নিজস্ব বিনিয়োগ ছাড়াই ‘নান্দনিক’ হচ্ছে নগরী

141

সড়কের উপর বছরের পর বছর দুর্গন্ধ ছড়ানো ‘ডাস্টবিন’ বদলে গিয়ে হয়েছে নান্দনিক সবুজ বাগান। সড়কের মাঝের আইল্যান্ড জুড়ে সবুজ গাছের সারি। ঝোপঝাড়ে পরিত্যক্ত গোলচত্বরগুলোতে হয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্য বহনকারী নানা স্থাপত্য। নগরজুড়ে এমন নান্দনিক কাজের বিপরীতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) কোনো টাকায় খরচ করেনি। শুধু কৌশলী উদ্যোগ নিয়েছে। এতে কোনো বিনিয়োগ ছাড়াই নান্দনিক হয়ে উঠছে নগরী। আর তা হল ‘আউটসোর্সিংয়ের’ মাধ্যমে নগরীর সৌন্দর্য্যবর্ধন।
বিভিন্ন শিল্পগ্রুপ নিজেদের কোম্পানির ব্র্যান্ডিং করতে নিজেদের খরচ ও রক্ষণাবেক্ষণে সিটি কর্পোরেশনের সড়কদ্বীপ, গোলচত্বর, ফুটপাত নান্দনিক করে তুলছে। এমন উদ্যোগের জন্য দেশা সেরা হওয়ার গৌরবও অর্জন করে চসিক। তবে নিয়মিত মনিটরিংয়ের অভাব হলে সৌন্দর্য্যবর্ধনের চেয়ে বাণিজ্যই প্রাধান্য পাবে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
জানা গেছে, গত ৪ জুলাই সরকারের স্থানীয় সরকার বিভাগের উদ্যোগে ‘ইনোভেশন শোকেসিং উদ্ভাবনী কর্মশালার’ আয়োজন করা হয়। এতে দেশের ১২টি সিটি করপোরেশন, ৪টি ওয়াসা এবং ৪টি পৌরসভা অংশগ্রহণ করে। যেখানে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) প্রথম স্থান অধিকার করে। যার পেছনে অন্যতম উদ্ভাবন ছিল আউটসোর্সিং এর মাধ্যমে নগরীর গোলচত্বরে সৌন্দর্য্যবর্ধন, সড়কদ্বীপ, স্কুল-কলেজের সীমানা প্রাচীর ও পরিত্যক্ত স্থানে ম্যুরাল ভাস্কর্য, ঝর্না বা ফোয়ারা, বৃক্ষ রোপণ ও বাগান করার মাধ্যমে নগরীর সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি করা। গত বছর চসিক এমন উদ্যোগে নগরীকে নান্দনিক করার উদ্যোগ নেয়। তখন থেকে নগরীর মূল সড়কে ৩০টিরও বেশি ডাস্টবিন রূপ নিয়েছে নান্দনিক সবুজ বাগানে।
নগরীর চট্টেশ্বরী মোড়ের ত্রিভুজাকার চত্বরটির নাম ‘জহুর-মান্নান চত্বর’। এটি আগে ছিল ডাস্টবিন। সেখানে সারাদিন আশপাশ থেকে আসা ময়লা-আবর্জনার স্ত‚প জমা হত। এতে দুর্গন্ধে নাক চেপে হাঁটতে হতো পথচারীদের। সে জায়গায় এখন আর ডাস্টবিন নেই। হয়েছে সবুজের সাথে নান্দনিক স্থাপত্য। যেটি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরী ও এমএ মান্নানকে প্রজন্মের কাছে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে।
এছাড়া নগরীর জিপিও’র বিপরীতে আলকরণের মুখে ছিল বড় আকারের ডাস্টবিন। যেখানে ময়লার দুর্গন্ধে মানুষের হাঁটা ছিল দায়, সেখানে মানুষ এখন দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে।
