নাছিমা বাপর ডিমা ; ডিম খাওয়ায় বাংলাদেশ

65

শৈশবে একটি জোক আমরা বেশি পরিমাণে শুনতাম। তা হলো ‘গ-গেরামের আড্ডা শহরত আইয়েনে হইলদে মামলেট’। আমাদের শৈশবে ডিম বেশি পরিমাণে পাওয়া যেত না। গা-গেরামে গৃহস্থরা রুমালে বেধে কিংবা বাঁশের ঝুড়িতে করে ডিম বিক্রি করতে আনত। শহরে অবশ্য ভিন্নরূপ। মুদি দোকানে তারের খাঁচায় ডিম ঝুলিয়ে বিক্রি হতো। তখন প্রায় প্রতি বাড়িতে হাঁস মুরগী পালন করা হতো। পরিবারের চাহিদা তাল দিয়ে মিটানো হতো। তখন অবশ্য চাহিদা ছিল কম। ডিমকে অনেক স্থানে ডিমা, বজা ইত্যাদি নামেও ডাকা হত। শৈশব থেকে আমার ডিমের প্রতি আগ্রহ ছিল প্রচুর। ফলে ভাইবোনদের মাঝে তুলনামূলক আমার ভাগে বেশি ডিম পড়ত। বাড়িতে হাঁস মুরগী থাকায় কখন তার অভাব বোধ করি নি। পরিণত বয়সে এসে লেয়ার মুরগীর খামার গড়ে তুলে ছিলাম। খামার দেখাশোনা করত নাসিমার বাপ। যদি তার আসল নাম ছিল শামছুল আলম। কিন্তু তাঁর মেয়ে বড় হওয়ায় সে মেয়ের নামে পরিচিত হত। এই নাসিমার বাপ খামার থেকে ডিম নিয়ে এসে বলতো, ডিমা আন্নি ডিমা।


