‘নন্দ নন্দন কৃষ্ণ মোর প্রাণনাথ’

399

 

“নন্দ নন্দন কৃষ্ণ মোর প্রাণনাথ”- পঞ্চদশ শতকে গৌড়ের একজন সুলতানের কাছ থেকে উপাধিপ্রাপ্ত ‘গুণরাজ খান’ ওরফে কবি মালাধর বসু তাঁর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’ কাব্যে শ্রীকৃষ্ণকেই ‘প্রাণনাথ’ সম্বোধন করেছেন। কলিযুগে শচীগর্ভসিন্ধু থেকে জীবোদ্ধারকল্পে হরিনাম সংকীর্তন প্রবর্তনের জন্য আবির্ভূত শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কাছেও মালাধর বসুর এই বাক্যটি অত্যন্ত প্রিয় ছিল। ‘প্রাণনাথ’ মানে হৃদয়েশ্বর বা প্রাণের অধিপতি বা প্রাণের রক্ষক বা জগন্নাথ বা ভগবান। নন্দ নন্দন কৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান। হিন্দু সম্প্রদায়ের চিরন্তন বিশ্বাস, ‘কৃষ্ণস্তু ভগবান স্বয়ং’।
স্বয়ং ভগবান কৃষ্ণ, কৃষ্ণ সর্বাশ্রয়
পরম ঈশ্বর কৃষ্ণ, সর্ব শাস্ত্রে কয়।’
-(চৈঃচঃ আঃ ২/১০৬)

আজ থেকে ৫২৪৭ বছর পূর্বে দ্বাপর যুগে প্রবল পরাক্রমশালী অসুর ও দুষ্ট রাজাদের অত্যাচার থেকে মানবজাতিকে মুক্তি দেয়ার প্রয়াসে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব। দুরাচারী কংসের কারাগারে মানসিক যোগের মাধ্যমে দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান শ্রীকৃষ্ণ। তাঁর পিতা মহাত্মা বসুদেব। মহাত্মা বসুদেব তাঁকে দুরাচারী কংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য যে রাত্রে তিনি জন্মেছিলেন সে রাত্রেই তাঁকে গোকুলে নন্দ ও যশোদা’র কাছে রেখে আসেন। শ্রীকৃষ্ণের জন্মের রাত ঘুটঘুটে অন্ধকার ও অতি দূর্যোগপূর্ণ ছিল। নন্দ ছিলেন বসুদেবের খুড়তুতো ভাই আর নন্দের স্ত্রী ছিলেন যশোদা। নন্দ ও যশোদা’র ঘরেই শ্রীকৃষ্ণ লালিত পালিত হন। তাই শ্রীকৃষ্ণকে নন্দ নন্দন বলা হয়।
হিন্দু শাস্ত্রমতে, শ্রীকৃষ্ণ বিষ্ণুর অষ্টম অবতার এবং পূর্ণাবতার। শ্রীকৃষ্ণই পরমেশ্বর ভগবান। এখানে ‘পরম’ অর্থ শ্রেষ্ঠ, প্রকৃত। ‘ ঈশ্বর’ মানে জগৎগ্রষ্টা, প্রভু। ভগবান অর্থাৎ যাঁর আছে ঐশ্বর্য(ঈশ্বরত্ব), বীর্য(সর্বশক্তি), যশঃ, শ্রী, জ্ঞান ও বৈরাগ্য-এই ষষ্ঠ গুণ।
হিন্দু পঞ্জিকা অনুযায়ী ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথি ও রোহিণী নক্ষত্রের প্রাধান্য থাকলে শ্রীকৃষ্ণের শুভ জন্মাষ্টমী পালিত হয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব তিথিই শুভ জন্মাষ্টমী। এ জন্মাষ্টমীর দিন দেশের মন্দিরে মন্দিরে শ্রীকৃষ্ণের পূজা, তারকব্রহ্ম হরিনাম সংকীর্তন, গীতা পাঠ ও যজ্ঞানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ দিন হিন্দু নর-নারীরা উপবাস থেকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করে নিজের, পরিবার পরিজনের ও বিশ্ব-জগতের কল্যাণ প্রার্থনা করেন। এ দিন ভক্তরা দেশের বিভিন্ন জায়গায় জন্মাষ্টমীর নান্দনিক শোভাযাত্রা বের করেন। জন্মাষ্টমীর মিছিল বা শোভাযাত্রার ঐতিহাসিক তাৎপর্যও রয়েছে।
সনাতন ধর্মের সর্বপ্রাচীন পবিত্র গ্রন্থ অভ্রান্ত ঋষিদের দ্বারা গ্রন্থিত ও মহর্ষি বেদব্যাস বিভাজিত চতুর্বেদের মধ্যে ঋগ্বেদে কৃষ্ণের উল্লেখ আছে। মহর্ষি কৃষ্ণ দৈপায়ন বেদব্যাস রচিত প্রাচীন মহাকাব্য মহাভারত, হরিবংশ, পুরান, উপনিষদ, শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা ও বৈষ্ণব পদাবলীতে শ্রীকৃষ্ণ অবতারের বিভিন্ন লীলা কাহিনীর লিপিবদ্ধ বর্ণনা আছে। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও তাঁর ‘কৃষ্ণচরিত্র‘ গ্রন্থে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবের ঐতিহাসিকতাও চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন।
দিকভ্রষ্ট ও ভোগবিলাসে মত্ত মানুষকে মুক্তির পথ দেখাতে, সৎ মানুষদের রক্ষার্থে ও অধর্মের বিনাশ করে ধর্ম সংস্থাপনের নিমিত্তে ভগবান পৃথিবীতে অবতীর্ণ হন। পবিত্র বেদ, বেদান্তের সার ও মানবজাতির জীবনবিধানস্বরূপ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলেছেন,
“যদা যদা হি ধর্মস্য গøানির্ভবতি ভারত।
অভ্যুত্থানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্॥
পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশয় চ দুষ্কৃতাং।
ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে॥(গীতা ৪/৭ও৮)
অর্থাৎ, “যখনই ধর্মের গøানি হয়, অধর্মের অভ্যুত্থান ঘটে তখনই হে ভরতবংশী (অর্জুন), পাপীদের পরিত্রাণ এবং দুস্কৃতকারীদের বিনাশ করে ধর্মসংস্থাপন করার জন্য আমি [স্বীয় পরমাত্মাকে মায়া দ্বারা সৃজন করি] যুগে যুগে অবতীর্ণ হই।”

সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় যাঁর খেয়ালেই সংঘটিত হয় তিনিই ‘কেশব’। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার কর্মযোগে অর্জুন ভগবান শ্রীকৃষ্ণকেই ‘কেশব’ সম্বোধন করেছেন। ‘ক’-তে ব্রহ্মা, ‘অ’-তে বিষ্ণু ও ‘ঈশ’-তে মহেশ যাঁর স্বরূপ তিনিই কেশব, পরমব্রহ্ম। সৃষ্টি, স্থিতি আর প্রলয় যাঁর ইশারায় তিনিই পরমব্রহ্ম। তিনিই সচ্চিদানন্দ অর্থাৎ নিত্যজ্ঞানসুখস্বরূপ ব্রহ্ম, পরমেশ্বর। সচ্চিদানন্দ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আপনার প্রেমের আনন্দ উপভোগের জন্য ভক্ত আর ভগবানরূপে বিশ্বব্যাপী পরিব্যাপ্ত আছেন। শিশুরা যেমন আপন মনে উদাসীনভাবে খেলতে গিয়ে মুহূর্তের মধ্যে খেলার ধরণ পরিবর্তন করে ফেলে অথবা অন্যত্র ডাক পরলে খেলার কথা বেমালুম ভুলে যায়, অর্থাৎ একেবারে নিরাসক্ত শিশুদের এ খেলা, সুখ বা ভোগের জন্য তাদের খেলা নয়, নিছক আনন্দ উপভোগের জন্যই তাদের খেলা, ঠিক তেমনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সৃষ্টি, স্থিতি ও বিনাশের লীলায় অবিরত থাকলেও আপন সত্তায় নিরাসক্ত থাকেন, নিজে জড়িয়ে পড়া থেকে মুক্ত থাকেন। তাই সাম্যবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলাম যথার্থ বলেছেন, ‘খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে/বিরাট শিশু, আনমনে।’
নিরাকার ঈশ্বর অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণ অসীম, অনন্ত। আর তাঁর সৃষ্টি পাার্থিব জগতের সবকিছুই সসীম বা সীমা নির্দেশিত। অসীম নিরাকার ঈশ্বর যখন তাঁর সৃষ্টির লীলা চরিতার্থ করার জন্য তাঁর সৃষ্টির মধ্যে আকার ধারণ করেন, তাতে একটি নির্দিষ্ট সীমা নির্দেশিত হয়ে যায়। আর তখনই এই সসীম সৃষ্টির মধ্যে অসীম ঈশ্বরের আবির্ভাব হয় অর্থাৎ সীমার মধ্যে অসীমের অবস্থান ঘটে। এভাবেই তাঁর সৃষ্টির মধ্যে তাঁরই প্রকাশ ঘটে। তাই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর/ আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর।‘
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সর্বভূতে বিরাজমান। জীবাত্মারূপে জীবের মধ্যে তাঁর বিচরণ। জীবাত্মার সাথে ঈশ্বররূপ পরমাত্মার মিলন ঘটাতে পারা অর্থাৎ রূপের সাথে অরূপের মিলনে জড়জগৎ থেকে বৈকুণ্ঠলোকের অধিকারী হওয়া যাবে। আর এজন্য দরকার জীবকল্যাণহেতু রচিত ধর্মীয় অনুশাসন মেনে জীবনযাপন করা ও ভক্তিআপ্লুত হৃদয়ে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করা। তবেই শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী উদযাপন সার্থক হবে। জয় শ্রীকৃষ্ণ।

লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক