নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম স্রষ্টা ও সৃষ্টিশীল মানবের সরব প্রশংসায় যে নাম

13

Arabian Peninsula, জাযীরাত আল-আরব বা আরব উপদ্বীপ যে নামেই বলি, এ ভূখÐটির সৃষ্টি ৫ থেকে ২ কোটি বছর পূর্বে লোহিত সাগরের তলদেশে ফাটলের কারণে হয়েছে। আফ্রিকার উত্তর পূর্বে অবস্থিত পশ্চিম এশিয়ার উপদ্বীপটির কেন্দ্রস্থলে রয়েছে বর্তমান সৌদি আরব। কিন্তু পার্শ্ববর্তী দেশ যেমন ইয়েমেন, ওমান, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন ও আরব আমীরাতও আরব উপদ্বীপের অন্তর্ভুক্ত। এর জলসীমার দক্ষিণ পূর্বে ভারত মহাসাগর, উত্তর-পূর্বে পারস্য উপসাগর এবং সর্ব পশ্চিমে লোহিত সাগর। মূলত শুস্ক ও আগ্নেয়গিরিপূর্ণ হওয়ার ফলে অঞ্চলটিতে কৃষিকাজ ছিল দুঃসাধ্য। তবে মরুদ্যান বা নদী তীরবর্তী এলাকা বিশেষত তৎকালীন ইয়াসরীব (মদীনা) ছিল কৃষিকাজের উপযোগী বৃহৎ নগরী। অন্যদিকে তৎকালীন বাক্কা (মক্কা) ছিল নানা সম্প্রদায়ের বসতিপূর্ণ ব্যবসায়িক প্রাণ কেন্দ্র। এ জন্যে তখনকার আরবের অর্থনীতি ছিল বাণিজ্য ও পশুপালন কেন্দ্রিক। আরবদের যে শ্রেণীর লোকেরা এক স্থানে বসবাস করত তাদের মনোনিবেশ ছিল বাণিজ্য ও কৃষিতে। কিন্তু আরেক শ্রেণীর লোকেরা পানি ও খাদ্যের সন্ধানে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়াত। যাদেরকে যাযাবর বলা হয়।
ষষ্ঠ শতাব্দীতে বিশ্বের প্রধান রাজশক্তি ছিল আফ্রিকায় হাবশা সাম্রাজ্য, এশিয়ার পারস্য সা¤্রাজ্য এবং ইউরোপে রোম সাম্রাজ্য। এছাড়া প্রতাপশালী শাসনকর্তা হিসেবে যাদের নাম আসে তাদের মধ্যে যেমন সিরিয়ার গাসসানী শাসক হারিস, ইয়ামামার শাসক সুমামা ও আলেকজান্দ্রিয়া কেন্দ্রিক মিশরের শাসক মুকাউকিস। সে সময়টি ছিল হযরত ঈসা (আঃ) এর অন্তর্ধান Disappearanc হওয়ার পর ইসলামের আবির্ভাবের পূর্ববর্তী এক শতাব্দী। যাকে ডক্টর নিকলসন ইসলাম আইয়্যামে জাহেলিয়া যুগ বলে গণ্য করেছেন। অধ্যাপক ফিলিপ খুরি হিট্টির ভাষায় সাধারণত আইয়্যামে জাহেলিয়া বলতে অজ্ঞতা বা বর্বরতার যুগ বুঝালেও এ পদবাচ্য দ্বারা সে যুগকেই বুঝায় যে যুগে আরবে কোন নিয়ম কানুন ছিল না, কোন নবীর আবির্ভাব ঘটেনি এবং কোন আসমানী কিতাবও অবতীর্ণ হয় নি। অবশ্য তখন পৃথিবীব্যাপী আধিপত্যবাদী তৎপরতা, দুর্বলের উপর সবলের প্রতাপ এবং নোংরামিতে ছেয়ে ফেলে। কিন্তু আরব ভূখন্ডে যে লুটপাট, নৃশংসতা ও গোষ্ঠী সংঘাত চলে তা আর কিছু না হলেও তমসাচ্ছন্ম সময় বা অন্ধকার যুগ বলা যায়। চুরি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও সুদের বিস্তার ঘটে। দাস-দাসী ক্রয়-বিক্রয়ের হাট বসত। আরবদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অধঃপতনের কারণে বিশ্বে তারা উপেক্ষিত ও অবহেলিত জাতিতে পরিণত হয়। সকল দিক বিবেচনায় মানুষ, মানবতা সর্বোপরি সভ্যতার বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য মহান আল্লাহ তা’আলা ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দে প্রেরণ করেন সর্বশেষ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মদ (দঃ) কে।
মহানবী (দঃ) শুধু আরব বা মুসলমানদের নবী ছিলেন না, তিনি সমগ্র বিশ্বের মানব গোষ্ঠীর নবী, করুণার আধার ও সভ্যতার গোড়াপত্তনকারী। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী।’ (সূরা ক্বালাম : আয়াত ৪), পবিত্র কুরআনে সূরা আহযাবের ২১ নম্বর আয়াতে বলা হচ্ছে, ‘নিশ্চয় রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ।’ মহান আল্লাহ সূরা নিসার ৮০ নম্বর আয়াতে ইরশাদ করেছেন, ‘যে রাসূল (দঃ) এর আনুগত্য করল সে যেন আল্লাহর আনুগত্য করল।’ পবিত্র কুরআনের সূরা আম্বিয়ায় ১০৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করেন, (ওয়ামা আরছালনাকা ইল্লা রাহমাতাল ল্লি আলামীন) অর্থাৎ ‘হে প্রিয় রাসূল! আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বের জন্যে করুণা বা দয়ালু হিসেবে প্রেরণ করেছি।’ সহীহ হাদীস শরীফে বর্ণিত, হযরত মুহাম্মদ (দঃ) দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলে ছিলেন, ‘কোন মুসলমান কোন জিম্মীকে (অন্য ধর্ম্বাববলম্বীকে) হত্যা করলে তার জন্য বেহেশত হারাম, তাদের নিরাপত্তা দাও, তারা আমার জিম্মী।’
মূলত রাসূল (দঃ) এর কৈশোর কিংবা অনুভূতিশীল হওয়ার পর থেকে যতগুলি কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন সর্বক্ষেত্রে অসাধারণ অতুলনীয় যোগ্যতা ও আল্লাহ প্রদত্ত ঐশ্বরিক ক্ষমতার নিদর্শন দেখা যায়। তিনি বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে সিরিয়া, বাহরাইন ও ইয়েমেন সফর করে অতুলনীয় সফলতার পাশাপাশি সত্য, ন্যায় এবং যৌক্তিক লেন-দেন করার ধারণা সকলের কাছে তুলে ধরেন। সত্যবাদিতার কারণে প্রিয় নবী (দঃ) তখন থেকেই আল-আমীন খ্যাতি অর্জনে সক্ষম হন। বিখ্যাত ব্রিটিশ প্রাচ্যবিদ স্যার উইলিয়াম ম্যুর বলেছেন, অদৃশ্য গুনরাজি তৎকালে মক্কাবাসীদের মধ্যে অতি বিরল ছিল। এই সরল প্রকৃতি যুবকের সুন্দর চরিত্র ও সম্মান আচরণ দেশবাসীর প্রশংসা অর্জন করতে সমর্থ হয়েছিল এবং সর্বসম্মতিক্রমে ‘আল-আমীন’ আখ্যা লাভ করেছিলেন। অন্য এক ব্রিটিশ প্রত্নতত্ববিদ Stanley Edward Lane-Poole বলেন, “মুহাম্মদ (দঃ)-ই ছিলেন পৃথিবীর একমাত্র ব্যক্তি যিনি তাঁর জন্ম এবং অনুভূতি জাগ্রত হওয়া থেকে ইন্তেকাল পর্যন্ত ছন্দপতনহীনভাবে একটানা পূত পবিত্র জীবনযাপন করে গেছেন। কখনো তাঁর সত্তার পরিচয় বিস্মৃতি ঘটেনি। আপন ব্যক্তিত্বের মর্যাদা এবং নিজ জাতির শাসক হওয়া সত্তে¡ও তাঁর কাছে যে বিনয় নম্রতা পাওয়া যায় এমনটি আর কোন শাসক বা পয়গাম্বরের ভাগ্যে জুটেনি।”
তরুণ মুহাম্মদ (দঃ) ক্বায়েস আয়লান এবং কুরায়েশ ও তাদের মিত্র বনু কিনানার মধ্যেকার ‘ফিজার যুদ্ধ’ প্রত্যক্ষ করার পর এ ধরনের গর্হিত কাজ থেকে সমাজ তথা যুবক শ্রেণীকে বিরত রাখার তাগিদ অনুভব করেন। ‘হারবুল ফিজার’ (দুষ্টদের যুদ্ধ) সংগঠিত হয় ‘হারাম’ বা নিষিদ্ধ মাস (মুহাররাম, রজব, যিলক্বদ, যিলহজ্ব) মাস সমূহের মধ্যে এবং কা’বা কিংবা বায়তুল্লাহ শরীফের পবিত্রতাও নষ্ট হয়। সুতরাং আল্লাহর নবী (দঃ) নবুয়তপ্রাপ্তির পূর্বে (ক) নির্যাতিত, নিরূপায় মানুষের সহায়তা প্রদান; (খ) সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করা; (গ) সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ গড়ে তোলা এবং পথিক বা মুসাফিরদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করণকে অভিষ্ঠ লক্ষ্য নির্ধারণ করে প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘হিলফুল ফুযুল’। মহানবী (দঃ) সত্যনিষ্ঠ এবং পাশাপাশি সমাজ সেবক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তখন তাঁর বয়স ২৫ বৎসর। সে বৎসরই তিনি অত্যন্ত বিশ্বস্ত, পিয়ারী ও বিত্তশালী হযরত খাদীজা (রাঃ) এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
হযরত মুহাম্মদ (দঃ) এর জীবনে তাঁর ২৫ থেকে ৪০ বৎসর সময়কালটি হওয়ার কথা ছিল সুখ, শান্তি এবং আনন্দের। চার কন্যা এবং দুটি ছেলের জনক রাসূল (দঃ) ছিলেন সম্মানিত গোত্রের সদস্য। সমর্থন দেয়ার মত যোগ্য জীবনসঙ্গিনী ও সামাজিক মর্যাদায় শীর্ষস্থানীয় হওয়ার পরও তৎকালীন বিশ্ব ব্যবস্থা, সর্বোপরি আশপাশের অরাজক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি প্রায়শ অস্বস্তিতে থাকতেন। তিনি ভাবতেন-পৃথিবীতে আমরা কেন এসেছি, জীবনের লক্ষ্য কি হওয়া উচিৎ, জগতটাকে আমরা কিভাবে সার্থক করে তুলতে পারি ইত্যাদি। তখনকার গোত্রতান্ত্রিক সমাজের কদর্য রূপ, গোত্রীয় জীবনধারার বৈষম্যগুলো তাঁকে বিষিয়ে তুলেছিল। তিনি খুবই চিন্তিত থাকতেন সমাজের দরিদ্র, অসহায় ও নির্যাতিত মানুষের দুরবস্থা দেখে। এ পর্যায়ে মুহাম্মদ (দঃ) ঐশী সত্যের তালাসে