নারীর প্রতি সহিংসতা : চাই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন

20

 

জাতিসংঘের ১৯৯৩ সালের ঘোষণা অনুযায়ী নারী-সহিংসতা হচ্ছে নারীর বিরুদ্ধে সংঘটিত এমন আচরণ, যা নারীকে শারীরিক ও মানসিকভাবে আঘাত করে। অন্যভাবে বলা যায়, নারী-সহিংসতা হচ্ছে নারীর বিরুদ্ধে ঐ সকল বৈষম্যমূলক আচরণ, যা নারীকে সামাজিক, অর্থনৈতিক, শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপদাপন্ন করে তোলে। যৌন হয়রানি বা যৌন নিপীড়ন হচ্ছে নারী-সহিংসতার অন্যতম দিক। দুঃখজনক হলেও সত্য যে নারী নির্যাতনের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। এর মধ্যে পারিবারিক ক্ষেত্রে হিংসাত্মক ঘটনা হচ্ছে নারীর মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন। তাছাড়া নারীদের নির্যাতিত হওয়ার কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যৌতুক। যদিও আমরা ঘটা করে প্রচার করছি যৌতুক একটি সামাজিক ব্যাধি। যৌতুক নেওয়া বা দেওয়া দুটিই অপরাধ। কিন্তু আমাদের প্রচার-প্রচারণা আদৌ সুফল বয়ে আনছে কি? বরং দেখা যাচ্ছে অভিভাবকরা মেয়েকে ভালো ঘরে বিয়ে দিতে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন।মেয়ের সুখের জন্য যৌতুক দিতে বাধ্য হচ্ছেন বাবা। দ্বিতীয়ত, কারো ভালোবাসার ডাকে সাড়া না দিলেও নারীকে হতে হচ্ছে লাঞ্ছিত। স্কুল ও কলেজগামী মেয়েরা ইভ টিজিংয়ের শিকার হচ্ছে। পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও ধর্মীয় শিক্ষার অভাবেই এমনটি হচ্ছে বলে মনে করেন সমাজবিজ্ঞানীরা। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, নারী নির্যাতনের ৯০ থেকে ৯৫ শতাংশ ঘটনারই কোনো বিচার হয় না। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দুর্বল ও দরিদ্র নির্যাতিতরা নির্যাতনের ঘটনার বিচার চাইতে আইনের দ্বারস্থ হয় না। হয়রানি ও নির্যাতনের ভয়ে ও আর্থিক সংকটের ফলে তারা নিরব থাকে।
এছাড়া নারীর ওপর সহিংসতার আরেকটি কারণ, তাদের প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। নারী নিজ পরিবারেও নির্যাতিত হচ্ছে। পরিবার পেরিয়ে বাইরেও নির্যাতনের শিকার হতে হয় তাদের। অনেক নারী চাইলেও নিজ পরিবারের কাছেও সহিংসতার কথা বলতে পারেন না। দেখা যায়, অনেক সময় পরিবারই নির্যাতিত নারিকে দোষী সাব্যস্ত করে। বিদ্যমান সমাজব্যবস্থায় সহিংসতার শিকার অনেক নারী চাইলেও আইনের আশ্রয় নিতে পারেন না। পরিবার ও সন্তানের কথা ভেবে অনেক নারীই এ সব অত্যাচার সহ্য করেন বাধ্য হয়ে। দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও অশিক্ষাসহ নানা কারণে নির্যাতিত হচ্ছে নারীরা। যৌতুকের দাবি মেটাতে না পেরে অসংখ্য নারীর জীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ। যৌতুক, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, তালাকসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিদ্যমান আইনগুলোর যথাযথ প্রয়োগ নেই। তাছাড়া এ সব আইন সম্পর্কে সাধারণ মানুষ সচেতনও নয়।
আমরা জানি নারীদের প্রতি বৈষম্য প্রতিরোধে, নিগ্রহের হাত থেকে রক্ষা করতে জাতিসংঘের বিভিন্ন কনভেনশন রয়েছে, রয়েছে অসংখ্য প্রতিবেদন। জাতিসংঘের বিভিন্ন সম্মেলনে গৃহীত পদক্ষেপের ওপর ভিত্তি করেই তৈরি করা হয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) গাইডলাইন। নামকরণ করা হয়েছে- সব ধরনের বৈষম্য ও নিপীড়নের হাত থেকে নারীদের রক্ষা করতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিশেষ গাইডলাইন।
এছাড়া নারী নির্যাতন বা নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে বাংলাদেশে ১৯৮৫ সালের পারিবারিক আদালত, ১৯৯৫ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন আইন, ২০০০ ও ২০০৩ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট-২০০৮, হাইকোর্ট নির্দেশিত যৌন নিপীড়নবিরোধী নীতিমালা-২০০৮ পাস হয়েছে। এখন কথা হলো, এত আইন বা নীতিমালা পাস হওয়া সত্তে¡ও কেন বন্ধ হচ্ছে না নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা? নারী নির্যাতন প্রতিরোধে বছরের পর বছর ধরে শুধু আন্দোলন নয়, নারীর প্রতি এ সহিংসতা রোধে প্রচলিত আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
তবে নারীর প্রতি সহিংসতা শুধু আইন করেই বন্ধ করা যাবে না, এ জন্য চাই সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। অর্থাৎ নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে ব্যক্তি থেকে সমাজ, প্রাতিষ্ঠানিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার। সুতরাং নারীর মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় সরকার ও রাষ্ট্রকে এ ক্ষেত্রে অধিকতর আন্তরিক হতে হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক