নানা মুনি নানা মত, অতি মুনি মুসিবত

9

মছিউদ্দৌলা জাহাঙ্গীর

বেশি পাণ্ডত্যি ক্ষতিকর­ এ কথাটিই শিরোনামে নিহিত। আসলে এটি আমাদের মজ্জাগত দোষ, অকারণে মাস্টারি করা, তাই বিনা উসকানিতে আমরা মস্তানি করি। সপ্তাহ্ দুই আগের কথা, পত্রিকায় দেখলাম, হাটহাজারীতে ৬২ বছর বয়সের সাবেক এক চেয়ারম্যান নিজ বন্দুক দিয়ে আপন ভাতিজাকে গুলি করতে লাগলেন! বন্দুকের অবশ্য লাইসেন্স করা ছিলকিন্তু তাই বলে ভাতিজাকে গুলি করবি? ভাতিজা কি তোকে কাঁধে নেবে না? সে এসেছে বিদেশ থেকে, শুধু ভাতিজাকে না, খবর পেয়ে পুলিশ এসেছে, পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে পুলিশকেও গুলি করতে লাগল। লাইসেন্স থাকায় হতে পারে বুকে বল এসেছে তাই পুলিশকেও মানছে না, হাহাহাহা। আসলে অস্ত্রের একটা তাছির থাকেই, সাথে থাকলে দেহে তাক্বৎ এসে যায়। ৬০ বছরি অঙ্গতে ২৫ বছরি রঙ্গ বইতে থাকে, ফলে ধরাকে তখন সরা মনে হয়। যন্ত্র আর মন্ত্র মিলে ঢেউ তুলে কেবল অন্তরে। এখানে মন্ত্র বলতে ক্ষমতাকে বুঝানো হয়েছে। আর যন্ত্র তো বুঝতেই পারছেন, ঠুস। ক্ষমতার পরশে মন থাকে খোশ।
প্রাক্তন চেয়ারম্যান, পদ চলে গেলেও বদ তো রয়ে গেছে, সেই সাথে আছে মেশিন। ফলে মাছের রাজা ইলিশ আর দেশের রাজা পুলিশÑসেই কথাটা ভুলে গেছে। কাজেই যা হবার তা হল, বড় ডেকের ভাত কপালে জুটল। আসলে ক্ষমতা নাকি মানুষকে অন্ধ করে দেয়Ñকথাটা সবাই বলে সেই সাথে বুদ্ধিও লোপ পায়। ইতিহাসে তেমন উদাহরণ প্রচুর আছে, আর এমনই এক হতভাগা হলেন ইখতিয়ার উদ্দিন মহম্মদ বখতিয়ার খলজি, যিনি এইরূপ ঘটনার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এই কথা সত্য বখতিয়ার মহাভাগ্যবান ছিলেন, মাত্র ১৭ জন সৈন্য নিয়ে বাংলার মত একটি শক্তিশালী রাজ্য তিনি জয় করেছিলেন। তার পূর্বে ও পরে বখতিয়ারের প্রচুর সাফল্য রয়েছে। এইভাবে একের পর এক বিজয়ের ফলে ১২০৬ খৃষ্টাব্দে তিনি তিব্বত অভিযানের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন। আর এটাই তাঁর জীবনে কাল হয়ে ছিল। অতি সাফল্য তাঁকে অতি আত্মবিশ^াসী করে তুলে ছিল, ফলে দশ হাজার সৈন্যের বাহিনী নিয়ে তিনি রওনা হলেন। আলী মেচ নামে এক উপজাতি সর্দার তাঁদের পথপ্রদর্শক ছিলেন। আলী মেচকে বখতিয়ার ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন, তিনি বখতিয়ারের অতীব অনুগত ছিলেন। মূলত তিব্বতীরা কোন শক্তিশালী জাতি ছিল না, বখতিয়ারের জন্য তিব্বত বিজয় ছিল তুড়ির ব্যাপার, কিন্তু তার পথটা ছিল অতি দুর্গম।
