নবীজির অনন্য শ্রেষ্ঠত্বের স্মারক ইসরা ও মে’রাজে রয়েছে উম্মতের জন্য বহুবিধ শিক্ষা

43

সৈয়দ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন আল আযহারী

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ রাসুল হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইসরা ও ‘মেরাজ হল পৃথিবীর ইতিহাসে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টিকারী এক যুগান্তময়ী ঘটনা এবং আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনন্য শ্রেষ্ঠত্বের স্মারক। নবীকুলের মধ্যে একমাত্র তাঁকেই এই অনন্য মর্যাদা ও সম্মানের আসনে সমাসীন করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা তাঁকে সমগ্র সৃষ্টিজগতের বিশেষ রহস্য বুঝিয়ে দিলেন এবং জান্নাত-জাহান্নাম পরিদর্শন করালেন, যাতে তিনি মহান সৃষ্টিকর্তার ঊর্ধ্বজগতের নিদর্শনাবলি পরিদর্শন ও তাঁর নিয়ামতরাজি স্বচক্ষে অবলোকন করে উম্মতকে তা সবিস্তারে ও সন্দেহাতীতভাবে বর্ণনা করতে পারেন। তাই ইসরা ও মি’রাজ নিছক একটি অলৌকিক ঘটনা নয়। বরং ইসরা ও মি’রাজে রয়েছে আমাদের জন্য অনেক শিক্ষা। যেমন-
তাঁর নবুয়তের সার্বজনীনতা ও সকল নবী রাসূলের উপর তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ : বায়তুল মাকদিসে সমস্ত নবী-রাসূল তাঁর ইমামতিতে সালাত আদায় করা তাঁর নবুয়তের সার্বজনীনতার পাশাপাশি তাঁকে ইমামুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালিন হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের প্রমাণ এবং ভূ-মন্ডল ও নবমন্ডল উভয় জগতে প্রিয় নবীর শ্রেষ্ঠত্ব ও কর্তৃত্বের প্রমাণ। তিনি এরশাদ করেন: “প্রত্যেক নবী-রাসূলের আসমানে দু’জন এবং জমিনে দু’জন উজীর থাকেন, আমার আসমানে দু’জন এবং জমিনে দু’জন উজীর আছেন। জমিনে আবু বকর ও ওমর, আর আসমানে জিব্রাঈল ও মিকাঈল।” [মিশকাত-৬০৫৬]
পাশাপাশি নবীগণ আলায়হিমুস্ সালামের মহান আল্লাহর সাথে কৃত প্রতিশ্রæতি পূরণেরও এক মহা সুযোগ। কেননা রূহের জগতে আল্লাহ্ তা‘আলা নবী-রাসুলগণের কাছ থেকে ওয়াদা নিয়েছিলেন যে, যখন প্রিয় নবী তাঁদের নবুয়তকালে তাশরীফ আনবেন তখন তাঁরা সকলে তাঁর উপর ঈমান আনবেন এবং তাঁকে সাহায্য করবেন। [আলে ইমরান-৮১] কিন্তু তাঁরা কেউ এ ওয়াদা পূরণ করতে পারেননি, কারণ তাঁরা প্রত্যেকেই প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামে’র আগমনের পূর্বেই ইন্তেকাল করেন। (একমাত্র হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম ছাড়া) তাই তাঁরা তাঁদের এ ওয়াদা পূরণ করেছেন বাইতুল মাকদিসে প্রিয়নবীর ইমামতিতে নামাজ আদায়ের মাধ্যমে এবং তাঁর প্রতি ঈমান ও তাঁর শ্রেষ্ঠত্বকে মেনে নেয়ার মাধ্যমে।
খোদায়ী নিদর্শনাদি দেখানো এবং অদৃশ্য জগতের বাস্তবতাকে বুঝিয়ে দেওয়া : আল্লাহ্ তা‘আলা এরশাদ করেন “তিনি পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাতে ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আক্বসা পর্যন্ত, যার চতুর্দিকে আমি বরকতময়তার বিস্তার করেছি, তাকে আমার নিদর্শনাবলী দেখানোর জন্য। নিশ্চয় তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।” [বনী ইসরাঈল, আয়াত-১]
যাঁকে কেন্দ্র করে এ বিশ্ব জাহানের সৃষ্টি তাঁকে মহান কুদরতের অপূর্ব নিদর্শন, বিস্ময়কর সৃষ্টির তত্বজ্ঞান লাভ, খোদায়ী শক্তির বিস্তৃতির মহাবিস্ময় স্বচক্ষে দেখানো ছিল তাঁর মিরাজের বিশেষ উদ্দেশ্য।
