নারী-মনের সহজ পাঠক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

369

জীবনের স্বাভাবিক সুখ-দুঃখকে অপরিসীম সহানুভূতি ও দরদে রাঙিয়ে তুলে রক্ষণশীলতা, শ্রেণিসংঘাত, ধর্মাশ্রয়ী কুপ্রথা, প্রথানুগ্যতা, পুরুষশাসিত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির শাসন-কারা ভেঙ্গে দিয়ে শাশ্বত নারী-প্রেমের স্বরূপ চিত্রায়নে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এক মায়াবী যাদুকর। গ্রামীণ সমাজ ব্যবস্থায় তাঁর উপলব্ধ রক্ষণশীলতা, কুপ্রথা, পুরুষশাসিত সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে ভালোবাসা কাতর নারী মনের বিক্ষুব্ধ ও সংঘাত সংকুল অপ্রকাশিত দ্বন্দ্বের স্বরূপ প্রকাশে সচেষ্ট শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নিরন্তর যুদ্ধ ঘোষণা কেবল নারীর মনকেই প্রলুব্ধ করেনি; প্রথাবিরুদ্ধ, সহানুভূতিশীল ও প্রেমাশ্রয়ী হাজারো পুরুষ হৃদয়কেও নাড়িয়ে দিয়েছিল। পক্ষান্তরে সেখানে লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থার সাথে প্রগতিশীলতাকে উস্কে দিয়েছিল। উথাল-পাথাল প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের মতো সামাজিক প্রচলিত শাসনকারার ভিতকে এলোমেলো করেছিল। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের এ যুদ্ধ সশস্ত্র নয়; ছিলো কথাসাহিত্যে। রেঙ্গুনে অবস্থানকালে এ যুদ্ধে নিজের শারীরিক ও মানসিক উপস্থিতি তিনি প্রমাণ করে দিয়েছিলেন এক মিস্ত্রির মেয়ে-শান্তিদেবীকে বিয়েকরে। শান্তিদেবীর বাবা এক মদ্যপায়ী পথভ্রষ্ট বুড়োর সাথে বিয়ে ঠিক করলে শান্তিদেবীর এ পরিস্থিতির পরিত্রাণের বিনীত অনুরোধেই তিনি স্বেচ্ছায় বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। অবশ্য শান্তিদেবী বেশিদিন বেঁচে থাকেননি, স্বপুত্রক প্লেগ রোগে মারা যান।
বাংলা কথাসাহিত্যে ‘অমর কথাশিল্পী, ‘অপরাজেয় কথাশিল্পী, ‘অপ্রতিদ্ব›দ্বী’ ইত্যাদি বহু উপাধিতে অভিষিক্ত ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের একটানা প্রায় পঁচিশবছরের (১৯১৩-১৯৩৮) সৃষ্টি সাধনার বিশাল সম্পদ সম্ভারে তার উপন্যাসের গুরুত্ব সর্বাধিক। এসবের কেন্দ্রবিন্দুতে আছে অসংখ্য অবহেলিত, নিপীড়িত, নিষ্পেষিত, নারী মনের চিরায়ত ভালোবাসায় পোড় খাওয়া, ধর্মাশ্রয়ী সামাজিক দন্ডের আগুনে জ্বলা নারীচরিত্র। তিনি সাধারণ মেয়ের আটপৌরে রোম্যান্টিক ঠাঁসবুনা কাহিনী নির্ভর সরল ভাববিভোর ভাষাকে পুঁজি করে নিরন্তর লিখে গেছেন প্রেমবিভোর নারীর সুখ-দুঃখের গল্প। লেখনীতে পতিতা, বিধবা, বৈষ্ণবী, সতী, অরক্ষণীয়া– সে যেমনটাই হোক না কেন, শরৎচন্দ্র তন্ময় থাকতেন তাদের প্রেমের অনাস্বাদিত বিরহে ও বঞ্চনায়।
শরৎচন্দ্রের উপন্যাস বা গল্পে কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে অধিক লেখক – সহানুভূতি পাওয়া প্রায় সবই নারী চরিত্র। এদের উল্লেখযোগ্য চরিত্র হচ্ছে – রাজল²ী, অভয়া, অচলা, সাবিত্রী, ভারতী, বিন্দুবাসিনী, হেমাঙ্গিনী, শৈলজা, পার্বতী, চন্দ্রমুখী, কাত্যায়নী, বিজলী, কিরণময়ী, সবিতা, পিয়ারী, রমা, মাধবী, হেমনলিনী, কমললতা, অন্নদা দিদি, বিরাজ, বিজয়া, ষোড়শী প্রমুখ। সংক্ষিপ্ত পরিসরে অল্প ক’টি চরিত্রের আলোচনাই সম্ভব। । এসব চরিত্র অপরাপর চরিত্রের ভিড়েও নিজস্ব প্রবণতা বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র বজায় রেখে আজো পাঠক মনে স্থায়ীভাবে আসন করে নিয়েছে। তাদের চরিত্রবৈশিষ্ট্য, অবয়ব, আদর্শিক নানাদিক, একজন প্রেমময়ী নারী হিসেবে স্ব স্ব প্রেমেরদাবী বনাম প্রথাগত, ধর্মাগত সামাজিক দ্বন্দ্বের প্রেক্ষিতে তাদের অবস্থানের কিছু দিক আলোচ্য।
