নলিনীকান্ত ভট্টশালী

11

নলিনীকান্ত ভট্টশালী, ইতিহাসবেত্তা, প্রতœতত্ত¡বিদ, মুদ্রাবিজ্ঞানী, লিপিবিশারদ ও প্রাচীন বিষয়াবলি সম্পর্কে বিখ্যাত পন্ডিত। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতির বহু অস্পষ্টতা অপসারণে তাঁর বিশাল অবদান রয়েছে। মুন্সিগঞ্জ জেলার অন্তর্গত বিক্রমপুরের এক শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান ব্রাহ্মণ পরিবারে ১৮৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯২২ সালে এম.এ ডিগ্রি লাভ করার পর তিনি ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ এ যোগদান করেন। সেখানে অবস্থানকালে জেলার বিভিন্ন এলাকার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ঘটে। সারাজীবন তিনি এ সব এলাকার ইতিহাস ও প্রতœতত্ত¡ সম্পর্কে গভীর আগ্রহী ছিলেন এবং এর বিস্মৃত অতীত সম্পর্কে তথ্য আহরণ ও অনুসন্ধানের জন্য এখানে ক্লান্তিহীনভাবে ভ্রমণ করেন।
১৯১৪ সালে তিনি সদ্যপ্রতিষ্ঠিত ঢাকা জাদুঘর এর তত্ত¡াবধায়ক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৪৭ সালের ৬ ফেব্রæয়ারি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত প্রায় ৩৩ বছর তিনি এ দায়িত্ব পালন করেছিলেন। জাদুঘরের চৌহদ্দির মধ্যেই কেটেছে তাঁর সারা জীবন। অসাধারণ নিষ্ঠা ও কর্মশক্তি বলে তিনি এ নগণ্য প্রাদেশিক সংগ্রহশালাকে এক সর্বভারতীয় খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করেছিলেন। এর গঠনমূলক পর্যায়ে ঢাকা জাদুঘর ও ভট্টশালী ছিলেন অবিচ্ছেদ্য। এর বিকাশ ও উন্নয়নের জন্য ভট্টশালীর ব্যক্তিগত তত্ত¡াবধান ও মনোযোগ ছিল অপরিহার্য। তিনি গ্রামাঞ্চলের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত অবিরাম ঘুরে বেড়িয়েছেন। এ ভ্রমণকালে তিনি অনুসন্ধান ও আবিষ্কার করেছেন, ছবি তুলেছেন এবং বিভিন্ন সামগ্রী ও তথ্য সংগ্রহ করেছেন। এ সময় তিনি খনন কাজ ও প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য স্থানীয়দের মনে আগ্রহ ও সচেতনতা সৃষ্টি করেছেন।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বহু বছর আগেই তার প্রচেষ্টায় ঢাকা জাদুঘর ইতিহাস পাঠ ও গবেষণার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। প্রাচীন বাংলার ইতিহাস ও কালানুক্রম নির্ধারণে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রীর অবদান সম্পর্কে তিনি প্রতিবেদন এবং গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। বিদ্বজ্জনোচিত কার্যক্রম আয়োজনে আর্থিক অসুবিধা এবং নিজের স্বল্প ও অনিশ্চিত বেতনের কারণে তার ব্যক্তিগত সমস্যা থাকা সত্তে¡ও ভট্টশালী কখনও জাদুঘর ছেড়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করেন নি। এ প্রতিষ্ঠানের প্রতি প্রবল আবেগপূর্ণ এক ভালবাসা তাঁর উৎসাহকে আমরণ টিকিয়ে রেখেছিল।
জাদুঘরে যোগদান করার আগেও তিনি বাংলার ইতিহাস ও প্রতœতত্ত¡ সম্পর্কে মৌলিক ও গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। কালক্রমে এসব ক্ষেত্রে তাঁর লেখালেখির পরিমাণ, পরিসর ও মান বৃদ্ধি পেয়েছিল।
তবে ভট্টশালী কখনোই কেবল প্রাক্-মুসলিম আমলে তাঁর গবেষণাকে সীমাবদ্ধ রাখেন নি। জাদুঘরের সংগ্রহে রক্ষিত মুসলমান আমলের মুদ্রাগুলি তিনি অত্যন্ত সতর্কতা ও অধ্যবসায়ের সঙ্গে পরীক্ষা করে দেখেন এবং যথাসময়ে মুসলিম মুদ্রাবিদ্যা সম্পর্কে একজন স্বীকৃত ও দক্ষ পন্ডিত রূপে পরিচিতি লাভ করেন। এ সব মুদ্রা-সাক্ষ্যের ভিত্তিতে তিনি প্রাক্-মুগল আমলের বাংলার মুসলমান শাসকদের প্রথম বিজ্ঞানভিত্তিক বিবরণ ঈড়রহং ধহফ ঈযৎড়হড়ষড়মু ড়ভ ঃযব ঊধৎষু ওহফবঢ়বহফবহঃ ঝঁষঃধহং ড়ভ ইবহমধষ (১৯২২ সালে কেম্ব্রিজ থেকে প্রকাশিত) রচনা করেছিলেন, যা এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তাঁর রচিত ঢাকা জাদুঘরের মুদ্রার সুবিন্যস্ত তালিকা দুটি (১৯৩৬ সালে প্রকাশিত) সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তাঁর অবিরাম আগ্রহের সাক্ষ্য বহন করে। বেঙ্গল পাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্ট (ইবহমধষ চধংঃ অহফ চৎবংবহঃ) গ্রন্থে প্রকাশিত (৩৫, ৩৬ ও ৩৮তম খন্ড, ১৯১৮-২৯) তাঁর ‘ইবহমধষ ঈযরবভং ঝঃৎঁমমষব ভড়ৎ ওহফবঢ়বহফবহপব রহ ঃযব জবরমহং ড়ভ অশনধৎ ধহফ ঔধযধহমরৎ’ শীর্ষক দীর্ঘ প্রবন্ধ বাংলার বারো ভূঁইয়ার ইতিহাসের নতুন ক্ষেত্র উন্মোচন করেছে।
অবশ্য ভট্টশালীর বিশিষ্ট অবদান ছিল তখন পর্যন্ত স্বল্প জ্ঞাত ও স্বল্পতর পর্যবেক্ষিত হিন্দু ও বৌদ্ধ মূর্তি বিদ্যার ক্ষেত্রে। গবেষণার এ ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অগ্রপথিক। জাদুঘরের জন্য ভাস্কর্য সংগ্রহ ও সেগুলির বিশদীকরণে তাঁর প্রচেষ্টার ফলে এসব মূর্তির গুরুত্ব ও পরিচয় সম্পর্কে তিনি প্রায় ইন্দ্রিয়াতীত জ্ঞান অর্জন করেছিলেন, যা ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধসহ বিভিন্ন ধর্মীয় স¤প্রদায়ের প্রাচীন গ্রন্থের অনুপুঙ্খ ও ব্যাপক পাঠের দ্বারা আরও জোরদার হয়েছিল। কীর্তিস্তম্ভতুল্য গ্রন্থ ওপড়হড়মৎধঢ়যু ড়ভ ইঁফফযরংঃ ধহফ ইৎধযসধহরপধষ ঝপঁষঢ়ঃঁৎবং রহ ঃযব উধপপধ গঁংবঁস (১৯২৯)-এর প্রকাশ ছিল এ ক্ষেত্রে তাঁর প্রচেষ্টার ফসল। অত্যন্ত সীমিত সাধ্য সত্তে¡বও শুধু জাদুঘর সামগ্রী ও মূর্তি সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যেই নয়, প্রাচীন শিলালিপিসমূহে উল্লিখিত স্থানের নাম-পরিচয় ও বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্য নিশ্চিতকরণের উদ্দেশ্যেও তিনি বাংলার দুর্গম অঞ্চলগুলিতে ভ্রমণের শ্রমসাধ্য প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। এরকম অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলেই তিনি মধ্য বঙ্গে কোটালিপাড়া, সাভার, রামপাল, বজ্রযোগিনী, সমতটে দেউলবাড়ি, বড়কামতা, ভারেল্লা, বিহারমন্ডল, লালমাই, ময়নামতী এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ আরও বহু স্থানকে পন্ডিতদের কাছে পরিচিত করে তুলেছিলেন।
সাহিত্যকর্মের জন্য তেমন সুপরিচিত না হলেও ভট্টশালী বাংলা সাহিত্য সম্পর্কেও কয়েকটি বই লিখেছিলেন। তাঁর ছোট গল্প সংকলন হাসি ও অশ্রæ প্রকাশিত হয় ১৯১৫ সালে। তাঁর সম্পাদিত আব্দুর শুকুর মুহম্মদের গোপীচাঁদের সন্ন্যাস-এর একটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ১৩২২ বঙ্গাব্দে। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যেও তাঁর আগ্রহ ছিল। প্রাচীন বাংলা হস্তলিপি বিজ্ঞানে তিনি একজন বিশেষজ্ঞ রূপে গণ্য হতেন। প্রধানত তাঁর প্রচেষ্টায়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ও সংস্কৃত পান্ডুলিপি সংগ্রহের জন্য একটি কেন্দ্র সৃষ্টি করা হয়েছিল। তাঁর কাজের জন্য তিনি বেশ কয়েকটি পুরস্কারে ভূষিত হন। তিনি বহু বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য, প্রাচীন হস্তলিপিবিজ্ঞান ও ইতিহাস পড়িয়েছেন।
ভট্টশালী ছিলেন এক নির্ভীকচিত্ত তার্কিক এবং তাঁর শক্তিশালী লেখনী মাঝে মাঝে বেদনাদায়ক হয়ে উঠত। বিজ্ঞান ও যুক্তি দ্বারা সমর্থনযোগ্য বলে মনে হলে তাঁর উপনীত কোনও সিদ্ধান্ত থেকেই ভট্টশালী কখনও একটুও নড়তেন না। অনমনীয় ব্যক্তিত্ব ও স্বাতন্ত্র্যের চেতনা ছিল তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। ইতিহাস, প্রতœতত্ত¡, লিপিবিদ্যা, মুদ্রাবিজ্ঞান ও শিল্পকলা সম্পর্কে তিনি ইংরেজি ও বাংলা, উভয় ভাষায়ই ব্যাপকভাবে লেখালেখি করেছিলেন। তাঁর গবেষণামূলক প্রবন্ধগুলি সমকালীন দেশী ও বিদেশী প্রধান সাময়িকীগুলিতে প্রকাশিত হয়েছে। সূত্র : বাংলাপিডিয়া