নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রতি বৈষম্য

14

অধ্যক্ষ ড. মোহাম্মদ সানাউল্লাহ্

বৈশি^ক মহামারি করোনার ছোবলে বিপর্যস্ত পুরো বিশ্ব। ভয়ংকর বিপদগ্রস্ত এদেশের মাটি ও মানুষ। করোনার কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। গত ৩০ মার্চ খোলার কথা থাকলেও করোনা পরিস্থিতির ফের অবনতি হওয়ায় আগামী ২৩ মে থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালুর চিন্তা করছে সরকার। এখন দেশে নতুন ভ্যারিয়েন্টের করোনা ভাইরাসের আগ্রাসন চলছে এবং এ কারণে সরকার সংক্রমণ কমাতে লকডাউন দিতে বাধ্য হচ্ছে, তাতে করে পুনঃনির্ধারিত তারিখেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে সংশয়ের মেঘ ঘনীভূত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারি এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক-কর্মকর্তা কমচারীরা তাদের অর্থনৈতিক জীবন নিয়ে ‘নিশ্চিত’ থাকলেও চরম হতাশা এবং অর্থকষ্টে পড়েছেন দেশের ননএমপিও প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সংশ্লিষ্টরা, বিপাকে পড়েছেন বেসরকারি খাতের শিক্ষা উদ্যোক্তারা; যারা সরকারের মিশন-ভিশন বাস্তবায়নে শিক্ষা বিস্তারের মহান দায়িত্ববোধ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এসব প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অর্থনৈতিক জীবন প্রতিষ্ঠান চালু থাকার ওপরই অনেকটা নির্ভরশীল।
এ অবস্থায় গত এক বছরেরও বেশি সময় ধরে নন-এমপিও প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অত্যন্ত কঠিন সময় অতিক্রম করছে এবং সরকারের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণের বারংবার চেষ্টা সত্তে¡ও কেবল আশাহত হতে হচ্ছে। উপরন্তু এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়মিত ট্যাক্স ও ভ্যাট আদায় করা হচ্ছে। ইনকাম ট্যাক্সের অফিসারগণ এ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত আসছেন এবং কিংবা ঘন ঘন কড়া চিঠি পাঠানোর মাধ্যমে শিক্ষার মহৎ ও পবিত্র পরিবেশকে ক্ষুণ্ন করে। অনুমোদিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হওয়ার কারণে এ যেন আশীর্বাদের ফাগুন হওয়ার পরিবর্তে অভিশাপের আগুন হয়ে জ্বলছে। অগণিত প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লক্ষ লক্ষ শিক্ষক-কর্মচারী চরম বেতন দুর্ভোগে পড়লেও এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলেও যদি সম্মুখীন হতে হয় এ ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতির, তাহলে এদেশের শিক্ষার হার ও মান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? এসকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লক্ষ লক্ষ শিক্ষার্থীর দায়ভার তখন কে গ্রহণ করবে?
স্বাধীনতার মহান স্থপতি ও হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের পর অসংখ্য প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করলেও মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুব একটা স্থাপন করে যেতে পারেননি। তাঁর সুযোগ্য কন্যা এবং বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদিও সকল প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করেছেন এবং বেশ কিছু মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত কিংবা সরকারি করেছেন, তবুও এদেশের মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের ক্রমবর্ধমান ও বিপুল সংখ্যার তুলনায় তা এখনও অপ্রতুল। পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরবর্তী কিছু সময়কাল পর্যন্ত এদেশে শিক্ষার হার ছিল সর্বোচ্চ ১০% থেকে ১৫% এর মধ্যে। যদি সরকারকে শিক্ষার মহান লক্ষ্য পূরণে সহযোগিতা করতে কিছু মহান উদ্যোক্তা এগিয়ে না আসতেন এবং অনেকগুলো মানসম্মত প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে না তুলতেন, তাহলে বাংলাদেশের শিক্ষার হার কখনও বর্তমান অবস্থানে উন্নীত হতে পারতনা। এ দেশে বর্তমানে শিক্ষার হার ৭০% থেকে ৮০% এর মধ্যে বিরাজ করে। এক সময় ঝরেপড়া শিক্ষার্থীর যে অপ্রতিরোধ্য হার দীর্ঘদিন যাবত বিদ্যমান ছিল, তাও নিয়ন্ত্রিত হয়েছে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কারণে। অথচ এই বিপুল সংখ্যক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে উৎসাহিত করা কিংবা সহযোগিতা করার পরিবর্তে কড়ায় গন্ডায় আদায় করা হচ্ছে ট্যাক্স ও ভ্যাট। সরকার চাইলেও বাস্তবতার নিরিখে এতোগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা সম্ভব হতো না এবং দেশের সকল মানব সন্তানের শিক্ষার