নিয়মিতভাবে আধ্যাত্মিকতা চর্চায় মনোনিবেশ করেন। শান্তি, নির্জনতা ও প্রার্থনার উদ্দেশ্যে তিনি বছরের অধিকাংশ সময় মক্কার পাহাড়-পর্বতে কাটাতে লাগলেন। এতে তাঁর অভিব্যক্তি এবং চিন্তা আরো শানিত হতে থাকে। এ কার্য সম্পাদনের উপযুক্ত স্থান হিসেবে আল্লাহর নবী (দঃ) কাবা শরীফ থেকে ২ মাইল দূরে “জাবালে নূরকে” বেছে নেন। যার উচ্চতা ৬৪০ মিটার বা ২১০০ ফুট। জাবালে নুর বা আলোকিত পাহাড়টির ২৭০ মিটার (৮৯০ ফুট) উচ্চতায় যে গুহাটি ইতিহাস রচনা করেছে তাই হচ্ছে “হেরা গুহা”। Cave Hira আরবীতে “গারে হেরা”। গুহাটি ৩.৭ মি. (১২ ফুট) দৈর্ঘ এবং ১.৬০ মি. (৫ ফুট ৩ ইঞ্চি) প্রশস্ত। বিশ্ব নবী (দঃ) আরো গভীর ও ঐকান্তিকতাপূর্ণ ধ্যানে নিমজ্জিত হয়ে গারে হেরায় ঘন্টার পর ঘন্টা দিনের পর দিন, এমনকি রাতের পর রাত কাটিয়ে দিতেন। হঠাৎ একদিন এমন একটা ব্যাপার ঘটে গেলো, যা শুধু তাঁর জীবনকে নয়, বরং সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসই বদলে দিয়েছে। এটি ছিল ৬১০ খ্রিষ্টাব্দের পবিত্র রমজান মাসের শবে কদরের রাত। আল্লাহ তা’আলার পক্ষ থেকে ফেরেশতা জিব্রাইল (আঃ) হেরা গুহায় সর্বপ্রথম মুহাম্মদ (দঃ) এর নিকট মহাগ্রন্থ ‘কুরআনের’ বাণী নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। যদিও এর আগে প্রিয় নবী (দঃ) অনেক সত্য স্বপ্ন দেখতেন যা ওহীর সমতুল্য। ঐ রাতে জিব্রাইল (আঃ) কুরআন শরীফের ৯৬ নং সূরার প্রথম ৫ আয়াতে করীমা তেলাওয়াত করেছিলেন।
এ ঘটনায় রাসূল (দঃ) ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে নিজ ঘরে ফিরে আসেন এবং হযরত খাদীজা (রাঃ) এর কাছে জীবনহানির আশঙ্কা ব্যক্ত করেন। খাদীজা (রাঃ) সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, “আল্লাহর শপথ! আল্লাহ আপনাকে কোনদিন অপমানিত করবেন না। কারণ আপনিতো আত্মিয়-স্বজনের সাথে সদ্ব্যবহার করেন, অসহায় দুর্বলের দায়িত্ব বহন করেন, নিঃস্বকে সাহায্য করেন, নিপীড়িতের সহায়তা করেন এবং যথোপযুক্ত মেহমানদারী করেন”। অতঃপর নবী করিম (দঃ) হযরত খাদীজা (রাঃ) কে বললেন, আমাকে কম্বল দ্বারা আবৃত করে দাও, জড়িয়ে ধরো। সে দিন থেকে দীর্ঘ ২২ বছর ৫ মাস ১৪ দিন সময়ে হযরত মুহাম্মদ (দঃ) এর উপর নাজিলকৃত ওহীর সমষ্টিই আমাদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ, সঠিক দিকনির্দেশকারী, পরিপূর্ণ জীবন বিধান ‘আল-কুরআন’ এর শাব্দিক অর্থ হলো পঠিত। কারণ, পবিত্র কুরআনের রচয়িতা স্বয়ং আল্লাহ। যা নবী মুহাম্মদ (দঃ) মানুষের কাছে অবিকল পৌঁছে দিয়েছেন।

চলবে…

লেখক : রাজনীতিক, প্রাবন্ধিক