একটি রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজি। এটি যে জনগণের সাথে প্রতারণা এবং স্ববিরোধী কার্যক্রম তা বিশ্লেষন করলে দেখা যায় স্বাধীনতা পরবর্তী বিএনপি বা ভারত বিরোধীরা বিভিন্ন সময় ক্ষমতায় এলেও ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে ভারতের সাথে কখনও বিরোধে জড়ায়নি, কোন চুক্তি বাতিল করেনি, কোন অমিমাংসিত বিরোধের সমাধান করেনি, এমনকি কোন ন্যায্য হিস্যাও আদায় করতে পারেনি। কিন্তু তারা যখন বিরোধী দলে থাকে তখন তারা জনগনের মাঝে সেই ভারত বিরোধী প্রচারণা ও জুজুর ভয় দেখিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার চেষ্টা করে।
ভারতীয় পণ্য বর্জন আন্দোলন এই ধরনের একটি ইস্যু নিয়ে বিএনপি এবং তাদের সহযোগী অন্যান্য রাজনৈতিক দল জনগনকে আন্দোলনে নামতে পারে তা কল্পনাতীত। যা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করবে। যারা ভারতীয় পণ্য বর্জন আন্দোলন এই বিষয়টি নিয়ে মাঠে নেমেছে তাদের অবশ্যই একটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে। কিন্তু যারা এই অর্বাচীন ও অগ্রহণযোগ্য আন্দোলনের কথা বলছে তাদের কাছে মানুষের প্রয়োজন সম্বন্ধে প্রকৃতপক্ষে কোন তথ্য নেই। শুধু মাত্র গায়ের শাল-চাদর ফেলে দিয়ে নিজেদের ভারত বিরোধী বললেই জনগণকে বিপদের মুখে ফেলে দেওয়া হবে, সাধারণ জনগণ কিন্তু এই দামী শাল বা শাড়ী খুব একটা ব্যবহার করে না তাদের ব্যবহার যোগ্য পণ্য হচ্ছে নিত্য প্রয়োজনীয় ও কৃষি পণ্য। যারা এই বর্জননীতি ঘোষণা করে জনগণকে বিভ্রান্ত করছে তারা কি জনগনকে কোন ধারনা দিতে পেরেছে যে, ভারতের পণ্য বর্জন করে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় পন্যের চাহিদা আমরা কতটা অন্য দেশ থেকে আমদানী করে মিটাতে পারবো? ভারত থেকে পণ্য আমদানী না করে অন্য দেশ থেকে পণ্য আমদানী করলে আমরা কতটুকু আর্থিকভাবে লাভবান হবো, কতটুকু বৈদেশিক মূদ্রা আশ্রয় হবে আমাদের। বাংলাদেশের কিছু বিশেষ পণ্য রপ্তানী ছাড়া আমদানী নির্ভর একটি দেশ। বাংলাদেশের বিভিন্ন পণ্য আমদানীতে চীনের পরেই রয়েছে ভারতের স্থান, তাই ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশে আমদানীর ক্ষেত্রে ভারতীযি নির্ভরতার রয়েই যাবে।
তথ্যমতে ২০২২-২৩ সালে ভারত বাংলাদেশে ৯৭ ধরনের পণ্য রপ্তানি করেছে যার বড় অংশ হচ্ছে তুলা, সূতাসহ পোশাক খাতের কাঁচামাল, দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে তৈল ও অন্যান্য খনিজ জ্বালানী যা আমাদের দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানী যোগ্য কারখানায় উৎপাদন সংশ্লিষ্ট, তৃতীয় স্থানে আছে খাদ্য সামগ্রী যার মধ্যে রয়েছে পেঁয়াজ, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, ভোজ্য তৈল, চিনিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রী। ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে ভৌগলিক অবস্থানের কারণে ভারত থেকে পণ্য আমদানী বেশী করা হয় যা অন্য দেশ থেকে আনতে গেলে ২০ থেকে ৪০ শতাংশ খরচ বৃদ্ধি পাবে এবং তাতে দ্রব্য মূল্যের দাম বৃদ্ধি পাবে এবং তা জনগণের ঘাড়েই বর্তাবে। ভারত থেকে সহজে সড়ক পথে আমদানী করা যায় বলে কোন দ্রব্যের সংকট সৃষ্টির পূর্বেই তা দেশে আমদানী করা যায়। ব্যবসায়ীরা বলেন, সাপটা চুক্তির কারনে দুই দেশই কিছু শুল্ক সুবিধা পাই বলেই আমরা আমদানী করি। তাছাড়া প্রতিযোগিতাময় বাজারে আমরা ভারত থেকে কম মূল্যে বিভিন্ন দ্রব্য আমদানী করতে পারি বলে আমরা ভারতীয় পণ্য আমদানী করে আমাদের রপ্তানীমুখি শিল্পগুলোকে আমরা পরিচালিত করি।
অবশ্যই দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আমদানী নির্ভরতা কমিয়ে দেশকে স্বাবলম্বী হতে হবে। তবে নিজস্ব সক্ষমতা অর্জনের পূর্বে আমরা শুধু ভারতীয় পণ্য নয়, যেকোন দেশের পণ্য বর্জনের বা আমদানী না করার কথা বলি তাহলে সেটি বুমেরাং হয়ে কাজ করতে পারে। বিরোধী দল বা যারা ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলনের কথা বলে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে চায় এবং তাদের সেই আন্দোলন যদি ভারতও রাজনৈতিকভাবে আমলে নেয় তাহলে একটি বৈরী সম্পর্ক তৈরী হবে এবং বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলো হয়তো সেটি প্রত্যাশা করে। সেক্ষেত্রে তার প্রতিক্রিয়ায় ভারত যদি পণ্য রপ্তানী বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশের বাজারে ব্যবস্থাপনায় সংকট এবং অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরী হবে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ভারত থেকে যে ৯৭টি পণ্য আমদানী হয় তার মধ্যে পেঁয়াজ এবং চিনি অন্যতম এবং তা শুধু সাময়িক রপ্তানী বন্ধ করার ঘোষণা বাংলাদেশে এর বাজার অস্থির হয়ে যায়। ভারত পৃথিবীর অন্যতম তুলা উৎপাদনকারী দেশ। যে পোশাক শিল্পের মাধ্যমে আমরা সর্বোচ্চ রপ্তানী করি, সেই পোশাক শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে আমাদের ভারতের তুলার উপর নির্ভরশীল হতে হয় অন্যথায় ইরান, উজবেকিস্থান, আফ্রিকা বা পশ্চিমের কোন দেশ থেকে তুলা আমদানী করার ক্ষেত্রে সময় এবং খরচ দুটিই বাড়বে সেক্ষেত্রে আমাদের পোশাক শিল্প প্রতিযোগিতাশীল বিশ্ব বাজারে টিকে থাকতে কঠিন হয়ে পড়বে। শুধু তাই নয় এই রাজনৈতিক কারনে যদি ভারত তার ভিসা নীতিতে পরিবর্তন আনে তাহলে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে সেটির প্রভাব পড়বে। কারণ বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উপর অনেকেই আস্থাশীল হতে না পেরে বাংলাদেশ থেকে ভারতে চিকিৎসা গ্রহন করতে যায় তাছাড়াও রয়েছে পর্যটন ও তীর্থ যাত্রা। সুতরাং বাংলাদেশ ভারতীয় পণ্য বর্জন করলে ভারত যে খুব বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হবে এমন কিছু নয়। কারণ বাংলাদেশ ভারতের জন্য একমাত্র রপ্তানীকারক দেশ নয়।
জনগণের কল্যানে সরকার বিরোধী আন্দোলন করবে বিরোধী দল এটা নিঃসন্দেহে একটি ভালো প্রয়াস, তবে সেটি যেন জনগণকে জিম্মী করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার মাধ্যম না হয়। কোন রাষ্ট্রই সব ক্ষেত্রে স্বয়ং সম্পূর্ণ নয়, প্রতিটি রাষ্ট্র একে অপরের পরিপূরক। সুতরাং যতদিন না নিজেদের সক্ষমতা অর্জন না হয় ততদিন আন্তর্জাতিক ক‚টনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত কোন আন্দোলন বা কর্মসূচী সরকার বা বিরোধীদল কারো প্রদান করা উচিৎ নয়, যা দেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করবে। কারণ এটি জনগণের জন্য বাস্তবিক অর্থে কোন সুফল বয়ে আনবে না, বরঞ্চ নিজস্ব সক্ষমতা অর্জনের পূর্বে এই রূপ রাজনৈতিক বক্তব্য দেশের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে।
লেখক: ডেপুটি রেজিস্ট্রার-
বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