নান্দনিক পরিবেশের সিআরবি ও হাসপাতাল নির্মাণ প্রসঙ্গ

12

 

চট্টগ্রাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনিন্দ্য সুন্দর একটি জায়গা। পাহাড়ঘেরা উঁচু-নিচু রাস্তার মধ্যে সবুজের সমারোহ এ যেন প্রকৃতির এক অপূর্ব নান্দনিক লীলাভূমি। বাংলাদেশের নান্দনিক শহর বা স্থানের মধ্যে চট্টগ্রাম অন্যতম। এরকম প্রকৃতির দানে পরিপুষ্ট জায়গা বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া খুবই দুষ্কর। কিন্তু নগরায়নের নামে সেই পাহাড়ঘেরা নান্দনিক সৌন্দর্যের দিনদিন হানি ঘটেছে তা নিশ্চিত। একটি দেশের স্বাভাবিক যে ভূখন্ড তার মধ্যে ২৫ শতাংশেরও বেশি বনভূমি থাকা দরকার। কিন্তু পরিসংখ্যান বলে বাংলাদেশে এখন সেটা ৭/৮ শতাংশেরও কম। শহরের পাহাড় ঘেরা এ সবুজ শুধু সৌন্দর্যের জন্য নয়, প্রয়োজন আমাদের বাঁচার জন্যও। এর বিনাশ মানে, আমাদের নিজেদেরই বিনাশ। কিন্তু কিছু অর্থলোভী মানুষের কাছে এই নিষ্পাপ প্রকৃতি বারবার হিং¯্রতার শিকার হয়েছে। আমাদের চট্টগ্রামের পাহাড় ঘেরা নান্দনিক এই সৌন্দর্যের অনেকটাই হারিয়ে গেছে ভূমিখেকোদের কারণে। যেটুকু অবশিষ্ট আছে তাও ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবার পথে। চট্টগ্রামের সিআরবি চট্টগ্রামের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত নান্দনিক একটি জায়গা। চট্টগ্রামে নান্দনিক সৌন্দর্যের জায়গাগুলোর মধ্যে এটি একটি অন্যতম। তবে এ ধরনের জায়গা চট্টগ্রামে কমে যাচ্ছে। এ স্থানে রয়েছে রেলওয়ের সদর দপ্তর। সবুজ পাহাড়ের পাদদেশে চলে গেছে পিচঢালা পথ। চারদিক থেকে পথগুলো মিলিত হয়েছে এক জায়গায়। যেটাকে বলে সাত রাস্তার মোড়। এখানে রয়েছে ঐতিহাসিক শিরিষতলা। যেখানে প্রতিবছর বাঙালির ঐতিহ্যের উৎসব বাংলা নববর্ষসহ বাঙালির নানা উৎসব মহাসমারোহে উদযাপিত হয়। হাজার হাজার মানুষের পদাচারণায় মুখরিত হয় ওঠে শিরিষতলা প্রাঙ্গণ। এ যেন বাঙালির প্রাণের মিলনমেলা। প্রতিদিন সকাল ও বিকেল বেলা শত শত মানুষের শারীরিক কসরতেও শিরিষতলা প্রাঙ্গন মুখরিত থাকে। এ সিআরবির প্রাঙ্গণটি শান্ত স্নিগ্ধময় অপরূপ এক জায়গা। নগরীর মানুষের কোলাহল ও গাড়ি-ঘোড়ার প্রচন্ড চাপ থেকে যেন একদন্ড প্রশান্তি।
শতবর্ষী গাছের সুশীতল ছায়া যেন গ্রামের অনাবিল এক পরিবেশ। গাছগাছালি ও সবুজের সমারোহের কারণে বাইরের তাপমাত্রার চেয়ে এখানে তাপমাত্রা দু-এক ডিগ্রি সেলসিয়াস কম থাকে বলে বলা হয়। এটিকে বলা হয় চট্টগ্রামের ফুসফুস। এমন নান্দনিক জায়গার পাশে একটি বৃহৎ বেসরকারি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ নির্মাণ একটি সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। কয়েক বছর আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এ্যালামনাই এসোসিয়েশনের মত একটা বড় সংগঠনের প্রথম দিনের অনুষ্ঠান হয়েছিলো এই সিআরবির শিরিষ তলায়। চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে র‌্যালি করে সবাই এ শিরিষ তলায় মিলিত হয়েছিলেন এবং সেখানে রাতে একটি চমৎকার বাউল গানের উৎসবও হয়েছিলো। এ যেন ছিলো এক প্রাণের মিলনমেলা। এ রকম বড় অনুষ্ঠানের নির্মল মনোরম পরিবেশ সমৃদ্ধ জায়গা চট্টগ্রামে আর কই? আমাদের একটি সুদূরপ্রসারী গঠনমূলক চিন্তা করতে হবে। কিছু