নলিনীকান্ত ভট্টশালী

5

 

 

ইতিহাসবেত্তা, প্রত্নতত্ত্ববিদ, মুদ্রাবিজ্ঞানী, লিপিবিশারদ ও প্রাচীন বিষয়াবলি সম্পর্কে বিখ্যাত পন্ডিত। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতির বহু অস্পষ্টতা অপসারণে তাঁর বিশাল অবদান রয়েছে। মুন্সিগঞ্জ জেলার অন্তর্গত বিক্রমপুরের এক শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান ব্রাহ্মণ পরিবারে ১৮৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯২২ সালে এম.এ ডিগ্রি লাভ করার পর তিনি ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে কুমিল­া ভিক্টোরিয়া কলেজ এ যোগদান করেন। সেখানে অবস্থানকালে জেলার বিভিন্ন এলাকার সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ঘটে। সারাজীবন তিনি এ সব এলাকার ইতিহাস ও প্রতœতত্ত¡ সম্পর্কে গভীর আগ্রহী ছিলেন এবং এর বিস্মৃত অতীত সম্পর্কে তথ্য আহরণ ও অনুসন্ধানের জন্য এখানে ক্লান্তিহীনভাবে ভ্রমণ করেন। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বহু বছর আগেই তার প্রচেষ্টায় ঢাকা জাদুঘর ইতিহাস পাঠ ও গবেষণার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। প্রাচীন বাংলার ইতিহাস ও কালানুক্রম নির্ধারণে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রীর অবদান সম্পর্কে তিনি প্রতিবেদন এবং গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। বিদ্বজ্জনোচিত কার্যক্রম আয়োজনে আর্থিক অসুবিধা এবং নিজের স্বল্প ও অনিশ্চিত বেতনের কারণে তার ব্যক্তিগত সমস্যা থাকা সত্ত্বেও ভট্টশালী কখনও জাদুঘর ছেড়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করেন নি। এ প্রতিষ্ঠানের প্রতি প্রবল আবেগপূর্ণ এক ভালবাসা তাঁর উৎসাহকে আমরণ টিকিয়ে রেখেছিল। জাদুঘরে যোগদান করার আগেও তিনি বাংলার ইতিহাস ও প্রতœতত্ত¡ সম্পর্কে মৌলিক ও গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন। কালক্রমে এসব ক্ষেত্রে তাঁর লেখালেখির পরিমাণ, পরিসর ও মান বৃদ্ধি পেয়েছিল। এটা স্পষ্ট করে বলা দরকার যে, তাঁর সময় পর্যন্ত বাংলা (বিশেষ করে এর পূর্বাংশ) সর্বভারতীয় খ্যাতিসম্পন্ন ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতত্ত্ববিদদের অত্যল্প মনোযোগই আকর্ষণ করেছিল। কাজেই এসব ক্ষেত্রে গবেষণায় ভট্টশালীকে যথার্থই পথপ্রদর্শক রূপে গণ্য করা হয়।
অবশ্য ভট্টশালীর বিশিষ্ট অবদান ছিল তখন পর্যন্ত স্বল্প জ্ঞাত ও স্বল্পতর পর্যবেক্ষিত হিন্দু ও বৌদ্ধ মূর্তি বিদ্যার ক্ষেত্রে। গবেষণার এ ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অগ্রপথিক। জাদুঘরের জন্য ভাস্কর্য সংগ্রহ ও সেগুলির বিশদীকরণে তাঁর প্রচেষ্টার ফলে এসব মূর্তির গুরুত্ব ও পরিচয় সম্পর্কে তিনি প্রায় ইন্দ্রিয়াতীত জ্ঞান অর্জন করেছিলেন, যা ব্রাহ্মণ্য ও বৌদ্ধসহ বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রাচীন গ্রন্থের অনুপুঙ্খ ও ব্যাপক পাঠের দ্বারা আরও জোরদার হয়েছিল। কীর্তিস্তম্ভতুল্য গ্রন্থ Iconography of Buddhist and Brahmanical Sculptures in the Dacca Museum (১৯২৯)-এর প্রকাশ ছিল এ ক্ষেত্রে তাঁর প্রচেষ্টার ফসল। অত্যন্ত সীমিত সাধ্য সত্ত্বেবও শুধু জাদুঘর সামগ্রী ও মূর্তি সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যেই নয়, প্রাচীন শিলালিপিসমূহে উল্লিখিত স্থানের নাম-পরিচয় ও বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্য নিশ্চিতকরণের উদ্দেশ্যেও তিনি বাংলার দুর্গম অঞ্চলগুলিতে ভ্রমণের শ্রমসাধ্য প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। এরকম অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলেই তিনি মধ্য বঙ্গে কোটালিপাড়া, সাভার, রামপাল, বজ্রযোগিনী, সমতটে দেউলবাড়ি, বড়কামতা, ভারেল­া, বিহারমন্ডল, লালমাই, ময়নামতী এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ আরও বহু স্থানকে পন্ডিতদের কাছে পরিচিত করে তুলেছিলেন।
সাহিত্যকর্মের জন্য তেমন সুপরিচিত না হলেও ভট্টশালী বাংলা সাহিত্য সম্পর্কেও কয়েকটি বই লিখেছিলেন। তাঁর ছোট গল্প সংকলন হাসি ও অশ্রু প্রকাশিত হয় ১৯১৫ সালে। তাঁর সম্পাদিত আব্দুর শুকুর মুহম্মদের গোপীচাঁদের সন্ন্যাস-এর একটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল ১৩২২ বঙ্গাব্দে। প্রাচীন বাংলা সাহিত্যেও তাঁর আগ্রহ ছিল। প্রাচীন বাংলা হস্তলিপি বিজ্ঞানে তিনি একজন বিশেষজ্ঞ রূপে গণ্য হতেন। প্রধানত তাঁর প্রচেষ্টায়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ও সংস্কৃত পান্ডুলিপি সংগ্রহের জন্য একটি কেন্দ্র সৃষ্টি করা হয়েছিল। তাঁর কাজের জন্য তিনি বেশ কয়েকটি পুরস্কারে ভূষিত হন। তিনি বহু বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্য, প্রাচীন হস্তলিপিবিজ্ঞান ও ইতিহাস পড়িয়েছেন।
ভট্টশালী ছিলেন এক নির্ভীকচিত্ত তার্কিক এবং তাঁর শক্তিশালী লেখনী মাঝে মাঝে বেদনাদায়ক হয়ে উঠত। বিজ্ঞান ও যুক্তি দ্বারা সমর্থনযোগ্য বলে মনে হলে তাঁর উপনীত কোনও সিদ্ধান্ত থেকেই ভট্টশালী কখনও একটুও নড়তেন না। অনমনীয় ব্যক্তিত্ব ও স্বাতন্ত্র্যের চেতনা ছিল তাঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, লিপিবিদ্যা, মুদ্রাবিজ্ঞান ও শিল্পকলা সম্পর্কে তিনি ইংরেজি ও বাংলা, উভয় ভাষায়ই ব্যাপকভাবে লেখালেখি করেছিলেন। তাঁর গবেষণামূলক প্রবন্ধগুলি সমকালীন দেশী ও বিদেশী প্রধান সাময়িকীগুলিতে প্রকাশিত হয়েছে। সূত্র: বাংলাপিডিয়া