হিমালয়ান রাজ্য, ফলে বুঝা যায় কি জিনিস। দেবকোট থেকে যখন বখতিয়ার বর্ধনকোট পৌঁছলেন, দেখলেন ভীষণ খর¯্রােতা এক নদী, গঙ্গা থেকে যা ছিল প্রায় চারগুণ প্রশস্ত, নাম বেগমতী। নাম শুনেই তো বুঝা যায় তার কাম কি, হিহিহিহি। বখতিয়ার যেহেতু তুর্কী তাই বেগমতীর অর্থ বুঝেন নি। তিনি যখন কামরূপ এসে পৌঁছলেন, কামরূপরাজ বিনা বাধায় তাঁকে কামরূপের মধ্যদিয়ে সৈন্য নিয়ে যেতে দিলেন। সেই সাথে কামরূপরাজ বখতিয়ারকে পরামর্শ দিলেন, এই সময় তিব্বত আক্রমণ না করে বর্ষা চলে গেলে করতে তাহলে তিনি নিজেও তিব্বত অভিযানে বখতিয়ারকে সহযোগিতা করবেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, ঐ যে বললাম অতি সাফল্য অন্ধ করে দেয়, বখতিয়ারেরও তা হল। তিনি কামরূপরাজের পরামর্শ না ধরে চলে গেলেন অভিযানে। একে তো পাহাড়ি পথ দুর্গম রাস্তা, তারোপর এসে গেল বর্ষা, তারও উপর পাহাড়ি খর¯্রােতা নদী বেগমতী। মরুভূমির ঐ ধবধবে পথের বীর সৈনিক এই অথৈ জলে কি বীরত্ব দেখাবে বলুন। ফলে প্রকৃতির সাথে লড়াইয়ে চরমব্যর্থতা নিয়ে ফিরে আসতে হল বখতিয়ারকে। এই ব্যর্থতা তাঁকে চরমভাবে হতাশ করল, এর ফলে তিনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আর সুযোগ বুঝে একদিন তাঁরই অনুচর আলীমর্দান খলজী তাঁকে চির বিদায় জানালেন।
মৃত্যুকালে বখতিয়ারের বয়স বেশি হয় নি, হতে পারে সর্বোচ্চ চল্লিশ বছর। আরো অনেক কিছু তিনি করতে পারতেন, কিন্তু ঐ যে অতি মুনিত্ব শেষ করল তাঁকে। বস্তুত তিব্বত অভিযান তাঁকে মহাবিপর্যয়ে ফেলেছিল, তাঁর সমস্ত সৈন্য নদীতে ডুবে মরেছে। মাত্র শ’খানেক সৈন্য নিয়ে তিনি কোনক্রমে জান বাঁচিয়ে ফিরেছিলেন। একে তো ব্যর্থতার গøানি, উপরন্তু মৃত সৈনিকদের স্বজনদের তিরস্কার বখতিয়ারের জীবনটা বিষিয়ে তুলেছিল। ফলশ্রæতিতে তিনি হলেন শয্যাশায়ী, আলীমর্দানের হল স্বার্থসিদ্ধি। আসলে বখতিয়ারের জন্য মনটা খারাপ হয়, কিঞ্চিৎ ভুলেরতরে একজন প্রতিশ্রæতিশীল উদ্যমী সেনানায়ক মাঝপথে হারিয়ে গেলেন। তাই পৃথিবীতে অত্যন্ত ভেবেচিন্তে অতি সাবধানে পা ফেলতে হয়, কারণ একটুখানি ভুলের তরে অনেক বিপদ ঘটে। মাত্র ৩/৪ মাসের তর বখতিয়ার সইতে পারলেন না। অথচ কামরূপরাজ কত উত্তম একটি পরামর্শ তাঁকে দিয়েছিলেন, তিনি ধরলেন না। এজন্য বলে, ঠেকে শেখার চাইতে দেখে শেখা উত্তম। কিন্তু ধরা না খাওয়া পর্যন্ত কেউ বুঝে না তার রসম। যেমন বুঝেন নি মন্ত্রী মুরাদ, যিনি হালে টাকলু মুরাদ নামেই সমধিক পরিচিত। হঠাৎ তিনি তারেক রহমানের মেয়েকে নিয়ে বেফাঁস কি সব বলে ফেললেন, অবশ্য তাতে তেমন সমস্যা হয় নি। উত্তম হত যদি সেটাই তাঁর প্রথম ঘটনা হত কিন্তু দেখা গেল সেটা তাঁর নিয়মিত চরিত্রের রুটিন ওয়ার্ক। এখন তারেকও কি আর কোন যেনতেন লোক নাকি? তাঁর রয়েছে এক বিশাল নেটওয়ার্ক।