নারীর সতীত্ব কী পদার্থ- ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের অন্নদা দিদিকে না পড়লে অজানাই থেকে যাবে। কাহিনীতে স্বামীর প্রতি অন্নদা এতটাই একনিষ্ঠ যে খুনি ও ছদ্মবেশী স্বামীর জন্যই সে কুলত্যাগিনী হয় এবং সে কুল-কলঙ্ক বয়ে নিয়ে চলে। আর, অন্নদা দিদিকে দেখেই শ্রীকান্ত নারীর কলঙ্কে সহজে বিশ্বাস করত না। ‘বিরাজ বৌ’ উপন্যাসে বিরাজকে স্বামীর কাছ থেকে ভয়ানক যাতনা, গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছিল। ঘটনাচক্রে বিরাজ গৃহত্যাগ করেছিল ঠিকই, কিন্তু তার সতীত্বের অবমাননা করেনি। কিন্তু তাকে জীবন পণ করে সতীত্বের পরীক্ষা দিতে হয়েছিল ঠিকই। ‘দেনা-পাওনা’ উপন্যাসে ষোড়শীকে মর্মান্তিকভাবে পরীক্ষা দিতে হয় সতীত্বের।
সতীত্বের বিপরীতে বিধিবিরুদ্ধ যৌনতার ফলাফলও কিছু চরিত্রে প্রকাশ পেয়েছে। ‘শেষের পরিচয়’-এর সবিতা প্রথমে বিবাহ করে ব্রজবাবুকে, সবিতা এই ব্রজবাবুকে ছেড়ে বারো বছর রমণীবাবুর শয্যাসঙ্গিনী হয়ে থাকে, শেষ পর্যন্ত সে বুঝতে পারে যে, এই গণিকাজীবনের অবসান জরুরি। তাই বিমলবাবুর ভালোবাসায় তার এ জীবনের সমাপ্তি ঘটায়। এই নারী চরিত্রের মধ্যে আদিম যৌন প্রবৃত্তির প্রকাশ পেয়েছে; যা মানবচরিত্রে কখনো সুপ্ততা ভেঙে ঘটনার আকস্মিকতায় অবচেতনেই জেগে ওঠে। তবে যৌনতা যে দাম্পত্যজীবনের নৈতিকভিত্তি ও ধর্মসংস্কারে ধস্ নামিয়ে দেয় তাও প্রকাশ পেয়েছে। এমন অনৈতিক যৌনাচার নারীজীবনের স্বাভাবিক জীবনাচারকে কোন অতলে নিয়ে যায়, তার শিক্ষাও শ্রীকান্তের কমললতার কাহিনী থেকে নেয়া যায়।
শরত্চন্দ্র তাঁর উপন্যাসে পতিতা চরিত্রে তাদের প্রেম, প্রেমের একনিষ্ঠতা ও সেবাপরায়ণতার চিত্রগুলোই প্রাধান্য দিয়েছেন। পতিতা শ্রেণির পাপের দিকে যদিও সমাজ চক্ষু বিস্তারিত, শরৎচন্দ্র কিন্তু বারবারই এই অছ্যুৎ শ্রেণিকে একনিষ্ঠ প্রেমের পরিণতির দিকেই নিয়ে গেছেন। বিজলী সত্যেন্দ্রের প্রেমে বাইজি পেশা ছেড়ে দিয়ে বলে, ‘যে রোগে আলো জ্বাললে আঁধার মরে, সূর্যি উঠলে রাত্রি মরে—আজ সেই রোগেই তোমাদের বাইজি চিরদিনের জন্য মরে গেল’, পিয়ারী বাইজি বাল্যপ্রণয়ের টানে আজীবন শ্রীকান্তনিষ্ঠ হয়ে থাকে, সাবিত্রী-সতীশের মধ্যে চলে প্রেমের নানা খেলা, চন্দ্রমুখী অনুরক্ত হয়ে থাকে দেবদাসে। ‘দেবদাস’-এর চন্দ্রমুখী, ‘শুভদা’র কাত্যায়নী এবং ‘আঁধারে আলো’র বিজলীর মতো বারবনিতাদের কাহিনীও পাঠকদের হৃদয়কে দারুণভাবে নাড়ে দিয়েছে।
