নবী করীম (দ.) আলাইহি ওয়াসাল্লামের শুভাগমনে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ‘জশনে জুলুস’

79

সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী

মিলাদ বা জন্ম প্রত্যেক মানুষের জন্যই খুশি ও আনন্দের পরিচায়ক। এই দৃষ্টিকোণ থেকে জন্মদিনের একটি নির্দিষ্ট গুরুত্ব লক্ষ্য করা যায়। আর এই গুরুত্ব সে সময় আরও বেড়ে যায় যখন সে দিনগুলোর সম্পর্ক আম্বিয়া আলাইহিমুস ্সালাম-এর সাথে হয়। আম্বিয়ায়ে কেরামের জন্ম আসলেই আল্লাহ তাআ’লার অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেয়ামত এবং সৃষ্টির জন্য সকল প্রকার নেয়ামতের উৎস। তাঁদের ওসীলায় আসমানী হেদায়েত, নিয়ামত, কোরআন, নামায, রোযা, হজ¦, যাকাত, জুমা, দুই ঈদ ইত্যাদি নেয়ামতরাজি আমরা পেয়েছি।
তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বরকতময় মিলাদের উপর খুশি ও আনন্দ প্রকাশ করা ঈমানের আলামত এবং তাঁর সাথে আত্মিক সম্পর্ক স্থাপনের অন্যতম মাধ্যম। আল্লাহ তা’আলা নিজেই স্বীয় নবীর মিলাদের বর্ণনা দিয়েছেন পবিত্র কুরআনে, ‘আমি এই শহরের (মক্কা) শপথ করছি, (হে হাবীব!) এ জন্য যে, এই শহরে আপনি তশরীফ আনায়ন করেছেন। হে হাবীব! আপনার পিতার [হযরত আদম আলাইহিস সালাম অথবা হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালামের] শপথ এবং (তাদের) শপথ, যারা জন্মগ্রহণ করেছে।’ (সূরা বালাদ: আয়াত ১-৩)।
আমরা জানি, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শুভ জন্ম ৮৭০ খ্রী. ১২ই রবিউল আওয়াল সোমবার আসহাবে ফীল (হস্তী বাহিনী)’র কাবা ঘর আক্রমণের বছর। কায়েস ইবনে মাখরামা বলেন, “আমি ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আবরাহার হামলার বছর জন্মগ্রহণ করি। তাই আমরা সমবয়সী”। (দালায়েলুন নাবুয়্যাহ-৪৬)
হযরত হাসসান ইবনে সাবিত বলেন, “আমি তখন সাত/ আট বছরের বালক হলেও বেশ শক্তিশালী ও লম্বা হয়ে উঠেছি। যা শুনতাম তা বুঝতে পারার ক্ষমতা তখন আমার হয়েছে। হঠাৎ শুনতে পেলাম জনৈক ইহুদী ইয়াসরিবের (মদীনার) একটা দূর্গের ওপর উঠে উচ্চস্বরে, ওহে ইহুদী সমাজ!’ বলে চিৎকার করে উঠলো। লোকেরা তার চারপাশে জমায়েত হয়ে বললো, তোমার কী হয়েছে?” সে বলল, আজ রাতে সেই নক্ষত্র উদিত হয়েছে।” (সীরাতে মোগলতাঈ পৃঃ ৫।)
জন্মদিবস ও ওফাত দিবসকে আল্ ক্বোরআনের বিশেষ সম্মান : আল্লাহ্ তা’আলা তাঁর প্রিয়জনদের শুভজন্ম এবং তাঁদের ওফাত দিবসকে ক্বোরআনুল করিমে বিশেষভাবে সম্মানিত করেছেন এবং এ দিনগুলোকে বিশেষ শান্তি ও সালামের দিন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। হযরত ইয়াহ্য়া আলায়হিস্ সালামের শুভজন্ম ও ওফাত সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেন: “এবং তাঁর প্রতি সালাম বা শান্তি যেদিন তিনি জন্ম গ্রহণ করেছেন, যেদিন তিনি ওফাত পাবেন এবং যেদিন তিনি পুনর্জীবিত হবেন।” [সূরা মারয়াম:১৫]
হযরত ইসা আলায়হিস্ সালাম তাঁর মাতৃক্রোড়ে এ ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, ‘‘এবং আমার প্রতি সালাম ও শান্তি যেদিন আমি জন্ম গ্রহণ করেছি, যেদিন আমি ওফাত পাবো এবং যেদিন আমি পুনর্জীবিত হবো“। [মারয়াম:৩৩]
রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম পালন করেন নিজের জন্মদিন : যেহেতু শুভজন্ম দিন আল্লাহর পক্ষ থেকে একটি বিশেষ নেয়ামত তাই রাসূলে করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম নিজেই তাঁর নিজ জন্মদিন বা মিলাদ উদযাপন করেছেন নফল রোযা পালনের মাধ্যমে আল্লাহ্ তা’আলার শুকরিয়া স্বরূপ। নবী করিম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম প্রত্যেক সোমবার রোযা রাখতেন। তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি এরশাদ করেন: “এটা ওইদিন যেদিন আমার শুভজন্ম হয়েছে বা মিলাদ হয়েছে এবং যে দিন আমার প্রতি প্রথম ওহী নাযিল হয়েছে।” (মুসলিম-১১৬২)
নেয়ামত প্রাপ্তির দিনকে স্মরণ করা নবীগণ আলাইহিমুস সালামের সুন্নাত : আল্লাহ্ তা’আলার তাঁর প্রিয়জনদের স্মরণের নির্দেশ দিয়েছেন পবিত্র ক্বোরআনে প্রায় অর্ধশতাধিক আয়াতে। কেননা এর মাধ্যমে মানুষ তাঁদের জীবন, কর্ম ও অনুপম আদর্শ সম্পর্কে অবগত হতে পারে এবং নিজের জীবনেও তাঁদের আদর্শ বাস্তবায়নে আগ্রহী ও উৎসাহিত হয়ে উঠে। আল্লাহ্ তা’আলা এরশাদ করেন- “আপনি তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিন, কেননা স্মরণের মধ্যে রয়েছে মুমিনগণের জন্য অনেক উপকার। [যারিয়াত:৫৫]
আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেন, হে হাবীব! স্মরণ করুন কিতাবে ইবরাহীমকে নিশ্চয়; তিনি ছিলেন সত্যবাদী, নবী। [মারয়াম: ৪১]
আল্লাহ তা’আলা আরো এরশাদ করেন, হে হাবীব! স্মরণ করুন কিতাবে মুসাকে। তিনি ছিলেন মনোনীত এবং তিনি ছিলেন রাসূল, নবী।)। [মারয়াম-৫১]
অনুরূপভাবে আল্লাহ্ তা’আলা ক্বোরআন করিমে তাঁর প্রিয় নবীকে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি যেন স্বীয় উম্মতদেরকে আল্লাহ্ তা’আলার পক্ষ থেকে নেয়ামত অবতরণের দিনগুলোকে স্মরণ করিয়ে দেন। আল্লাহ্ পাক এরশাদ করেন- “আমি হযরত মূসাকে নিদর্শনাবলীসহ প্রেরণ করে বলেছিলাম যে, আপনি স্বজাতিকে অন্ধকার থেকে আলোর দিকে আনয়ন করুন এবং তাদেরকে আল্লাহর দিনসমূহ স্মরণ করিয়ে দিন। নিশ্চয় এতে প্রত্যেক ধৈর্যশীল কৃতজ্ঞের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।” [ইবরাহীম-০৫]
আল্লাহ তা’আলা আরো এরশাদ করেন, “নিশ্চয় তাঁদের ঘটনাসমূহে রয়েছে জ্ঞানীদের জন্য শিক্ষা ও উপদেশ। এটা কোন মনগড়া কথা নয়, কিন্তু যারা বিশ্বাস স্থাপন করে তাদের জন্যে পূর্বেকার কালামের সমর্থন এবং প্রত্যেক বস্তুর বিবরণ, রহমত ও হেদায়ত।”। [ইউসুফ:১১১]
মহান আল্লাহ্ তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে উদ্দেশ্য করে বলেন, “আমি আপনার নিকট পূর্ববর্তী রাসূলগণের যা ঘটনা বর্ণনা করেছি তা আমি আপনার হৃদয়কে সুদৃঢ় ও মজবুত করার জন্য, আর এভাবে আপনার নিকট মহাসত্য এবং ঈমানদারদের জন্য নসীহত ও স্মরণীয় বিষয়বস্তু এসেছে। [হুদ: ১২০]
জশনে জুলুসে ঈদে মিলাদুন্নবী:
জশন শব্দের অর্থ আনন্দ ও খুশি এবং জুলুস শব্দের অর্থ মিছিল বা শোভাযাত্রা । তাই জশনে জুলুস এর অর্থ দাঁড়ায় ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’। আর জসনে জুলুসে ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানে হল, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র জন্ম দিনকে কেন্দ্র করে খুশি উদযাপন করা এবং আনন্দ শোভাযাত্রা করা।
কেন এই আনন্দ শোভাযাত্রা ?