মুরাদের নিয়মিত চরিত্রের অনেক ওয়ার্ক তারেকের নেটে ধরা পড়ে গেল। তারেকের জাল যখন আছে, তাঁর জেলেরা তো আর বসে থাকবেনা। নেমে পড়ল তারা জাল নিয়ে, যেহেতু মুরাদ তাদের কলিজায় হাত দিয়েছে, ধরা পড়ে গেল এক বোয়ালমাছ। কখন দুইবছর আগে মুরাদের নিয়মিত কাজের অংশ নায়িকা মাহির সাথে ফোনে কথোপকথন দিল ফাঁস করে, হেহেহেহে। মুরাদ কট মন্ত্রী নট। বুঝা গেল ওসব মুরাদের ডিএনএ প্রবলেম, জিন সমস্যা। আরো আগে আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, কিসব আবোলতাবোল কথা বলে ফেললেন, ফলশ্রæতিতে মন্ত্রীত্ব লস্ট। অথচ কাদের সিদ্দিকীর বড়ভাই বলে তাঁকে অতি শ্রদ্ধা করতাম আমি। তার আগে আরো অনেক কথা, কালো বিড়াল, ঘুষ স্পীড মানি, চার হাজার কোটি টাকা কিছুই না, দুই কোটি বহু বেশি। আর আছে মাটির নীচ হতে সন্ত্রাসী ধরবো, কম কম ঘুষ খান, পিলার ধরে টান দেওয়ায় টাওয়ার পড়ে গেছে, ইত্যাদি কত কি। দেখতেছি মন্ত্রীদের কথার কোন ব্যালেন্স নাই, যখন যাই আসে মুখে তা বলে ফেলেন। তারই ধারাবাহিকতায় কিছুদিন আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রী মোমিন সাহেব বললেন, ভারতকে বলেছি এই সরকারকে টিকিয়ে রাখতে হবে। তারপর যখন চারদিকে সমালোচনা শুরু হল, মন্ত্রী কাদের বললেন, সেটি তাঁর কথা, সরকারের কথা না, হাহাহা।
সম্প্রতি জ¦ালানি উপদেষ্টা দিনের বেলায় বিদ্যুৎ বন্ধ রাখতে বললেন। শুনে তো বুক ধুক করে উঠল, শুরু হল এটি নিয়ে আবার চারদিকে সমালোচনা ফলে তথ্যমন্ত্রী বললেন, সেটি তাঁর কথা সরকারের না, দিনের বেলায় বিদ্যুৎ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়নি। শুনে আশ^স্ত হলাম কিন্তু বিশ^স্ত হতে পারলামনা কারণ একেক মন্ত্রী একেক কথা বলেন, কার কথা বিশ^াস করব? এই কথা তো প্রায়ই শুনিÑসে সরকারের কেউ না, এমন কি অনেক সময় এমনও শুনি সে আওয়ামী লীগেরই কেউ না! অনেক নেতাকর্মী যখন আকাম করে ধরা খায়, বলা হয় সে একসময় বিএনপি করত। আর এমন করে নানা মুনি নানা মত হওয়ায় আমরা জনগণ পড়ি ভীষণ ঝামেলায়। কারে ধরি কারে হরি, কারে নিয়ে দেশ গড়ি? প্রকৃতপক্ষে কিছুদিন ধরে বড় চিন্তার মধ্যে আছি মন্ত্রীদের অতি মুনিত্ব তথা অতি পাÐিত্যের কারণে। আসলে পÐিত অর্থাৎ মুনি বর্তমানে অনেক বেড়ে গেছে তাই সমস্যাও বেড়েগেছে। নানা মুনি নানা রাশ অতি মুনি সর্বনাশ, পÐিতি বেশি করলে হিতে বিপরীত হয় তার প্রমাণ গায়িকা এমপি মমতাজ। তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে বলে দিলেন লোডশেডিংকে যাদুঘরে পাঠানো হবে, মাথায় করে বিদ্যুৎ বিক্রয় করতে হবে। কারণ বিদ্যুৎ এত বেশি উৎপাদন হবে, বিদ্যুৎ নেওয়ার মানুষ থাকবে না। আর এখন দেওয়ার জন্যে বিদ্যুৎই নাই, সেই সাথে উপদেষ্টা বলছেন দিনে বিদ্যুৎ ব্যবহার না করতে, হেহেহেহে।