পরকাল অদৃশ্য জগত। তাই এর বাস্তবতা নিয়েও জড়বাদী বা বস্তুবাদীরা সন্দেহ পোষণ করে থাকে। তাই আল্লাহ সকল মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর হাবিবকে এর বাস্তবতা দেখিয়ে দিলেন। জান্নাতের সুখ-শান্তি যে কত অফুরন্ত আর জাহান্নামের আযাব-গযব যে কত ভয়াবহ তা তিনি চাক্ষুস প্রত্যক্ষ করলেন।
জান্নাত-জাহান্নামের এবং বিবিধ নেয়ামত ও শাস্তির প্রত্যক্ষদর্শী : নবী-রাসূলগণ আলায়হিমুস্ সালাম তাঁদের উম্মতদেরকে জান্নাত-জাহান্নামের সংবাদ দিয়েছেন চাক্ষুষভাবে না দেখে, আল্লাহ্ তা‘আলার বাণীর উপর নির্ভর ও বিশ্বাস করে। কিন্তু একমাত্র আমাদের নবীই স্বচক্ষে জান্নাত-জাহান্নাম প্রত্যক্ষ করে উম্মতদেরকে সংবাদ দিয়েছেন। তাই না দেখে বর্ণনা আর প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনার মাঝে আকাশ-পাতাল ব্যবধান।
তিনি মিরাজে জান্নাতের অফুরন্ত নেয়ামতরাজির পাশাপাশি কিছু সামাজিক অপরাধের শাস্তিও স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন। যা পরবর্তীতে তাঁর উম্মতকে সতর্ককরণে বিশেষ সহায়ক হয়েছে। কেননা, কোন একটা বিষয় শুনে বলার চেয়ে দেখে বলার মধ্যে অনেক বেশী কার্যকর অনুভুতি থাকে।
আল্লাহ্র প্রিয়ভাজন বান্দাদের বরকতময় স্মৃতি ও নিদর্শনাবলীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও বরকত হাসিল করা : যাত্রা পথে তিনি মদিনা শরীফ, সিনা পর্বত (যেখানে হযরত মূসা আলাইহিস্ সালাম আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে কথোপকথন করার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন) এবং বেথেলহাম (হযরত ইসা আলাইহিস্ সালাম এর জন্মস্থান ফিলিস্তিনের বেথেলহাম) এ যাত্রা বিরতি করেন এবং ঐ বরকতময় স্থানগুলোতে নামাজ আদায় করেন। এ থেকে প্রমাণিত, আল্লাহ্র প্রিয়ভাজন বান্দাদের বরকতময় স্মৃতি ও নিদর্শনাবলীর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা ও বরকত হাসিলের জন্য সেখানে নামাজ, দোআ ও ফাতিহা পাঠ করা সুন্নাত। [নাসাঈ, কিতাবুস্ সালাত, হাদিস নং-৪৫০]
ইসলাম স্বভাবজাত ধর্ম : মিরাজের রাত্রিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে মদ এবং দুধ পরিবেশন করা হলে, তিনি দুধ গ্রহণ করেন এবং মদ প্রত্যাখ্যান করেন। তখন জিব্রাইল আলাইহিস সালাম তাঁকে বলেন, আপনি ফিতরাতের পথ অবলম্বন করেছেন। (মুসলিম শরিফ, হাদিস নং-৪৪২)
নবীগণ আলায়হিমুস্ সালাম সশরীরে জীবিত : নবী ও রসূলগণ আলায়হিমুস্ সালাম-এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- তাঁরা ওফাত বরণের পরও সশরীরে জীবিত। তাঁদের শরীর মুবারককে গ্রাস করা যমীনের উপর আল্লাহ্ তা‘আলা হারাম করে দিয়েছেন। মি’রাজ শরীফে যাবার সময় হযরত মূসা আলায়হিস্ সালামকে প্রথমে তাঁর কবর শরীফে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তে দেখা, আবার বায়তুল মুক্বাদ্দাসে নবীগণের সাথে তাঁর নামাজ পড়া, আবার আসমানে সাক্ষাত পাওয়া, প্রতিটি আসমানে নবী-রাসূল আলায়হিমুস্ সালাম আমাদের প্রিয়নবীকে স্বাগতম জানানোর জন্য উপস্থিত থাকা, ইত্যাদি প্রমাণ করে নবীগণ ওফাত বরণের পরও সশরীরে জীবিত। সহীহ মুসলিমে বর্ণিত আছে, “যে রাতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামকে মি’রাজ করানো হল সে রাতে তিনি হযরত মূসা আলায়হিস্ সালামের কবরের পাশ দিয়ে গমন করার সময় দেখতে পেলেনÑ তিনি নিজ কবর শরীফে নামাজ পড়ছেন।” (মুসলিম-৪৩৭৯)
