নদ-নদীর জীবন্ত সত্তা স্বীকৃত হোক

9

 

‘বাঁকা নদী ঝিরি ঝিরি বইছে বারোমাস’ শত বৎসর আগে বাংলাদেশে এই চিত্র ছিলো খুব স্বাভাবিক। পলিবাহিত এই বদ্বীপে ছিল অসংখ্য নদ-নদী। সে আজ ইতিহাস। ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে’ রবি ঠাকুরের এই কবিতার সাথে আমাদের শৈশব থেকে পরিচয়। সাম্প্রতিক কালের অনেক কবি’র কবিতায় নদী এসেছে বহু বিচিত্র বর্ণনায়। আজ সে সকল নদীর যৌবন ও জুলুস খুঁজে পাওয়া দুস্কর। আমাদের অবিমৃশ্যকারিতার কারণে হারিয়ে গেছে শতশত নদী। প্রতিবেশি দেশগুলোর পানিপ্রবাহ বন্ধ এবং নদীতে নানান স্থাপনা নির্মাণের কারণে নদীগুলো ক্রমান্বয়ে হারিয়ে গেছে। নদীতে পানিপ্রবাহ কমে গেছে নদী যেমন শুকিয়ে যায় তেমনি দখল দূষণেও নদী মরে যায়। ঔদক বিশেষজ্ঞ ও গবেষকরা বলেন, মানুষের স্মৃতি প্রবাহের মতো নদীর স্মৃতি প্রবাহ চলমান। মাননীয় আদালত ঢাকার একটি নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ হিসাবে ঘোষণা করে, তাকে সংরক্ষণের তাগিদ দেয়। বাংলাদেশে গত ৫৭ বছরে ১৫৮টি নদী শুকিয়ে যাওয়ার তথ্যে বিচলিত না হয়ে পারি না। কবি আল মাহমুদের নদীর ভিতরে যেন উষ্ণ এক নদী স্নান করে’ কবিতার চরণে নারী চরিত্রের কথা প্রস্ফুটিত হয়েছে। মাতৃ জটরে আমাদের জন্ম। পলি বিধৌত বাংলাদেশ নদীর জরায়ু থেকে উদ্ভত একটি দেশ শ্যামল সবুজে ভূমি। অথচ আমরা আমাদের মাতৃত্বকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছি চরমভাবে।
দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে কিছুদিন পর পর নদী রক্ষার দৃঢ় অঙ্গীকার ঘোষিত হয়। নদী বাঁচাতে সারা বছর জুড়ে খনন কার্যক্রম ও অবৈধ দখলদারের উচ্ছেদের কথা বলা হলেও সেই তিমিরে থেকে যায় সকল কার্যক্রম। ক্ষমতার পৃষ্ঠপোষকতা ও আশীর্বাদে দখল দূষণ শেষ পর্যন্ত অপ্রতিরোধ্যই থেকেই যায়। যার পরিণতিতে দেশের প্রায় সকল নদ-নদী দূষণ ও দখলের কারণে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাই নদী রক্ষার কাজটি শুধু প্রতিশ্রæতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না।
দুটি গবেষণা সমীক্ষা অনুযায়ী ১৯৬৩ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দেশে ১৫৮টি নদী শুকিয়ে গেছে। পাশাপাশি মানুষের দখল ও দূষণের কারণে চট্টগ্রামের কর্ণফুলিসহ আর কতো নদী যন্ত্রণা ভোগ করে মৃত্যুর দিন গুনছে তার সঠিক হিসাব বলা হয় নি। নদী ও প্রকৃতি নিয়ে দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, ‘উত্তরণ’এর সমীক্ষা অনুযায়ী গত বিশ বছরে (২০০০-২০২০) পর্যন্ত দেশে ৪৩টি নদী শুকিয়ে মরে গেছে। তারা মনে করেন উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ও নদীতে নানা অবকাঠামো নির্মাণ ও দখলের কারণে নদীর মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না। তাদের তথ্যে আরও জানা যায় যে, দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বেতনা, চুনা, শালিখা, শালিতা, হামকুড়া ও হাতিটানার মতো তীব্র স্রোতের নদীগুলো এখন শুকিয়ে গেছে। অপরিকল্পিত বেড়িবাঁধ এই নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। বাংলাদেশে কিছু নদী আছে যাদের পানিপ্রবাহ আছে; কিন্তু দূষিত হওয়ার কারণে পানি ব্যবহার করা যাচ্ছেনা। এসব নদীর শীর্ষে আছে বুড়িগঙ্গা, বালু, শীতলক্ষ্যা, ধলেশ্বরী ইত্যাদি। দেশের নদ-নদীর পানির গুণগত মান দেখা নিয়ে ১৯৯১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা সমীক্ষার ফলাফল মূল্যায়ন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক। তাদের পর্যবেক্ষণে উঠে আসে যে, দেশের ৩২টি নদীতে নানা মাত্রার ভারী ধাতুর উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে।
দেশের নদীগুলোর কর্তৃত্ব কার হাতে তা বিশ্লেষণ করা যাক। নৌ পথের দায়িত্বে আছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (BIWTC)। নদীর তীর রক্ষা ও খননের দায়িত্বে আছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। আবার নদীর ভূমি মালিক হিসাবে ইজারা দিচ্ছে ভূমিমন্ত্রণালয়, মৎস্য সম্পদের দেখভাল করে মৎস্য অধিদপ্তর। নদীতে থাকা কুমির ও ডলফিনের মতো প্রাণীর সুরক্ষার দায়িত্বে আছে বন বিভাগ, নদী থেকে সেচের ব্যবস্থা এবং রাবার ড্যাম করার দায়িত্বে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, নদী থেকে পানি তুলে পরিশোধন করে তা শহরে সরবরাহ করার দায়িত্ব ওয়াসার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের। সামগ্রিকভাবে নদী রক্ষার দায়িত্বে আছে ‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন’।
২০২০ সালে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ৩০ হাজার ৫৫৮ জন নদী দখলদারের হালনাগাদ তালিকা প্রকাশ করে। সবচেয়ে বেশি দখলদার কুমিল্লা জেলায়। তালিকা অনুযায়ী দখলদারদের বেশিরভাগই হচ্ছে প্রভাবশালী শিল্পগ্রুপ, প্রতিষ্ঠান ও রাজনীতিবিদ। সাম্প্রতিক সময়ে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদী দখলমুক্ত করার সময় আওয়ামী লীগ সাংসদ ও যথাক্রমে হাজী মোহাম্মদ সেলিম ও আসলামুল হক বাধা প্রদান করেন। নদীর ভূমি দখলের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব বেশিলক্ষ্য করা যায়। যদিও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের দাবি, দখলদারের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি ও উচ্ছেদ কাজ একই সঙ্গে চলছে। দখলদারকে উচ্ছেদ করে নদীকে তার জায়গায় ফিরিয়ে দিয়ে প্রাকৃতিক প্রবাহ নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো দেশে নদীর প্রকৃত সংখ্যা কতো, তা এখনও জরিপ করা হয়নি। নদীর সংখ্যা নিয়ে সরকার প্রতিষ্ঠান, দপ্তর, গবেষকদল এক এক ধরনের সংখ্যার কথা বলেন। সর্বশেষ পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০১১ সালের জরিপ অনুযায়ী নদীর সংখ্যা জানায় ৪০৫টি। পানি উন্নয়ন বোর্ড নাসার ভূ-উপগ্রহ থেকে তোলা ছবি ও মাঠপর্যায়ের জরিপের ভিত্তিতে এই তালিকা প্রকাশ করে। ২০০৫ সালে একই প্রতিষ্ঠান একটি গ্রন্থ প্রকাশ করে, তাতে বলা হয় দেশের নদীর সংখ্যা ৩১০টি। আবার সরকারি বাংলাপিডিয়ায় বলা হয়েছে ৭০০টি, বাংলা লোক কথা ও সাহিত্যে নদীর সংখ্যা হাজারের বেশি। ২০১২ সালে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী জাতীয় সংসদে জানান যে, দেশে নদ-নদীর সংখ্যা ৩১০টি। তার মধ্যে ২১২টি নদী প্রবাহমান এবং ৯৭টি মৃতপ্রায়। স্বাধীনতার পর বাগের হাটের ভোলা নদীটি মরে গেছে। বাংলাদেশ পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থা ওয়ারপর সাবেক মহাপরিচালক ও নদী গবেষক ম.ইনামুল হক জানান যে, দেশে মোট নদীর সংখ্যা ১ হাজার ৫১৬টি।
১৯৯৭ সালের মার্চে ব্রাজিলে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে নদীকৃত দিবসের সিদ্ধান্ত হয়। তাতে নদীর প্রতি মানুষের করণীয় কী , নদী রক্ষার মানব জাতির দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং মানুষ ও দেশের দায়বদ্ধতার কথা উচ্চারিত হয়। নদী রক্ষা না পাওয়ার কারণে প্রতিবছর দেশে বর্ষায় ও উজানে পানিতে উত্তর সহ নানাস্থানে প্লাবন দেখা যায়। এতে করে জানমাল ও সম্পদের প্রভূত ক্ষতি হয়। এ ক্ষতি আমরা পরিসংখ্যান ও পরিমাপ করে দেখি না। দেশের অভ্যন্তরের সকল নদ-নদীগুলো যদি সমানভাবে রক্ষা ও তার স্বাভাবিক প্রবাহ রক্ষা করা যেত তা হলে বর্ষা বন্যার পানি সরাসরি বঙ্গোপসাগরে পতিত হতো। এছাড়া নদীগুলো পর্যাপ্ত পানি ধারণ করার শক্তি পেলে মৎস্য চাষ, কৃষি, নৌযোগাযোগ সর্বোপরি ব্যবসা বাণিজ্যে অধিক গতিশীল হতো। নদীর সাথে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং মানব সভ্যতার উত্থান পতন নির্ভরশীল। নদীসমূহে পানির প্রবাহ না থাকার কারণে দেশের ভূ-অভ্যন্তরে পানির স্তর দিন দিন নিম্নমুখী হচ্ছে। ফলে শ্যালো ও ডিপ টিউবওয়েলে পানির লেয়ার পাওয়া যাচ্ছে না কাম্যস্তরে।
মোদ্দা কথায় দেশের নদ-নদী বাঁচাতে হলে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে আগে নির্ধারণ করতে হবে দেশের প্রকৃত নদীর সংখ্যা। সাথে কতটি নদী প্রবাহমান এবং কতগুলি শুকিয়ে মৃত্যুর দিন গুনছে এবং কতগুলি ইতিমধ্যে মরে গেছে। নদীর প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয় করা গেলে তা থেকে অবৈধ দখল উচ্ছেদ সম্ভব হবে। নদী নিয়ে মাননীয় আদালতের রায় বাস্তবায়নের আন্তরিক হলে দেশের নদী প্রবাহমান হবে। সকল নদীকে জীবন্ত সত্তা হিসাবে ঘোষণা করা হোক। এছাড়া সরকারের উচিত হবে নদী সম্পর্কিত সকল সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে একটি ছাতার নিচে নিয়ে আসা প্রয়োজন নদী বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করা যেতে পারে। এটা বাস্তবায়িত হলে দেশের নদী ব্যবস্থাপনা ও প্রবাহে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।
লেখক : কবি, নিসর্গী ও ব্যাংক নির্বাহী (অব)