নারীসমাজ ও আমাদের রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা

9

 

আমাদের প্রধানমন্ত্রী, স্পীকার, বিরোধীদলীয় নেত্রী থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ, মন্ত্রিসভা, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়নের নজির তৈরি হলেও সমাজে ও রাষ্ট্রে নারীর অবস্থা যে এখনো কতোটা ঠুনকো ও নাজুক- সম্প্রতি পরীমনিসহ বিভিন্ন পেশার নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়ে তা আরেকবার পরিস্কার হয়ে গেল। নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিশেষকরে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি এখনো পাল্টায়নি। শুধু বিশ্ব নারী দিবস আসলে নারীর প্রতি মায়াকান্না করা হয়। নারীকে এখনো ভোগের সামগ্রী ও দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক মনে করা হয়। নারীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার তেমনএকটা গুরুত্ব দেয়া হয় না। অবস্থা এমনই, নারী হলো পুরুষের সেবিকা-পুরুষের কথায় ওঠ-বস করবে,এর বেশি কিছু নয়। নারী অধিকার-স্বাধীনতা- সাম্য প্রায় ৯০% পুরুষ মানতে নারাজ। আমরা আমাদের মা-মেয়ের প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করি- অন্যের মা-মেয়ে ও বোনের প্রতি তা খুব কমই করি। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর অবদান কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে বেশি হলেও তা আমরা মূল্যায়ন করতে চাই না। রাষ্ট্রীয়ভাবে বিগত একদশকে নারীসমাজের অগ্রগতি ও উন্নয়ন যেটুকু হয়েছে, তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কারণে হয়েছে। স¤প্রতি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ‘গার্ড অব অনার’ থেকে নারী কর্মকর্তাদের বাদ রাখার যে সুপারিশ করেছিলো, দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠলে তা থেকে সরে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি- ২০১১ প্রণয়ন করা হলেও নারী বিদ্বেষী ধর্মান্ধ মৌলবাদী গোষ্ঠীর প্রবল বিরোধিতায় তা আলোর মুখ দেখেনি।
এদিকে পরীমণিকে নিয়ে মিডিয়া যা শুরু করেছে তা-ও অপ্রত্যাশিত। নারীর দোষত্রæটিকে যেভাবে ফলাও করে প্রচার করা হয়, সেভাবে পুরুষের বেলায় কেন নয়। পরীমণির অপরাধ কী; এ অবস্থানে আসার জন্যে দায়ী কে? তিনি কী ব্যাংক লুট ও টাকা পাচার করেছেন? বাসায় মদ থাকা কী অপরাধ? দেশে রথি-মহারথি প্রায় সকলের বাসায় তো মদ থাকে। তাছাড়া তার বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ কেউ করেনি। পরীমণি যদি কারো সাথে প্রতারণা করে, কোনো অন্যায় কাজ করে থাকে- অবশ্যই দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী বিচার হবে। কিন্তু বিচারের আগে অভিযুক্ত পরীমণিকে দোষী হিসেবে আখ্যায়িত করে বিভিন্ন মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণায় সমাজে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে- সেই বোধটুকু কী আমরা হারিয়ে ফেলেছি। মা-বোন আমাদের সকলেরই আছে। পারস্পরিক সম্মতিকে কোনো ঘটনা ঘটলে তা নিয়ে অন্য কারও তো মাথা ঘামানোর কোনো অধিকার নেই। তাছাড়া, পরীমণির সাথে যারা এতোদিন বিশেষ সময় কাটিয়েছেন, তারা কী আইনের আওতায় আসবে; তাদের নামধাম কী মিডিয়ার মাধ্যমে জনসমক্ষে উন্মোচিত হবে?
পরীমণি চলচ্চিত্রের নায়িকা। তার বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে নানাবিধ সম্পর্ক থাকতেই পারে। সেটা কি একটা অপরাধ? আদালতে বিচার হওয়ার আগে দেশের চলচ্চিত্রজগতের সম্ভাবনাময় এক তরুণীর জীবন যেভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হলো, তার দায়িত্ব কে নেবে? আদালতের বিচারে পরীমণি যদি দোষী সাব্যস্ত হন এবং শাস্তি পান তাতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু একজন তরুণীকে যেভাবে আটক করে হেনস্তা করা হচ্ছে এবং তাঁর বিরুদ্ধে অপ্রমাণিত অপপ্রচার চালানো হচ্ছে, তা শুধু নারীসমাজের অপমান নয়, মানবতার অপমান। আমাদের নাগরিক স্বাধীনতার জন্যে এটি একটি অশনি সঙ্কেত।
পুরুষদের মধ্যে একটি প্রবল ধারণা- তারা নারীদের ঊর্ধ্বতন, আর নারী তাদের অধঃস্তন ব্যক্তি। নারী নেতৃত্ব মনেপ্রাণে কেউ মেনে নিতে চায় না। জাতিধর্মবর্ণনারীপুরুষ নির্বিশেষে সকলেই আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী- এ নীতি যথাযথভাবে স্বীকৃত নয়; সাদামাটায় পরিপালিত হয়। নারী থেকে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র শুধু সুবিধা নিতে চায় কিন্তু বিপদে-আপদে কেউ নারীর পাশে দাঁড়াতে চায় না। পুরুষ কিংবা নারী অপরাধ করতেই পারে। কিন্তু নারীর অপরাধটাকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা হয়। ভাবখানা এমনই, পুরুষ করলেও নারী অপরাধ করতে পারে না। পরীমনির বিপদে চলচ্চিত্র শিল্প সমিতি তার পাশে দাঁড়ায়নি। শুধু তা-ই নয়, তার অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার আগেই তড়িগড়ি করে বিশেষ মহলকে খুশি করতে সমিতির সদস্য পদ স্থগিত করা হয়। পরীমণি সরকারি হেফাজতে যাওয়ার পর বিভিন্ন সংগঠন ও নায়ক-নায়িকারা তার পক্ষে সরব হয়ে ওঠছে। বাস্তবতা হচ্ছে, পরিবার সমাজ, রাষ্ট্র – কোথাও নারী পরিপূর্ণভাবে নিরাপদ নয়।
নারীরা আজও অবহেলিত, শোষিত ও বঞ্চিত। খুন, ধর্ষণ ও নারীর প্রতি সহিংসা সমাজের অনুষঙ্গ। পুরুষশাষিত সমাজব্যবস্থায় ধর্মীয় গোঁড়ামী, সামাজিক কুসংস্কার, কুপমন্ডুকতা, নিপীড়ন ও বৈষম্যের বেড়াজালে নারীকে সবসময় অবদমিত রাখা হয়েছে। নারীর মেধা ও শ্রমকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হয় না।
পরিশেষে বলবো, শুধু নারীর সঙ্গ, প্রেম-ভালোবাসা কামনা করলে হবে না-নারীকে সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানোর সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হবে। নারীর মর্যাদা, অধিকার, সাম্য ও স্বাধীনতার কথা ভাবতে হবে। পুরুষের সাথে সমানতালে নারীকেও চলার সুযোগ করে দিতে হবে। অন্যথায় জাতীয় অগ্রগতি ও উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই বলতে হয়-
‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করেছে নারী অর্ধেক তার নর।’
লেখক: প্রধান-সম্পাদক
সাপ্তাহিক চাটগাঁর বাণী ও চাটগাঁরবাণীডটকম