আসলে মুনি এখানে এত বেশি হয়ে গেছে যে, কোন মুনি কখন কি বলেন তার হিসাব নাই। একসময় শুনা গেল খাদ্যোৎপাদন চাহিদার চাইতে বেশি হয়েছে, ফলে চাল রপ্তানি করতে হবে। তার ক’দিন পর খাদ্যমন্ত্রী ভাত কম খেতে বললেন এবং সেই সাথে আরো বলা হল, তেল ছাড়া রান্না, মিষ্টি কুমড়ার বেগুনি, পিঁয়াজ বিনে পিঁয়াজু, ইত্যাদি নানা কথা। এদিকে শুনা যাচ্ছে আবার ২৩ সালে দুর্ভিক্ষের কথা, ঘুরে যায় মাথা। ফলে অধিক সাংসদে সংসদ নষ্টের দশা আরকি। আচ্ছা ঠিক আছে, আমাদের মুনি-ঋষিদের এসব উক্তি না হয় বাজারে চালিয়ে দিলাম। কিন্তু মাথায় করে বিদ্যুৎ বেচা, লোডশেডিংকে যাদুঘরে পাঠানোকে বাজারে কেমনে খাওয়াই? বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান থাকলে কেউ অমন কথা বলতে পারেন না। বখতিয়ার খলজির তিব্বত অভিযান যেরূপ দুর্গম ছিল তার চাইতে অধিক দুরূহ বিদ্যুৎ উৎপাদন। বখতিয়ার তিব্বত বিজয় করতে গেছেন তিব্বত সম্পর্কে না জেনেই। ফলে তিনি চরম ব্যর্থ হয়েছিলেন। বিদ্যুৎ সম্পর্কেও না জেনে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গেলে চরম ব্যর্থ হতে হয়। বখতিয়ার ভেবেছিলেন তিব্বত বাংলার মত সুগম তাই তিনি সঠিক প্রস্তুতি ছাড়াই হাঁটা ধরলেন। আমরাও জেনারেটর দেখে ভাবি বিদ্যুৎ উৎপাদন সুলভ তাই সঠিক প্রস্তুতি ছাড়া উৎপাদনে নেমে পড়ি। বিদ্যুৎ উৎপাদন অত্যন্ত ব্যয়বহুল একটি প্রক্রিয়া, সবচেয়ে বেশিব্যয় হয় তার জ¦ালানিতে। কারণ জেনারেটর যা উৎপাদন করে তার ডবল ভক্ষণ করে অর্থাৎ এক ওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সে দুই ওয়াট জ¦ালানি খায়। তারোপর আছে মেন্টেইনেন্স খরচ, মেরামত খরচ কারণ জেনারেটর ঘন ঘন নষ্ট হয়। সেই সাথে আছে বিতরণ ও সংরক্ষণ খরচ। এসব সঠিক হিসাব না করে উৎপাদনে গেলে ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। বখতিয়ারও সব হিসাব না করে অভিযান পরিচালনা করায় চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন। তিনি যদি রসদ-বসত, বসন-ভূষণ সব পরিমাণ মত নিয়ে অগ্রসর হতেন অবশ্যই সফল হতেন। আমরাও ঠিক তেমন সব হিসাব করে যদি উৎপাদনে যেতাম, আজ এ দুরবস্থা হত না। অতি পÐিতি হেতু খলজী হলেন নাশ, আমরা খাই বাঁশ, হাহাহাহা।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও পরিবেশ বিজ্ঞানী