এক তথ্যে জানা যায় দেশে ২০১৪ -১৫ সালে প্রায় এককোটি ডিম উৎপন্ন হত। তা ২০১৮-১৯ সালে এসে দাঁড়ায় এককোটি ৭০ লক্ষ। বাংলাদেশিদের খাদ্য তালিকায় ২০০৭-০৮ সালে বছরে গড়ে ৪০টি ডিম খাওয়া হতো। ২০১৮-১৯ সালে এসে তা দাঁড়িয়েছে গড়ে ১০৩ টি। অবশ্য জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী একজন মানুষের খাদ্য তালিকায় বছরে গড়ে ১০৪টি ডিম থাকা আবশ্যক। বাংলাদেশে প্রায় কাছাকাছি অবস্থান। অবাক করা বিষয় আজ থেকে এক যুগ আগে বাংলাদেশের মানুষ গড়ে ৪০টি বেশি ডিম খেতে পারত না। দেশে গত দুই দশকে পোল্ট্রিখাতে এক নীরব বিপ্লব সাধিত হওয়ার ফলে পোল্ট্রিখাতে মাংস উৎপাদন ও ডিম উৎপাদন বহুলাংশে বেড়ে যায়। ফলে ধনী-গরিব নির্বিশেষে খাবারের তালিকায় যে খাদ্য বেশি থাকে তা হচ্ছে ডিম। ডিম রান্না সহজ, খেতে সুস্বাধু ও পুষ্টিকর। একসময় চিকিৎসকগণ ডিম বেশি খেতে নিষেধ করতেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তারা ডিম খেতে উৎসাহ দিচ্ছেন। উন্নত বিশ্বে ডিমখেতে এখন আর নিষেধ করে না। আগেই বলেছি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা একজন মানুষকে ন্যূনতম পুষ্টি চাহিদা পূরণের জন্য খাদ্য তালিকায় বছরে গড়ে ১০৪টি ডিম রাখার সুপারিশ করেছে।
বিগত দুই দশকে দেশে ডিম ও মাংসের উৎপাদন বাড়ানো এবং সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে আনতে এদেশের পোল্ট্রি খামারীদের কম কাটখড় পোহাতে হয় নি। বছর বছর বার্ড ফ্লুর আক্রমণে একের পর এক খামার যেমন বন্ধ হয়ে গেছে, তেমনি অনেক খামারি সর্বস্ব হারিয়ে পথে বসতেও দেখা গেছে। তারপরও এদেশের মেহনতি ও উদ্যোমী তরুণ সমাজ থেমে থাকেনি। তাদের নিরলস পরিশ্রম ও ত্যাগের ফলে আজ মাংস ও ডিম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হলো। তবে ইতিমধ্যে বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে নকল ডিমের গুজব ডালপালা মেলে মানব মনকে গ্রাস করছে। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন নকল ডিম বাস্তবে নেই। এত কিছুর পরও এদেশের পোল্ট্রি শিল্পখাত একযুগ ধরে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে।
আগেই উল্লেখ করেছি কোন এক সময় আমি লেয়ার খামার করেছি ৮০ এর দশকে। লাভ লোকসান যাই করি না কেন একটি বিরল অভিজ্ঞতা অর্জন করি। তা হলো, যে কোন খামার গড়তে হলে বিশেষ করে লাইভস্টক তাহলে মালিককে সরাসরি তার পশুপাখির সাথে যোগাযোগ রাখতে হবে। তাদের চেহারা দেখে বুঝতে হবে তার কী চাহিদা। এক্ষেত্রে বলা যায় যারা নিজেরা তত্ত¡াবধান করেন, তারা দেখতে পেয়েছেন। খামারে কোন কোন মুরগী অস্বাভাবিক আকারের ডিম পাড়ে। এটা যেমন নিজের খামারে দেখেছি। তেমনি একাতার মাস কয়েকের জন্য দেশের একটি বিখ্যাত খামারে কিছু দিন ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকার সময় দেখতে পেলাম খামারে গড়ে ২ শতাংশ মুরগী অস্বাভাবিক আকারে ডিম পেড়ে থাকে। সে সকল ডিমে কখনো কখনো ২ থেকে তিনটি কুসুম থাকে। এক ধরনের ব্যবসায়ী এধরনের অস্বাভাবিক ডিম সংগ্রহন করে চিন থেকে আমদানিকৃত অধিক মূল্যে বিক্রি করতে দেখা যায়। একদল গবেষক দেশের ২৫টি জেলা থেকে প্রায় চার হাজার নমূনা ডিম সংগ্রহ করে গবেষণাগারে পরীক্ষা করেন। গবেষকগণ ২০১৭ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এই গবেষণা কার্যক্রম চলে। উল্লেখ্য যে, তারা সীমান্ত স্থল বন্দর, বিভাগীয় শহর গ্রামে গঞ্জসহ জেলা উপজেলার ছোট-বড় বাজার থেকে এসকল ডিম সংগ্রহ করেন। সুখের বিষয় হলো ঐ সকল ডিমে নকল তো পাওয়া যায় নি। বরঞ্চ পুষ্টিমানের দিক দিয়ে কোন ঘাটতি ছিলো না।
একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, আমাদের দেশের উৎপাদিত ডিমের মান আন্তর্জাতিক মানের কাছাকাছি। তবে ্এ নিয়ে অনেকেরই সন্দেহের অবকাশ আছে। কারণ হিসাবে তারা পোল্ট্রি খামারে নির্বিচারে এন্টিবায়টিক ব্যবহার এবং টেনারীর বর্জ্যসহ নানাবিধ খাদ্য উপাদান ব্যবহার করেন। যা মানব দেহের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। এমতাবস্থায় পোল্ট্রি খামার সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে খামারের পরিবেশ স্বাস্থ্য সম্মত রাখা এবং জৈব খাবার ব্যবহারের গুরুত্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে। এসকল প্যারামিটার যদি সঠিকভাবে রক্ষা করা যায় তবে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ মাংস ও ডিম রপ্তানী করা অসম্ভব নয়। তার জন্য সরকারী ও বেসরকারীভাবে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও পদ্ধতির ব্যবহার বাড়াতে হবে। দেশে যেমন ডিমের চাহিদা বাড়ছে তেমনি বাড়ছে বর্হিবিশ্বে। তাই রপ্তানীর পণ্য বৃদ্ধির জন্য পোল্ট্রিখাত এখন একটি উত্তম ব্যবসা। নানা কারণে দেশের পাট, চামড়া, হিমায়িত চিংড়ি রপ্তানীতে নিম্নগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সরকার ও সংশ্লিষ্টদের এই উল্লেখযোগ্য রপ্তানী মাধ্যম উন্নয়নে দ্রæত পদক্ষেপ নেয়া আবশ্যক। আশা করি, স্বপ্ন দেখি পোল্ট্রিজাত পণ্য রপ্তানী করে দেশ এগিয়ে যাবে।
লেখক : কবি ও নিসর্গিক, প্রাক্তন ব্যাংক নির্বাহী