নব্বই দশকের উজ্জ্বল কবি খৈয়াম কাদের

91

মুহাম্মদ ইয়াকুব
গেল শতাব্দীর শেষ দশকের উজ্জ্বল কবিদের মধ্যে খৈয়াম কাদের অন্যতম।তাঁর কবিতা চয়ন-বচন, উপমা-উৎপ্রেক্ষা, রূপক-প্রতীকে অনন্য। যমুনার কূলে জন্ম এবং বেড়ে উঠার কারণে নদীজীবনে ভাঙা-গড়ার খেলা, জেগে উঠা চরের মসৃণ বুক আর স্রোতস্বিনী যমুনার ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ খৈয়াম কাদেরের কবিত্বকে দারুণভাবে আন্দোলিত করে এবং নদীকেন্দ্রীক জনজীবন তাঁর কবিমনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। কবির চিত্রকল্পে তিনি নিঁপুন দক্ষতায় এঁকেছেন এদেশের নদ-নদী, পরিবেশ, ভাটি অঞ্চলের জনজীবন, নারী-জীবন, প্রেম-বিরহ, সমকাল, ইতিহাস ও ঐতিহ্য।তিনি সময়কে ধারণ করার পাশাপাশি অতীতকে ধারণ করেছেন, এঁকেছেন অনাগত স্বপ্নচিত্র। ত্রিকালের কবিখৈয়াম কাদেরের কবিতা আধুনিক রোমান্টিসিজমে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। ‘কবির সৃজনবেদনা’গ্রন্থে নব্বই এর কবিদের নিয়ে লেখা প্রবন্ধে আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রধান কবি আল মাহমুদকবিপ্রতিভা খৈয়াম কাদেরকে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করেছেন।
কবি খৈয়াম কাদের ২০ নভেম্বর ১৯৬৩ সালে বগুড়া জেলার সারিয়াকান্দি উপজেলার মানিকদাইর গ্রামে প্রতিথযশা এক সাংস্কৃতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তরডিগ্রি সম্পন্ন করে বিসিএস (শিক্ষা) ক্যাডারে উত্তীর্ণ হয়ে প্রভাষক (ইংরেজি সাহিত্য) হিসেবে যোগদান করেন বগুড়া সরকারি আজিজুল হক বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে। পরবর্তীতে বিভিন্ন সরকারি কলেজে প্রভাষক, সহকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক এবং অধ্যাপক হিশেবে সুনামের সাথে পাঠদান করেন। ইতঃপুর্বে তিনি সিরাজগঞ্জ কাজীপুর সরকারি মনসুর আলী কলেজে অধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত হয়ে প্রশাসনিক দক্ষতার পরিচয় দেন। বর্তমানে তিনি সরকারি আজিজুল হক বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে উপাধ্যক্ষ পদে কর্মরত আছেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ থেকেই লেখালেখির স‚চনা হলেও তিনি কবি হিশেবে খ্যাতি অর্জন করেন নব্বই এর দশকে। প্রাবন্ধিক হিশেবেও তিনি সমান পরিচিতি পেয়েছেন। তাঁর কবিতার উপাদানে প্রাধান্য পেয়েছে লোকজ শব্দ ও আচার, নদী ও নারী, নদীকেন্দ্রীক জনজীবন, স্বাধীনতা, সমকালীন দেশ ও রাজনীতি এবং মানবিক মূল্যবোধ।