‘গৃহদাহ’র অচলার বিবাহিত জীবনের প্রেমকে সমাজ ক্ষমা করেনি। বিবাহোত্তর নারীর প্রেম রীতি গর্হিত কাজ। কিন্তু স্বামী মহিমের ভাবাবেগহীন কঠিন আবেদন, অন্যদিকে সুরেশের উন্মত্ত আবেগের ব্যাকুলতার মাঝে অচলার কোমল নারীমন কিংকর্তব্যবিমুঢ় ছিল। অবশেষে সুরেশের লাম্পট্যের জন্যই বিবাহিত অচলার সতীত্ব নষ্ট হলো। অচলাকেই এর মূল্য দিতে হলো। সুরেশই অচলার স্বামীপ্রেমের একনিষ্ঠতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিল। সুরেশকেই বলতে দেখা গেলো, ‘তুমি অসূর্যম্পশ্যা হিন্দু ঘরের কুলবধূ নও, এটুকুতে তোমার জাত যাবে না,… আসলে তুমি একটা গণিকা, তাই তোমাকে ভুলিয়ে এনেছি।’ অপরিনামদর্শী এই যৌন আস্বাদনের ক্লেদে তার অভিসম্পাত আচ্ছন্ন শরীর একসময় ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। এখানে লেখকের মনের কোনে অচলার প্রতি সুপ্ত সহানুভূতি থেকে থাকলেও কাহিনীচিত্রনে অচলা সহানুভূতি পায়নি।
শরৎচন্দ্রের ‘বিন্দুর ছেলে’র বিন্দুবাসিনী, ‘মেজদিদি’র হেমাঙ্গিনী, ‘পথের দাবী’র ভারতী, এবং‘নিষ্কৃতি’র শৈলজা সরল ও স্নেহপ্রবণ নারীর মূর্ত-প্রতীক। এখানে চিরায়ত নারীরূপের অনন্য একটি দিকের সন্ধান পাই।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম হয় হুগলী জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে ১৫ সেপ্টেম্বর ১৮৭৬ সালে । তাঁর বাবার নাম শ্রীমতিলাল চট্টোপাধ্যায় এবং মায়ের নাম শ্রীমতী ভুবনমোহিনী দেবী।
১৮৯৪ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে শরৎচন্দ্র দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এফ.এ পরীক্ষার ফি-য়ের জন্য মাত্র কুড়ি টাকা জোগাড় করতে না পারায়, তিনি আর সেই পরীক্ষাই দিতে পারেননি কোনোভাবে।
১৯৩৮ সালের ১৬ই জানুয়ারী বাংলা সাহিত্যের স্বনামধন্য এই কথাশিল্পী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মঃ
উপন্যাস: বড়দিদি (১৯১৩), বিরাজবৌ (১৯১৪), পরিণীতা (১৯১৪), বৈকুন্ঠের উইল (১৯১৫), পল্লীসমাজ (১৯১৬), চন্দ্রনাথ (১৯১৬), অরক্ষণীয়া (১৯১৬), পন্ডিতমশাই (১৯১৭), দেবদাস (১৯১৭), চরিত্রহীন (১৯১৭), শ্রীকান্ত (প্রথম পর্ব) ১৯১৭ , শ্রীকান্ত (দ্বিতীয় পর্ব) ১৯১৮, শ্রীকান্ত (তৃতীয় পর্ব) ১৯২৭, শ্রীকান্ত (চতুর্থ পর্ব) ১৯৩৩, প্রভৃতি। বড়গল্প: রামের সুমতি (১৯১৪) , বিন্দুর ছেলে (১৯১৪) , পথ-নির্দেশ (১৯১৪), মেজদিদি (১৯১৫), অনুরাধা (১৯৩৪), সতী (১৯৩৬), পরেশ (১৯৩৬), প্রভৃতি।
নাটক: ষোড়শী (১৯২৮), রমা (১৯২৮) প্রভৃতি।
তিনি সমাজের নানা শ্রেণির পতিত চরিত্র ও তাদের সংকটের দিকগুলো অতি সহানুভূতির সঙ্গে চিত্রিত করেছেন। তবে সংকটমোচনের পথ সবক্ষেত্রে প্রদর্শিত হয়নি। ‘পাপকে ঘৃণা কর, পাপীকে নয়’- শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নারীচরিত্র চিত্রণে এটাই মূল সুর। এখানে অর্থহীন ধর্মানুগত্যতা ও প্রথানুগত্যতার চেয়ে মনুষ্যত্বকেই বড় করে দেখেছেন তিনি। বিধাতার সৃষ্টি জগতে একমাত্র মানুষের ক্ষেত্রেই নারী-পুরুষের পারস্পরিক টানের বিচিত্রতা বড়ই রহস্যময় একটি অধ্যায়। এই রহস্যময় অধ্যায়টি নিয়েই শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সকল আকুলতা জড়িয়ে আছে, রচিত প্রায় সব গল্প-উপন্যাসের পরতে পরতে। শ্রেণিবৈষম্য, স্পৃশ্য-অস্পৃশ্যের দ্বন্দ্ব, কুসংস্কার, সম্পদ বা প্রভাব-প্রতিপত্তির সাথে মানবিকতার বিভেদ ইত্যাদি ক্ষেত্রেও প্রেমহৃদ্য নারীর অবস্থান নিপূনশৈলীতে রূপায়ণ করেছেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বাঙালি নারীর প্রেমাকুল হৃদয়ের ভাষারূপ এমনকরে কেউ কখনো পাঠোদ্ধার করতে পারেনি।