নমুনাজটে বাড়ছে সংক্রমণের শঙ্কা

90

চট্টগ্রাম বিভাগের প্রায় ৩ কোটি মানুষের করোনা শনাক্তের একমাত্র ভরসা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফকশাস ডিজিজ (বিআইটিআইডি)। এ ল্যাবের সক্ষমতার চেয়ে নমুনা কালেকশন বেশি আসায় প্রতিদিন তৈরি হচ্ছে নমুনার স্ত‚প। দিনে মফস্বল এলাকা থেকে যে পরিমাণ নমুনা আসছে তার এক তৃতীয়াংশ নমুনার পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে। এইভাবে দিনদিন নমুনাজট বাড়ার কারণে সংক্রমণের আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, নমুনা জট কমাতে এবং বেশি বেশি টেস্ট করতে হলে আগে কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিসিআর মেশিন রয়েছে, তা শনাক্ত করতে হবে। একইসাথে দক্ষ ভলান্টিয়ার খুঁজে বের করতে হবে। এই দুইটি বিষয়ের সাথে সমন্বয় করা না গেলে বেশি বেশি স্যাম্পল কালেকশন করেও দ্রæত সময়ের মধ্যে রিপোর্ট পাওয়া সম্ভব হবে না। এছাড়া স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। আর প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে স্যাম্পল বুথ বসানো মাধ্যমে বেশি বেশি নমুনা কালেকশন করে পরীক্ষা করতে হবে।
এদিকে চট্টগ্রামের ফৌজদারহাট এলাকায় অবস্থিত বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেস (বিআইটিআইডি) ও সিভাসু ল্যাবে করোনা ভাইরাস শনাক্তে প্রতিদিন গড়ে ২০০ থেকে ২২০টি নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে। চট্টগ্রামসহ নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষীপুর, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির থেকে প্রতিদিন সাড়ে ৩০০ টির অধিক নমুনা আসছে বিআইটিআইডি ল্যাবে। এতে নমুনা জট সৃষ্টি হওয়ায় পাঁচ বা ছয় দিন আগে সংগ্রহ করা নমুনা পরীক্ষা করে রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে। একইভাবে পাঁচ ছয়দিন আগের নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট কতোটা সঠিত তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।
করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় গঠিত কমিটির চট্টগ্রাম বিভাগের সমন্বয়ক ডা. আ ন ম মিনহাজুর রহমান বলেন, নমুনা নেওয়া সন্দেহভাজন ব্যক্তি কনফার্ম না হওয়াতে যততত্র ঘুরাফিরা করছে। ওই ব্যক্তিকে কোয়ারেন্টাইন কিংবা আইসোলেশনে রাখা হচ্ছে না। ভর্তি হচ্ছে না কোনো হাসপাতালে।
এর ফলে সেই ব্যক্তি আরও অনেক ব্যক্তিকে আক্রান্ত করে ফেলছে। এতে অন্যরা সংক্রামণের সম্ভাবনা অনেক বেশি। যেমন, জেনারেল হাসপাতালে নমুনা দেয়ার পর বসে আছে ৬ দিন। দেখা যাচ্ছে ১৪ দিন পার হয়ে যাওয়ার পর নমনুার থার্ড স্যাম্পল নেগেটিভ না আসায় হাসপাতাল থেকে যেতে পারছে না। যদি নমুনা দ্রæত পাওয়া যেত তাহলে রোগীদের দ্রুত ডিসচার্জ করা সম্ভব হতো। নমুনা জটের কারণে রোগীদের রিলিজ করা যাচ্ছে না। এতে নমুনা জটের ফলে যেভাবে জেনারেল হাসপাতালে রোগী বাড়ছে সে ভাবে বাড়তে থাকলে ভবিষ্যতে আরও ক্ষতির দিকে যাবে। নমনুা জটের কারণে সংক্রমণ এড়াতে সবার সচেতনতা জরুরি।
প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলেন, যারা নমুনা কালেকশন করছে তারা সন্দেহজনক ব্যক্তির কাছ থেকে সঠিকভাবে নিচ্ছে কিনা। আর যে মিডিয়ার মাধ্যমে নমুনা শহরে নিয়ে আসা হচ্ছে তা ঠিকভাবে নিয়ে আসা হচ্ছে কিনা। এই দুইটি বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থেকে যায়। এছাড়া বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৪০৭০ টি নমুনা পরীক্ষা করে ১১৮৬টি পেজটিভ পাওয়া যায়। বাংলাদেশে যা করোনার নমুনা রিজেক্ট হয়েছে তৎমধ্যে ২০ শতাংশ রিজেক্ট করেছে তারা। যতদ্রুত পরীক্ষা করা যায় তত ভালো রেজাল্ট আসে। সেখানে খুবদ্রুত পরীক্ষা করা হচ্ছে। নমুনা নেয়ার ২৪ ঘন্টার মধ্যে রেজাল্ট দেওয়ায় ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে সেখানে।
বিআইটিআইডিতে নমুনা জট নিরসনে কয়েকটি পরামর্শের কথা জানান তিনি, তা হলো- দুই শিফটে কাজ করা যেতে পারে। চবিতে পরীক্ষা চালু করতে হবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে চমেকে পরীক্ষা চালু করতে হবে। এছাড়া বেসরকারি হাসপাতাল যেমন সিএসসিআর, এপিক হেলথ কেয়ার, শেভরণ এবং ইমপেরিয়াল হাসপাতালে চালু করা যেতে পারে।
বিআইটিআইডির ল্যাবের প্রধান ও বায়োকেমিস্ট ডা. শাকিল আহমেদ, বিআ্ইটিআইডির ল্যাবে বর্তমানে ১২০০ মত নমুনা জমা আছে। দুইটি মেশিনে প্রতিদিন গড়ে ১২০ টি নমুনা পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে। সিভাসুতে দিনে ৭০ থেকে ৮০টি নমুনা পাঠানো হচ্ছে। এই দুইটি ল্যাবে প্রতিদিন গড়ে ২০০ থেকে ২২০টি নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে। কিন্তু বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রতিদিন নমুনা কালেকশন আসছে সাড়ে ৩০০টির অধিক। এতে ল্যাবের সক্ষমতার চেয়ে নমুনা কালেকশন বেশি হওয়ায় প্রতিদিন নমুনা জমে যাচ্ছে।
২৪ ঘন্টা কিংবা ৪৮ ঘন্টার মধ্যে নমুনার পরীক্ষা না হওয়ার ফলে নমুনার কার্যকারিতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নমুনা মাইনাস ২০ ডিগ্রিতে রেখে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। না রেখে উপায় তো নেই। নমুনার নষ্ট হওয়ার বিষয়টি এখনো প্রমাণিত না। তবে আমরা ভালো রেজাল্ট পাচ্ছি।
নমুনা রিজেক্ট হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, প্রথম দিকে অনেক বেশি ছিল। এখন অনেক কমে গেছে। বলতে গেলে ১ থেকে ২ শতাংশ ত্রূটিপূর্ণ নমুনা পাওয়া যাচ্ছে। আর নমুনাজটের ফলে সংক্রামণের ধারণাটি ভুল। নমুনা পরীক্ষা কিংবা রেজাল্টের সাথে হোম কোয়ারেন্টাইন কিংবা আইসোলেশনের কোনো সম্পর্ক নেই। যেহেতু লকডাউন, হোম কোয়ারেন্টাইন আর আইসোলেশন তো আগেই হচ্ছে। এছাড়া কেউ যদি মনে করেন করোনা আক্রান্ত হইছে, টেস্ট করা দরকার। স্যাম্পল নেয়া হোক বা না হোক তিনি ঘর থেকে বের হবেন কেন? যতদিন নিশ্চিত না হবেন ততদিন ঘর থেকে বের হবেন না। ১৪ দিন পর্যন্ত বাসায় অবস্থান করবেন। তিনি যদি এসব নিয়মকানুন না মানে তাইলে তো পুলিশ পাহারায় তাকে ঘরে রাখা সম্ভব না।
ল্যাবের সক্ষমতা নিয়ে ডা. শাকিল বলেন, জনবল অনেক কম। এতো বেশি কাজ করার মত জনবল বলতে গেলে একদম নেই। আমি নিজেই ১৬ ঘণ্টা ডিউটি করছি।
এ সংকট নিরসনে করণীয় বিষয়ে তিনি বলেন, প্রথমে লজিস্টিক সাপোর্ট লাগবে, যে পরিমাণ নমুনা আসছে, সে পরিমাণ জনবল নেই। তাই জনবল বাড়াতে হবে। বিকল্প ল্যাব বাছাঁই করতে হবে। নমুনা সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে আরও যত্নশীল হতে হবে।
তবে ইতোমধ্য আমরা শেভরণের কথা উল্লেখ করেছি। সরকার চাইলে শুরু করা সম্ভব। এছাড়া অতিদ্রæত সময়ের মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে নমুনা পরীক্ষা শুরু করা উচিত।
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. আবদুর রব বলেন, নমুনা জটের ফলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রিপোর্ট না আসায় সন্দেহভাজন ব্যক্তি যততত্র চলাচলের কারণে অন্যরা সংক্রামণের আশঙ্কা বাড়ছে। সাধারণ রোগীরা দ্রুত চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। নমুনা নেয়ার পর রিপোর্ট পেতে ৬ থেকে ৭ দিন লেগে যাচ্ছে। এতে করে রোগীদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত হাসপাতাল থেকে রোগীকে ডিসচার্জ করা যাচ্ছে না। এর ফলে জেনারেল হাসপাতালে দিন দিন রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বলতে গেলে নমুনাজটের কারণে সবদিক থেকে চাপ সৃষ্টি হচ্ছে।
সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি বলেন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে নমুনা পরীক্ষা চালু হলে আমাদের এখানে নমুনা জট কমবে। এছাড়া নোয়াখালীতে নমুনা পরীক্ষা তাড়াতাড়ি চালু হচ্ছে। তখন চট্টগ্রামে আরও নমুনা জট কমবে।