মানুষের ব্যবসায়িক মনোবৃত্তির কারণে এমন নান্দনিক সৌন্দর্যের পরিবেশ বিঘিœত করতে দেয়া যায় না। আর যে হাসপাতালের কথা বলা হচ্ছে সেটির কোন সুযোগ সুবিধা সাধারণ নাগরিক পাবে না। বড়লোকদের চিকিৎসা আর বড়লোকদের ছেলেমেয়ের পড়ার প্রতিষ্ঠান হচ্ছে এই মেগা প্রজেক্ট। হাসপাতাল হওয়ার ব্যাপারে মানুষের তেমন দ্বিমত নেই। দ্বিমত হচ্ছে তার স্থান নির্বাচন নিয়ে। এমনিতেই চট্টগ্রামে বিত্তবান লোকদের হাসপাতাল ইম্পেরিয়েল বা এভারকেয়ার তো আছেই। কিন্তু সাধারণ মানুষের দাবি আরও সরকারি হাসপাতাল। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল হাসপাতালে রোগীদের যে অবস্থা তা স্বচক্ষে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবেন না। বারান্দায় পর্যন্ত রোগীর সংকুলান হয় না। সাধারণ মানুষ যথাযথ চিকিৎসা সুবিধা পাচ্ছে না। অথচ এ সমস্ত মানুষের ট্যাক্সে সরকার চলে। তাদের জন্য হাসপাতাল দরকার। তবে চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষের হাসপাতাল হওয়ার জায়গায় নিয়ে যে প্রতিবাদ তা অত্যন্ত যৌক্তিক। আবার এ প্রতিবাদকে পুঁজি করে পুরো হাসপাতাল ও কলেজের প্রজেক্টটা যেন বাতিল হয়ে না যায়। যদি হয় তা আন্দোলনকারীদের ঘাড়ে কেউ কেউ দায় চাপিয়ে দিতে পারেন। এ ব্যাপারে সে দিকেও সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। চট্টগ্রামের সিআরবি প্রকৃতি প্রদত্ত একটি নান্দনিক স্থান। এটার অনেক ঐতিহ্য। সে ঐতিহ্যে আছে আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বগাথা অনেক ইতিহাস, বীর শহিদের কবর, আবহমান বাঙালির নানা উৎসবের সংস্কৃতি। শহরের মধ্যে কোলাহলহীন একদÐ নিঃশ^াস ফেলার স্থান সিআরবি। এ রকম স্থান কেউ ইচ্ছে করলে সৃষ্টি করতে পারে না। পার্ক, লেক, চিড়িয়াখানা, মেডিক্যাল কতকিছুই না আজ সৃষ্টি করা যায়। ঢাকার রমনা পার্কের মত বড় পার্কে একটু মন খুলে হাঁটার জায়গাতো চট্টগ্রামে তেমন নেই। ডিসি হিল, আগ্রাবাদ জাম্বুরি পার্ক এখন আর সেভাবে নেই, সার্কিট হাউসের সম্মুখভাগের মাঠও নেই। আউটার স্টেডিয়ামও অনুপযুক্ত। শহরের নাগরিকরা কি শুধু চাকুরি, ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ইটপাথরের দেয়ালে বন্দি হয়ে থাকবে? নগরের বিপুল মানুষের চাহিদা অনুযায়ী প্রশান্তি ও বিনোদনের স্থানও প্রয়োজন। প্রকৃতির নান্দনিক সৌন্দর্যকে অর্থের কাছে বিকিয়ে দেয়া না। এটি রেলওয়ের জায়গা, সরকারের সম্পত্তি। সরকার চলে জনগণের ট্যাক্সে। সরকারকে সেই জনগণের অনুভূতি বুঝতে হবে। রেলওয়ের সেই সিআরবি এলাকায় রয়েছে রেলওয়ে হাসপাতাল। মিডিয়ার মাধ্যমে জানা যায় এটি এখন প্রায় পরিত্যাক্ত। দু’একজন নামমাত্র ডাক্তার আছে, রোগী নেই। দেশের এই করোনাকালীন সংকটে এ হাসপাতালের কোন ভূমিকা নেই। অথচ রেলওয়ে উদ্যোগ নিয়ে জাতির এ সংকটে মানুষের জীবন বাঁচাতে এ হাসপাতাল নিয়ে এগিয়ে আসতো পারতো। তা না করে বড় বেনিয়াদের কাছে জায়গা লিজ দিচ্ছে। এটি অত্যন্ত দুঃখজনক। এ সিআরবিতে হাসপাতাল না করার পিছনে চট্টগ্রামের সুধীজন আওয়াজ তুলেছেন। তাদের অনুভূতিকে অবশ্যই গুরুত্ব দেয়া উচিত। সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ করা মানে পুরো নগরটাকে এক ধরনের অসুস্থ করার সামিল।
লেখক: প্রাবন্ধিক