দায়িত্ব নিতে পারতনা। এ সকল প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তো সরকারের পাশে থেকে সরকারের করণীয় কাজটিই সম্পন্ন করছে অথচ এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতি দীর্ঘদিন ধরে রহস্যময় বৈষম্য চলছে। এসব ব্যাপারে এ যেন একেবারে উল্টো নীতিÑঠিক ছোটবেলায় পড়া ছড়াটির চরণের মতোই ঠেকে: ‘এক যে ছিল আজব দেশ/সব রকমে ভালো/ রাত্তিরেতে বেজায় রোদ/দিনে চাঁদের আলো। সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সরকার থেকে সবকিছু পায়, আবার তাদেরকে ট্যাক্সও দিতে হয়না। এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সরকার থেকে প্রায় সবকিছু পায় এবং তাদেরকেও ট্যাক্স দিতে হয়না। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় দাবি দাওয়া ও আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের ট্যাক্স মওকুফ করিয়ে নিয়েছে। অথচ অনুমোদিত প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সরকার থেকে তো কিছু পায়ই না, বরং সরকারকে ট্যাক্স ভ্যাট ইত্যাদি দিতে বাধ্য হয়। শিক্ষার বৃহত্তর স্বার্থে আমি সরকারের নিকট প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ট্যাক্স মওকুফের দাবি জানাচ্ছি।
জনগণ থেকে রাষ্ট্র ট্যাক্স নেয় এ জন্য যে, রাষ্ট্র জনগণের জন্যে কল্যাণমূলক কিছু কাজ করবে, তাদের সেবা দেবে ও নিরাপত্তা বিধান করবে, জনগণের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করবে। একটি দেশের উন্নয়নের জন্যে শিক্ষার ভূমিকা সর্বাধিক। যে দেশ ও জাতি যতো বেশি শিক্ষিত, সে দেশ ও জাতি ততো বেশি উন্নত। আমাদের দেশে বাৎসরিক বাজেটের এক বিশাল বরাদ্দ সরকারি ও এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়নের জন্যে রাখা হয়। পক্ষান্তরে, ননএমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো উক্ত বরাদ্দের কোনো অংশ না পেলেও হৃদয়বান উদ্যোক্তাদের মহতী উদ্যোগে পরিচালিত হয়ে সরকারের পাশে থেকে নিরলসভাবে শিক্ষার উন্নয়ন ও গতিশীলতার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে এবং শিক্ষার হার, বৃত্তি ও এ প্লাস বৃদ্ধিতে অসামান্য ভূমিকা পালন করছে। সরকারি ও এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা যে স্কেলে বেতন পান, ননএমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা তার ধারে কাছে না থাকলেও দিনরাত শিক্ষার্থীদের মেধা, মনন ও চরিত্রের বিকাশে সর্বোচ্চ সেবা ও শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। বিনিময়ে আমাদের দেশে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুরস্কারের বদলে পায় তিরস্কার, অনুপ্রেরণার বদলে পায় গঞ্জনা এবং প্রেষণার বদলে পায় হয়রানি। বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি যে, এদেশে দীর্ঘদিন যাবত অসংখ্য মহৎ মানুষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনে এগিয়ে এসেছেন। দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে এবং প্রয়োজনে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে হবে।
পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহে এই ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিভিন্নভাবে উৎসাহিত, পুরস্কৃত ও সহযোগিতা করা হয়, পক্ষান্তরে আমাদের দেশে দেখা যায় তার উল্টো চিত্র। কেন যেন মনে হয়, বঙ্গবন্ধুকন্যা এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে ননএমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে সঠিক রিপোর্ট, বিবরণ ও চিত্র উপস্থাপন করা হয় না। হয়তো সঠিক তথ্য ও সুপারিশ পেলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা গঠনমূলক ও ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন। অনেকগুলো প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যেতে হতোনা এবং লক্ষ লক্ষ শিক্ষক-কর্মচারীকে বিনা বেতনে কিংবা অর্ধবেতনে করুণ দিনাতিপাত করতে হত না। বৈষম্যের চরম ছোবলে জর্জরিত হয়ে আর্থিক চরম দুর্দশাগ্রস্ত নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ট্যাক্স ও ভ্যাট দিতে বাধ্য হতে হতনা। এই চরম বৈষম্য নিরসনে প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য আগামী বাজেটে প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ ও ট্যাক্স মওকুফের জন্যে আমি মাননীয় অর্থমন্ত্রীসহ বর্তমান সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সুদক্ষ দেশনেত্রী ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সুদৃষ্টি কামনা করছি।

লেখক: অধ্যক্ষ, গবেষক ও সংগঠক