প্রথমত কোরআন কারীমের নির্দেশ : আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে তাঁর নেয়ামত ও রহমত পেয়ে আনন্দ প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছেন। এরশাদ করেন, হে হাবিব! আপনি বলে দিন আল্লাহর অনুগ্রহ ও তারই রহমতের উপর তারা যেন অবশ্যই আনন্দ করে; তা তাদের জন্য তাদের সমস্ত উপার্জনের চেয়েও অতি উত্তম। (সূরা ইউনুস আয়াত ৫৮)
আমাদের প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সৃষ্টির জন্য আল্লাহতালার পক্ষ থেকে নেয়ামত ও রহমত। আল্লাহ তায়াল এরশাদ করেন, হে প্রিয় রাসূল! আমি আপনাকে সমগ্র সৃষ্টির জন্য রহমত স্বরূপ পাঠিয়েছি। (সূরা আম্বিয়া আয়াত ১০৭)
আল্লাহ তাআলা আরো এরশাদ করেন, আপনার রব কর্তৃক প্রদত্ত নেয়ামত অধিক হারে স্মরণ ও আলোচনা করুন (সূরা দোহা আয়াত ১১)
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন, অতএব তোমরা আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহসমূহকে স্মরণ করো এবং এই পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী হয়োনা। (সূরা আরাফ আয়াত ৭৪)
আল্লাহ তা’আলা আরো বলেন, “যদি তোমরা নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় কর তাহলে আমি তা বৃদ্ধি করে দেব, আর যদি তোমরা তা অস্বীকার করো তাহলে জেনে রেখো নিশ্চয়ই আমার শাস্তি খুবই কঠিন। (সূরা ইব্রাহীম আয়াত- ৭)
আল্লাহ তাআলা আরো এরশাদ করেন, আল্লাহ তাআলা মুমিনদের প্রতি অনেক বড় অনুগ্রহ করেছেন, কেননা তিনি তাদের মাঝে একজন মহাসম্মানিত রাসুল প্রেরণ করেছেন। (সূরা আল ইমরান-১৬৪)
কুরআনুল কারীমের এই সকল আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে যে, নেয়ামত প্রাপ্তির দিনকে স্মরণ করা এবং আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ ও নেয়ামত পেয়ে খুশি উদযাপন করা আল্লাহ তাআলারই নির্দেশ। তাই জশনে জুলুস মূলত আল্লাহ তায়ালার নির্দেশ পালনেরই একটি অন্যতম বহিঃপ্রকাশ।
দ্বিতীয়ত সাহাবায়ে কেরামের অনুসরণ :
আমরা জানি বুখারী শরীফসহ অসংখ্য নির্ভরযোগ্য সূত্রে প্রমাণিত যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কায়ে মোয়াজ্জামা থেকে মদিনা মুনাওয়ারায় হিজরত করেন এবং তিনি যেদিন মদিনায় প্রবেশ করেন দিনটি ছিল ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার। তখন ৫ শতাধিক আনসার সাহাবায়ে কেরাম রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জুলুস সহকারে স্বাগত জানান। এমনকি মদিনা শরীফের নারী, শিশু ও দাস-দাসীরা ঘরের ছাদের উপর আরোহন করে এ দৃশ্য অবলোকন করেন। সকলে হাতে পতাকা নিয়ে “মারহাবা ইয়া রাসুলাল্লাহ, মারহাবা ইয়া হাবিবাল্লাহ” এভাবে ¯েøাগান দিয়ে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে স্বাগতম ও অভিনন্দন জানান।
বুখারী শরীফে বর্ণিত রয়েছে, হযরত বারা ইবনে আযের রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন, রসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পেয়ে মদনাবাসী যত বেশি আনন্দিত হয়েছিল এই ধরনের আনন্দ আমি মদিনা শরীফে আর কখনো দেখিনি।
হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন, রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহি ওয়া সাল্লামের মদিনা শরীফে প্রবেশকালীন সময়ে আমিও উপস্থিত ছিলাম। এত সুন্দর দৃশ্য আমি আর কখনো দেখিনি।
তিনি আরো বলেন, যেই দিন রাসুলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় প্রবেশ করেন তখন মদিনার চতুর্দিকের সবকিছু আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে গিয়েছিল। আর তিনি যেদিন ইন্তেকাল করেন মদিনার সবকিছু অন্ধকার হয়ে পড়ে।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সালাম বলেন, যেই দিন রসূলের করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় প্রবেশ করেন তখন তাঁর দিকে মানুষ হুমড়ে পড়ছিল এবং তাঁর চতুর্পাশে মদিনাবাসি প্রচুর ভিড় জমিয়েছিল। তাদের সাথে আমিও উপস্থিত ছিলাম, আমি তাঁর চেহারা মোবারক দেখেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম যে, এই চেহারাটি কোন মিথ্যুকের চেহারা হতে পারেনা।
তৃতীয়ত ফেরেশতাদের সুন্নত : বিশুদ্ধ রেওয়ায়াতে প্রমাণিত, যেদিন রসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই পৃথিবীতে তাশরিফ নিয়ে আসেন সেই দিন আসমান জগতের অসংখ্য ফেরেশতা জুলুস সহকারে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র গৃহে উপস্থিত হয়েছিলেন।
তাই জশমে জুলুস তথা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শুভাগমনে আনন্দ শোভাযাত্রা করা ফেরেশতাদেরও সুন্নত।

লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, সাদার্ন
বিশ্ববিদ্যালয়, খতীব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