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন,“নবীগণ আলায়হিমুস্ সালাম তাঁদের নিজেদের কবর শরীফে জীবিত এবং তাঁরা সেখানে নামাজ আদায় করেন। ( আবূ ইয়া’লা:‘মুসনাদ’ ৬/১৪৭. ইমাম বায়হাক্বী:‘‘হায়াতুল আন্বিয়া”-৩)
তিনি আরও এরশাদ করেন,“আমি আমাকে দেখতে পেলাম একদল সম্মানিত নবী-রাসূলের সাথে। আর হযরত মূসা আলায়হিস্ সালামকে দেখলাম তিনি দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ছেন। দেখলাম তিনি উপমাযোগ্য ব্যক্তি। তাঁর চুল কোঁকড়ানো, দেখে মনে হচ্ছিল- তিনি ‘শানুয়া’ স¤প্রদায়ের লোক। আবার দেখলাম হযরত ঈসা আলায়হিস্ সালাম দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ছেন। ওদিকে হযরত ইবরাহীম আলায়হিস্ সালামও দাঁড়িয়ে নামাজ আদায় করছেন। তিনি দেখতে প্রায় আমার মতই। অত:পর নামাযের সময় এল। আর আমি তাঁদের সকলের ইমাম হিসেবে নামাজ আদায় করলাম।” (মুসলিম-১৭২)
হযরত সা‘ঈদ ইবনে মুসাইয়্যাব রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু বলেন, ‘হাররা’ (৬৩ হিজরীতে ইয়াযিদ বাহিনীর মদীনা শরীফ আক্রমন সময়কাল) -এর রাতগুলোতে আমি মসজিদে নববী শরীফে আশ্রয় নিলাম। তখন মসজিদে নববী শরীফে আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না। কিন্তু যখনই নামাযের সময় হতো, তখন আমি প্রিয়নবীর কবর শরীফ থেকে আযান ও ইক্বামত শুনতে পেতাম। (দারামী ১/২২৮, ওফাউল ওফা ৪/১৩৫৬)
ইমাম জালাল উদ্দীন সুয়ূত্বী রাহ্মাতুল্লাহি আলায়হি এ বিষয়ের উপর ‘ইম্বাহুল আযকিয়া ফী হায়াতিল আম্বিয়া’ নামে একটি স্বতন্ত্র কিতার রচনা করেন। অনুরূপ ইমাম বাইহাক্বী রাহমাতুল্লাহি আলায়হিও এ বিষয়ে একটি স্বতন্ত্র পুস্তিকা রচনা করেন। পুস্তিকাটির নাম হল : “হায়াতুল আম্বিয়া আলাইহিমুস্ সালামু ফী ক্বূবূরিহিম বা’দা ওফাতিহিম।” এ বিষয়ের প্রমাণ স্বরূপ তাঁরা অনেকগুলো হাদিস উল্লেখ করেন।
মে’রাজের সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার নামাজ: আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মিরাজে স্বীয় হাবিবকে আরশে আযীমে ডেকে নিয়ে উপহার হিসেবে দিয়েছেন যতগুলো হাদিয়া দিয়েছেন, তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হলো নামাজ। আর এ জন্যই সালাত মুমিনদের জন্য মিরাজ স্বরূপ।
আল্লাহ তাআলা তাঁর হাবিবের মানসিক অবস্থাকে বিবেচনা করে, এমন সান্ত¡নার ব্যবস্থা করলেন; যাতে তাঁর সমস্ত দু:খ-কষ্ট, বেদনা-যন্ত্রণা হ্রাস পেয়ে গেল। ভূ-মন্ডল, নভোমন্ডল ভেদ করে, সপ্ত আসমান পাড়ি দিয়ে, সত্তর হাজার নূরের পর্দা অতিক্রম করে, আরশে আযীমে ডেকে নিয়ে, হাবিবের সাথে একান্ত আলাপ করে বুঝিয়ে দিলেন; দুনিয়ার অবুঝরা আপনাকে মূল্যায়ন না করতে পারে; কিন্তু আপনার মর্যাদা আমার কাছে সবার থেকে অনেক বেশী। এ ছাড়াও রাসূল সালাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মিরাজে রয়েছে উম্মতের জন্য অপূর্ব শিক্ষার সমাহার।

লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, সাদার্ন
বিশ্ববিদ্যালয়, খতীব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