প্লেটো নিজে কবি হয়েও তাঁর আদর্শ নগররাষ্ট্র থেকে কবিদের বের করে দেবার বাসনা ব্যক্ত করলেও খৈয়াম কাদের এমন নরকরাষ্ট্র ধারণার ঘোর বিরোধী। কবিহীন সমাজ তিনি কল্পনাই করতে পারেন না। তাঁর চিন্তা-চেতনায় কবিসত্তা প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানকে উপজীব্য করে মানুষের জয়গান করে। ভাবের জগতে কবি সৃষ্টি করেন অজস্র রহস্য-অভিধান। কবি খৈয়াম কাদের কবিসত্তাকে গভীরভাবে পাঠ করার আহŸান জানিয়ে লিখেছেন, ‘কবির কৃত্যকে তোমার সত্তায় ডাকো/চিন্তার কোদালে কাটো/আন্তোৎসারিত সংবিৎ তার/প্রকৃতের গন্ধ চেখে নাও/মেখে নাও বুকে তার/জারক সুবাস/দেখবে কবিরা কুমোরের মতো/অবিরত নির্মান করে বহুপাঠ্য গণিতের/আদি অভিধান:/অনধিত আঁধারের/আলপথ্ ঘুরে/মাটির পরতে লেখে মানুষের গান’(লাঙলের খেয়া ভাঙ্গে জীবনের গতি-২০১১)। কবিরাই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। কবির কবিতায় চাষ হয় সবুজের, বর্ণের সাথে বর্ণ জুড়ে কবি তৈরী করেন মাতৃভূমি।অসম সমাজে কবির কবিতায় প্রেমও দ্রোহ হয়ে ওঠে। কবিহীন জনপদ নিষ্ঠুর জনপদ; প্রেমহীন, নারীহীন, নদীহীন বিরানভূমি। প্লেটোর রাষ্ট্রধারণার সাথে দ্বিমু পোষণ করে কবি খৈয়াম কাদের কবিহীন জনপদের চিত্র অংকন করেছেন এভাবে,‘কবিহীন নগর শুধুই নিষ্ফলা ঊষর ভূমি;/সেখানে থাকে না কোনো ফলদ বৃক্ষের ছায়া/সেখানে থাকে না কোনো/ফুল ফল কিশলয় আর/সবুজ সোনালি/ফসলের মায়া’(শেরোয়ানী মাঠ-২০১৭)।
খৈয়াম কাদের রাজনীতি না করলেও তাঁর কবিতা রাজনীতি সচেতন, দেশপ্রেমে আপোষহীন। তাঁর কবিসত্তা মেনে নিতে পারে না মাতৃভূমির উপর শকুনের কালো থাবা। এই সবুজ জনপদেযুগে যুগে দুঃখিনী মায়ের সম্ভ্রম লুটে দুর্বৃত্তরা। হায়েনার কালো থাবা পিষে মারে প্রতিবাদী কণ্ঠ। স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর লাখো মানুষের রক্তনদীর বিরামহীন স্্েরাতে ভেসে আসা দেশের মাটি বিক্রি করে সস্তা দামে। বিবর্ণ সময়ের পৃষ্ঠে চড়ে নির্মম বাস্তবতার অসহ্য যাতনায় কবির কলমে লিখিত হয়, ’অথচ এখন শকুন শাসিয়ে চলে/জল মাটি ক্ষেত, আমরা বুঝি না আর/কোন ঘরে আলো, কোন পথে খোয়া গেলো/স্বোপার্জিত সত্যের আদি সংবেদন’ (পারদ বিশ্বাস-২০০০)। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রবাস্তবতা বড়ই বেসুরো। চিরসংগ্রামী একটি জাতি বারবার পরিচয়হীনতায় ভুগে। ধ্বস নামে জাতির বিবেকে, রাষ্ট্রের স্তম্ভে। ধ্বসের নগরে দাঁড়িয়ে কবি শোনালেন জীবন্ত সময়ের গান, ‘চিৎ বৈকল্যের এই ধূসর নগর এখন ধ্বসের/নগর, নিষ্প্রেম বধ্যভূমি/এখানে নিষিদ্ধ এখন পাখির/বায়াতওবয়াতির গান/এখানে প্রসিদ্ধ এখন উন্মাদ/উজিরের প্রমাদ বয়ান।’ এই ধ্বসের নগরে মানুষ খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। দূর হয়েছে যাবতীয় মানবীয় গুণাবলী।এই সমাজের সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো – মানুষ মানুষকে হজম করছে, ‘ধ্বস নেমেছে এখন চেনা দিগন্তের সবক’টা চরে/ধ্বস নেমেছে এখন উঠোন আঙ্গিনা এবং চেতনার ঘরে/কোথায় দাঁড়াবে এখন মানুষ বলো/কোথায় খুঁজবে এখন মানব স্বজন/যেখানে মানুষ হয়েছে মানুষের যম/মানুষই করছে এখন/মানুষ হজম (শেরোয়ানী মাঠ-২০১৭)।কবির কবিতায় ভেঙে পড়ে অবরুদ্ধ সময়। মুক্তির ইশতেহার ঘোষিত হয় কবিতায়। অচলায়তন ভেঙে সুনামীর উৎসব ডেকে কবির উচ্চারণ, ‘রাতের আঁধারে আমি/নিদ্রা ভাঙ্গাবোই তার/তোমাকে চাঁদের দামে নীলাম্বরী দেবো/শাড়ীর আঁচলে দেবো একখÐ মুক্ত মাটি/এতো সেই বেগলঘপুর: বারো ভূঞাদের উত্তর জনম/সহস্র বছর তার আমরাই জ্ঞাতি’ (লাঙ্গলের খেয়া ভাঙ্গে জীবনের গতি-২০১১)।
কবিসত্তাকে বঞ্চিত করার প্রবণতা নতুন নয়। প্রাচীনকাল থেকে চলে আসছে কবির স্বপ্ন-যাত্রাকে বাধাগ্রস্থ করার নিরন্তর প্রয়াস। এই পথে চলেছে বহু কবিপ্রতিভা। তবুও সময়ের প্রতিকূলে চলে কবি নিয়ে আসে প্রোজ্জ্বল দীপশিখা। যমুনাপাড়ের স্বপ্নচারী কবি খৈয়াম কাদের কষ্টের উঠোনে দাঁড়িয়ে নির্মাণ করেন স্বপ্নসৌধ, ‘আমার স্বপ্নরা এখন বালেগ হয়ে গেছে/আমাকে ছাড়াই তারা/যমুনার ঢেউ খেতে পারে/কষ্টের উঠোন খুঁড়ে/নিয়ত জাগাতে পারে/সহজিয়া গান’ (পারদ বিশ্বাস-২০০০)।
প্রমত্ত যমুনার ঢেউ খেতে খেতে বড় হওয়া কবি মেনে নিতে পারেন না যান্ত্রীক সভ্যতার বিড়ম্বনা। কবি ফিরে পেতে চান আদি অকৃত্রিম ভালোবাসা, মা-মাটির প্রকৃত নির্যাস, ’উত্তাল তরঙ্গ ভরা যমুনার জল ফিরে দাও/ফিরে দাও আবার আমাকে সেই/আকাশের তারার মতো নাওয়ের মিছিল ও খেয়া পারাপার/আমি তো চাইনি এই অভিনীত প্রেম/আত্মার বদলে এতো যান্ত্রীকতা।’ দম বন্ধ হয়ে আসা যান্ত্রীক পৃথিবীর খোলা ময়দানে দাঁড়িয়েও কবি আশাবাদী, ‘হয়তো আসবে আবার শ্যামাঙ্গী রাধিকার প্রেম/সাবিহার স্বপ্নছবি পদ্মপুকুরের সুখ/ভরে যাবে সবুজ আবেশে ফের/আমাদের এই পুন্ড্র নবদ্বীপ’ (লাঙ্গলের খেয়া ভাঙ্গে জীবনের গতি-২০১১)।
কবি খৈয়াম কাদের পুরানোকে জীর্ণতার বসনে দীর্ণ করতে চাননি। উত্তরাধুনিকতার সঙ্গমস্থলে দাঁড়িয়েও পুরানোকে সঙ্গে নিয়ে পথ চলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেছেন।মনে-প্রাণে ধারণ করেছেন জীবনানন্দের রুপসী বাংলাকে।জীবনানন্দ দাশকে নিবেদিত কবিতায় নাটোর এবং বনলতা সেন প্রসঙ্গ টেনে লিখেছেন, ‘রোদভেজা বিহঙ্গ ডানায় দুপুরে আকাশ দেখে/রূপসী নাটোর/কাব্যের তুলিতে আঁকে/রূপকথা শাড়ী।’ কাজী নজরুল ইসলাম শোষিত, বঞ্ছিত, শৃঙ্খলিত মানুষের জন্য মুক্তির বংশিবাদক। দুর্জন যতই মুখ ফিরাতে চাক না কেন অনাদীকাল তাঁর সুরে ভাঙবে তাবৎ স্বৈরতান্ত্রীক বন্দিশালার তালা, ‘এ গান থামেনি: থামবে না কোনদিন যতই ফেরাক/তারা মুখ, এ যে এক মাটির সরেস মাখা সুখ, এ যে এক/উন্মুখ উর্বশী মায়া। এতেই পুরুষ্ট হবে অনন্ত সময়/মুক্তির সন্ধান পাবে খোয়াড়ের ঘোড়া ও খাঁচার ডাহুক’(লাঙ্গলের খেয়া ভাঙ্গে জীবনের গতি-২০১১)।
কবির চিত্রকল্পে নারী ও নদী মিশে যায় এক মোহনায়। কবিজীবনের এক অনিবার্য পৃষ্ঠা নারী। নারী-পুরুষের রহস্য-সম্পর্ক ‘পাথর গণনা করে অপঠিত ভ্রæণের/গোপন সিঁড়ি/উপ্ত জীবনের/অনালেখ্য নির্জনতা’ ভেদ করে নির্মিত হয় মানব সভ্যতা। এখানে নারীকে উপেক্ষা করবার সুযোগ নেই, ‘নারীর নিবাস জুড়ে অজস্র নক্ষত্র জাগে/যেনো রাতের আকাশ থেকে/প্রণয় বিলাসে কাঁদে জোছনার চোখ’ (পারদ বিশ্বাস-২০০০)।এখানেই স্বপ্নচারী স্বপ্ন বুনে। এখানেই কবি করেন সুখের চাষ, ‘সৌর গ্রামের গহীন পথে/অত:পর/অকস্মাৎ/মোমের ডানাটি আমার অনল দাহ্যে ক্ষয়ে যায়/জীবন তলিয়ে যায়/ঝড়ো ঢেউ বন্যার অথই জলে’ (লাঙ্গলের খেয়া ভাঙ্গে জীবনের গতি-২০১১)। কবি জীবনকাব্যে নারী অধ্যায়ের শিল্পিত সুখের ধারাপাত তৈরী করেছেন, ‘দেহের ভিতরে যে রহস্য নদী/নিরবধি বহে তার/জোয়ারের পানি/দু’কূল ছাপিয়ে চলে/গন্ধম গন্ধের ঢেউ।’ এভাবেই কবি আঁকেন হৃদয়গহিনের অসামান্য চিত্রকল্প; যার সমাহার আছে, সমাপন নেই, ‘ধারাপাত প্রেম, অসাজ্ঞিক ভালোবাসা ঘর/যেখানে যজ্ঞের সমাহার আছে/কিন্তু সমাপন নেই’ (ধারাপাত প্রেম-২০১৩)। অন্য সব প্রেমিকের মতো কবিও অনন্তকাল সিক্ত হন নারীর কাদায়। তবে সেখানে থাকে না ছল-চাতুরী বা নিছক কাম, থাকে সীমাহীন ভালোবাসা আর গভীর শিল্পবোধ, ‘দ্বিধা সংকোচ! বসন কষণ খুলে জলের শ্রাবণ/খেলা করো, নদীর বয়নে মাখো জ্বরের বিষ্ময়/বরষা ফুরিয়ে গেলে বালুচর জাগে, সেখানে থাকে না/আর সারসের ঝাঁক, মাছরাঙা উড়ে যায় অন্য খালে/আম কুড়াবার এই ভরাধুম কালে আমরাও সারি চলো/রাতের গোসল, আলোকে আড়াল করে/পৃথিবীর নাম লিখে রাখি, কুসুম গোলায় রাখি গোপন ফসল (ধারাপাত প্রেম-২০১৩)।
কবি ‘মূর্তকে মুহূর্তে/বিমূর্ত করে, বিনাতার বীণায় তোলে/ফসলের গান’ (লাঙ্গলের খেয়া ভাঙ্গে জীবনের গতি-২০১১)। যার কারণে কবির মৃত্যু নেই, সৃষ্টিকর্মে কবি অমর। খৈয়াম কাদের কবিতার বাগিচায় শিল্পিত বোধের যে চাষ করেছেন তা যুগের পর যুগ আলো ছড়াবে। সুগন্ধি ফুলের সুবাসের মতো মোড়কবন্দি পারফিউম হয়ে ছড়িয়ে পড়বে কাব্যপ্রেমী মানুষের হৃদয় থেকে হৃদয়ে।