নগরীর দেওয়ানহাট এলাকার ডবলমুরিং থানার সামনে দেখা যায়, ফুটপাতের পাশে দেয়ালটিতে স্বাধীনতা যুদ্ধের নানা ইতিহাসের চাপ। সবুজ আঁকড়ে ধরেছে ফুটপাতটিকে। সবমিলিয়ে নগরবাসীর ব্যস্ততাকে ভুলিয়ে দেওয়ার মত নান্দনিকতা ফুটপাত জুড়ে। অন্যদিকে এয়ারপোর্ট রোডের নান্দনিকতা সবার কাছে প্রসংশিত শুরুর থেকেই।
করপোরেশনের নগর পরিকল্পনা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, নগরীর বিভিন্ন সড়কের আইল্যান্ড, ডিভাইডার, ফুটপাত আধুনিকায়ন ও সবুজায়নে সিটি করপোরেশন আউটসোর্সিংয়’র মাধ্যমে চুক্তি করে। যেখানে দ্বিতীয়পক্ষ নিজের খরচে সকল স্থাপত্য স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ করবে। তবে এক্ষেত্রে বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান অনুমোদিত ব্রান্ডিং করার সুযোগ পাবে। নগরীতে বিলবোর্ড উচ্ছেদ হওয়ায় ব্রান্ডিং করতে এমন সুযোগ লুফে নিচ্ছে বিভিন্ন শিল্পগ্রুপ।
এমন উদ্যোগের বিষয়ে সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, নগরীকে নান্দনিক করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মেয়র নির্বাচন করেছিলাম। চট্টগ্রামবাসী আমাকে সেই দায়িত্ব দিয়েছেন। কিন্তু সিটি করপোরেশনের আর্থিক সামর্থ্য নিয়ে এসব কিছু করা কঠিন ছিল। তাছাড়া এসব রক্ষণাবেক্ষণেও অনেক টাকা ও শ্রমিকের প্রয়োজন পড়ত। তাই আমরা ‘আউটসোর্সিং’ এর মাধ্যমে সৌন্দর্য্যবর্ধনের উদ্যোগ নিয়েছি। এতে নগর নান্দনিক হয়ে উঠছে, আবার তাদের খরচে রক্ষণাবেক্ষণও হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, আমি যখন দায়িত্ব নিই। তখন নগরীর বেশিরভাগ ডাস্টবিন ছিল মূল সড়কের উপর। মানুষ দুর্গন্ধে হাঁটতে পারতো না। সেখান থেকে প্রায় ৮শ ডাস্টবিন সরিয়েছি। এছাড়া বড় বড় ডাস্টবিনের জায়গায় এখন সবুজ বাগান। এই শহরকে আমি ডাস্টবিনগুলোর মতই পরিবর্তন করে দিতে চাই। তবে এসব নগরবাসীর সহযোগিতা ছাড়া সম্ভব নয়।
সিটি করপোরেশন সূত্র জানিয়েছে, আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে গত বছর জানুয়ারিতে সর্বপ্রথম ইস্পাহানী মোড় হতে মিড আইল্যান্ড ও রাস্তার উভয় পাশে ফুটপাতসহ টাইগারপাস গোলচত্বর ও পূর্বপাশের পুলিশ কন্ট্রোলরুম পর্যন্ত সৌন্দর্য্যবর্ধন করা হয়। এরপর থেকে দেওয়ানহাট ওভারব্রিজের উভয়পাশে ফুটপাত ও মিড আইল্যান্ডে সৌন্দর্যবর্ধন ও সবুজায়ন, পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকার ৮৮নং সংলগ্ন চকবাজার থেকে মুরাদপুর সড়কের পাশে নালার উপর ¯ø্যাব এপ্রোচ নির্মাণ ও সৌন্দর্য্যবর্ধন, জিপিও থেকে নিউমার্কেট মোড় হয়ে পুরাতন রেল স্টেশন পর্যন্ত এবং নিউমার্কেট মোড় থেকে শাহ আমানত মার্কেট পর্যন্ত সৌন্দর্য্যবর্ধন ও গোলচত্বরগুলো সবুজায়ন, আগ্রাবাদ বাদামতলী মোড় থেকে বারিকবিল্ডিং গোলচত্বর পর্যন্ত ফুটপাত, মিডআইল্যান্ড ও গোলচত্বরে সৌন্দর্য্যবর্ধন, সিটি গেট থেকে অলংকার মোড় পর্যন্ত সৌন্দর্য্যবর্ধন, প্রবর্তক মোড়ে আইয়ুব বাচ্চু চত্বরসহ গোলপাহাড় মোড় পর্যন্ত সৌন্দর্য্যবর্ধন, আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকার বাদামতলী মোড় থেকে আগ্রাবাদ জনতা ব্যাংকের মোড় পর্যন্ত, ষোলশহর ২নং গেট মোড় থেকে জিইসি মোড় হয়ে লালখান বাজার ইস্পাহানি মোড় পর্যন্ত, পাঁচলাইশ মক্কী মসজিদ থেকে ফিরিঙ্গিবাজারসহ নতুনব্রিজ পর্যন্ত, বাগমনিরাম এলাকার ওয়েলফুডের সামনে থেকে গোল পাহাড় মোড় পর্যন্ত, ২নং গেটের বিপ্লব উদ্যান ও চারপাশের ফুটপাত, কাস্টমস মোড় থেকে পতেঙ্গা মোড় পর্যন্ত, চকবাজারের অলি খাঁ মোড় থেকে মুরাদপুর, চসিকের অধীনস্থ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হোটেল আগ্রবাাদের সামনে এইচআরসি ভবনের পূর্ব এবং উত্তর পাশের ফুটপাত আধুনিকায়ন ও সবুজায়ন, ফয়’স লেক এপ্রোচ রোডের মিডআইল্যান্ড, চট্টগ্রাম আউটার স্টেডিয়ামের উত্তর ও পুর্বপাশের ফুটপাত নান্দনিককরণ ও নাগরিক সুবিধা উন্নয়ন, চট্টেশ্বরী মোড়ে ত্রিভুজাকার আইল্যান্ড, বায়েজিদ বোস্তামিস্থ তারা গেট-ব্যাটালিয়ন মোড় থেকে ক্লিপটন মোড় পর্যন্ত, নাগরিক সেবা উন্নয়নের জন্য ‘মেট্রো প্রভাতি’ স্পেশাল বাস কাউন্টারের জন্য অস্থায়ী বক্স কান্টার স্থাপন, ডিটি রোড দেওয়ানহাট মোড় থেকে কাঁচাবাজার মোড় পর্যন্ত, আন্দরকিল্লা মোড় থেকে লালদিঘীর উত্তর কোণা পর্যন্ত, গোলপাহাড় মোড় থেকে এমএম আলী রোড, কাজীর দেউড়ি আলমাস সিনেমা মোড় থেকে ওয়াসা মোড়, জিইসি মোড়ের সেন্ট্রাল প্লাজার সামনে থেকে ফুটপাত, ভঙ্গিশাহ মাজার চত্বর থেকে কদমতলী নিচের মোড় পর্যন্ত, চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপারের কার্যলয় থেকে প্রবর্তক মিয়াবিবি শো-রুম পর্যন্ত, ২নং গেটের মোড়ের পূর্ব পাশ, বহদ্দারহাট পুলিশবক্সের পশ্চিমে, চকবাজার প্যারেড কর্নারের উত্তর-পশ্চিম পর্যন্ত, জামালখানে পিডিবি অফিসার্স কোয়ার্টার সংলগ্ন ফুটপাতে গার্ডেনিং, লাইটিং, সিটিং, শপ ও লাইভ ফিশ একুরিয়াম নির্মাণ, শুলকবহর আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারের পূর্বে গোলচত্বর, বহদ্দারহাট গোলচত্বর, বহদ্দারহাট এখলাছুর রহমান প্রাথমিক বিদ্যালয়েল সামনে সৌন্দর্য্যবর্ধন, ঈদগাহ কাঁচা রাস্তা থেকে অলংকার মোড় পর্যন্ত মিড আইল্যান্ড, হাউজিং মোড় থেকে একে খান মোড় পর্যন্ত, ২নং গেট মোড় থেকে শেখ ফরিদ মার্কেটের কর্নার থেকে এসএ পরিবহনের কর্নার পর্যন্ত ফুটপাত উন্নয়ন ও সবুজায়ন করা হয়েছে। এসব ছাড়াও আরও ১০টির মত সড়কে সবুজায়ন অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে বলে জানিয়েছে চসিকের পরিকল্পনা বিভাগ।